"ভাইজান, নৌকা তাড়াতাড়ি চালান।আমি পিশাব করবো।তল পেডে বেসম্ভব চাপ!"
"ইমাম সাব, চাইর দিগে পানি আর পানি ঘাটে যাইতে আরও মেলা সময় লাগবো। আপনে নৌকাত্তেই পানিতে পিশাব করেন। আর আশেপাশে কেউ নাই, কেউ দেখতো না। আমি কাউরে কমু না, আল্লা-নবীর কিরা।"
ইমাম সাব হাসলেন। বললেন,"কেউ দেখুক বা না দেখুক উপরে একজন আছেন সব দেখছেন। উনার কাছে কি জবাব দিব? আপনি দ্রুত চালান।আমি পাড়ে গিয়েই পিশাব করবো।"
মালেকের মন খারাপ হল। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিল। দুনিয়াতে কত ভালা মানুষ আছে আর সে কিনা হইছে চুর!মাঝিগিরির পাশাপাশি সে চুরি করে। শুক্কুরবারে অবশ্য মসজিদে গিয়া তওবা করে।তওবা করলেই তো আর চ্যালচ্যালাইয়া বেহেশতে যাওন যাইত না।আল্লাহপাক তো বলবেন না,"মালেক তুমি চুরি কইরা তওবা করছ,চুর অইলেও তুমার ইমান শক্ত। যাও জান্নাতে গিয়া হুর নিয়া ফুর্তি কর, শরাব খাও।"
"আইচ্ছা, ইমাম সাব, আল্লা কি বিরাট রাগী।"
"নাহ, আল্লাহ রাগী নন। রাগী আমরা মানুষেরা। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল। আল্লাহ সব অপরাধ ক্ষমা করে দেন।"
ইমাম সাব মালেকের দিকে একটা একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,"ভাইজান, আপনের জন্যে একটা লুঙ্গি, একটা জামা কিনছি। উপহার নিলে বড় আনন্দ পাব।আমি খেয়াল করেছি, আপনার দুইটা মাত্র লুঙ্গি।"
মালেক মিয়া ব্যাগটা নিল। মন খারাপ করেই নিল। ইমাম সাব খুবই ভালো মানুষ। গেরামে সেই কেবল তাকে ভাইজান ডাকে, আপনি বলে সম্মান দেয়। অথচ কাল মালেক ইমাম সাবের একটা লুঙ্গি, একটা গামছা চুরি করেছে। মালেকের দুষ নাই, সইন্ধ্যা হইলে, কাপড়-চোপড় ঘরে নেওন লাগে। ইমাম সাব নেয় নাই, মালেক আধা রাইতে গিয়া দেখে গামছা, লুঙ্গি দড়িতেই ঝুলে আছে। তাই সে চুরি করেছে, বাধ্য হয়েই করেছে। সে চুরি না করলে অন্য কেই করতো। দুধেরচড় চুরের গেরাম। এই গেরামে কোন ভালো ইমাম টিকে না, এই ইমাম কয়দিন টিকে কে জানে? ততদিন মালেক লুঙ্গিটা পড়তে পারবে না।
আষাঢ় মাস, ব্রহ্মপুত্রের দু'কূল ছাপিয়ে পানি নারায়ণখোলা, শিকদারপাড়া, জাংগীরারপাড়, সেনাকান্দা গ্রাম ভাসিয়ে দিয়েছে। মালেক বৈঠা ধরে বসে রইল।নদীতে মালেকের নৌকা ছাড়া কোন নৌকা নেই। অথচ একটা বাচ্চার গলা শোনা যাচ্ছে
"আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই......"
এমন হবার কথা না। ইমাম সাব, মালেক এদিক ওদিক খুজতে লাগলো। কিছুই নাই, চারদিকে কেবল পানি আর পানি। তবে বাচ্চাটার ছড়া কাটা থামেনি, শোনাই যাচ্ছে! দূরে দ্বীপের একটা কাশবনের ঝোপ, শব্দ ওদিক থেকেই আসছে। ইমাম সাব নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি নৌকা থেকে ঝাপ দিলেন। দ্রুত সাঁতরে ঝোপের দিকে চললেন।
কাশবনে একটা ভেলা আটকে আছে।ভেলায় রেশমি কাপড়ের তৈরি ছাদের নিচে লাল চাদরের বিছানায় বসে আছে ৪-৫ বছরের একটা ছোট মেয়ে। ছড়া সেই কাটছে।লম্বা চুলে মেয়েটির মুখ ঢেকে আছে। ইমাম সাব ভেলায় হাত রাখতেই মেয়েটি চমকে ভেলার একদিকে সরে গেল!
"আম্মাগো, আর ডর নাই। আমি আপনেরে পাড়ে নিয়া যাব।আসেন আসেন, আমার হাত ধরেন। কোন ডর নাই!আসেন, আম্মা।"
মেয়েটি চোখ নামিয়ে ফেলল, হাত দিয়ে খুটি জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ছলছল চোখে বললো,"আমারে পাড়ে নিয়া কাম নাই, আমিতো মইরা গেছি।"
"কি কন আম্মা,আপনে মরবেন কেমনে?মরা মাইনশে কথা কইতে পারেনি!"
মেয়েটি ওর পা সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো,"হুজুর, এইযে দেহেন, আমারে সাপে কামড়াইছে। কালা সাপ, আমারে যেই ছুইবো হেই মরবো।"
"তাইলেতো ছুয়াই দেখন লাগে।আসেন আম্মা, আমার কান্ধে চড়েন।আসেন মেলা কাম, আপনের বাড়িঘর,আপনের আব্বারে খুজন লাগবো।"
মেয়েটি কি করবে ভেবে পায় না। ইমাম সাবই মেয়েটিকে পাজ কোলা করে তুলে নিলেন। মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল! কই হুজুরতো মরে নাই, তাইলে তারে কেন ভেলায় করে ভাসিয়ে দেয়া হল?
আনন্দ বা দুঃখ যে কারনেই হোক, মেয়েটি কাঁদছে!
ততক্ষণে মালেক নৌকা নিয়ে চলে এসেছে।
নৌকায় মেয়েটি ইমাম সাবের গলা জড়িয়ে বসে রইল। ইমাম সাব জিজ্ঞেস করলেন,"আম্মা, আপনার নাম কি গো?"
"পরী"
"আপনের বাড়ি কই?"
পরী হাত তুলে যেদিকে দেখাল সেদিকে পানি ছাড়া আর কিছুই নাই।
"আম্মা, আপনের বাপের নাম কি?"
পরী উত্তর দিতে পারলো না, ঘুমিয়ে পরেছে।
ইমাম সাব অনেক চেষ্টা করলেন, কিছুতেই কোন হদিস পেলেন না। পরীও কিছু বলতে পারে না। নদীর পাড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে যেদিকে দেখিয়ে দেয় সেদিকে অনেকদূর যাওয়া হয়েছিল, কোন ঘরবাড়ি নাই।
সময় চলে গেল, গ্রামের ছোট মসজিদ অনেক বড় হল। পরীও বড় হচ্ছিলো। ইমাম সাহেব মসজিদের চারপাশে অসংখ্য গাছ লাগিয়েছেন, সবই নানা ফুলের বড় বড় গাছ- বকুল, শিউলি, কৃষ্ণচূড়া, বকফুল, সোনালূ আরও কত কি!
পরী আর গাছ দুটোই পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে। সবকিছুই বদলে, কেবল পাল্টায়নি পরীর প্রতি ইমাম সাবের গভীর ভালোবাসা।এটা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে!
তিনি ছোটবেলায় মেয়েকে আরবি পড়ানোর চেষ্টা করেছেন। মেয়ে পড়ে নাই, বলেছে,"আমার আম্মায় একটা কালা পাত্থরে দুধ ঢালে আর গীত গায়।পরতি বছরে আমরা মাডির পুতলা সাজাই, হের সামনে হুইয়া পরি,গান গাই, ধুমা দিয়া নাচ করি।"
আর বুঝার বাকি থাকে না, পরীরা হিন্দু! ইমাম আর চেষ্টা করেনি। পরী থাকুক পরীর মত, আল্লাহ চাইলে ওকে মুসলিম বানাতে পারতেন। আল্লাহ বানাননি, সে কেন চেষ্টা করবে?
অনেক বছর চলে গেল। পরী অনেক বড় হয়েছে!পরী সত্যিই পরীর মতই। কানা ছেলের নাম যে পদ্মলোচন রাখা হয় তেমন না!
ইমাম সাবকে সে আব্বা ডাকে। রাতে খেতে বসে বাবা-মেয়ে গল্প করেন।ঘুমাতে যাওয়ার আগেও ছোটবেলার মত পরী গল্প শুনতে চায়। ইমাম সাব ওকে হাদিস শোনান। পরী ঘুমিয়ে পরে, ইমাম সাহেব জেগে থাকেন। মেয়ে বড় হয়েছে, আলাদা ঘর দরকার, মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে! নানা চিন্তার মাঝে বড় একটা চিন্তা মাতবর মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। ৬০ বছরের বুড়ার সাথে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিতে চান না। তিনি না করে দিয়েছেন, মাতবর খুশি হন নাই!তিনি আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলেন।উনার চিন্তায় ছেদ পরলো পরীর ডাকে।
"আব্বা,ও আব্বা!ঘুমাইছ?কাল কিন্তু আমি মসজিদের বকুল গাছ তলে ফুল কুড়াইতে যামু।"
"না গো আম্মা, মেয়ে মানুষের মসজিদে যাওয়া নিষেধ।"
"কেন আব্বা? আল্লাহ পাপ দিবেন? আল্লাহ কি ভীষণ রাগী, খালি পাপ দেন?"
"না আম্মা, আল্লাহ রাগী নন। মানুষ রাগী, আমি মানুষের রাগ ভয় পাই।"
"আমি কি তাইলে কোনদিন বকুল গাছের নিচে যাইতে পারবো না? নাফি যে কইলো সকালে বকুলগাছর নিচে নাকি মেলা ঘ্রাণ পাওয়া যায়, কেমন নিশা নিশা লাগে!আমি তাইলে কোন দিন এইডা পরিক্ষা করতে পারমু না?
মাইয়া হওন কত জ্বালা! নাফি হারাদিন কত জায়গায় যাইতে পারে, আপনে আমারে বাড়িত্তে বাইর হইতে দেন না।"
"পারবা গো আম্মা, পারবা। কাইলকাই আমি একটা বকুলের চারা বাড়ির উঠানে পুইতা দিমুনে।তুমি ঘুমাও, কাইল আমি তোমার জন্য মেলা বকুল ফুল আনবো।"
ইমাম সাবের বাড়িতে আজ সাজসাজ রব। পাড়ার সবাই এই বাড়িতে, সালিশে মেয়েছেলের উপস্থিতি নিষেধ। তবে আজ পর্দার ব্যবস্থা করা হয়েছে, মেয়েরা আড়াল থেকে বিচার দেখছে।
ছালাম মাতবর গলা খাকারি দিয়ে কথা শুরু করলেন।
"মাওলানা তোমার টুপির তলে ডুফির বাসা। তুমি কি মনে করছ, মানুষে কিছুই বুঝে না? সইত্য কুনদিন গোপন থাহে না।
তোমার বিরুদ্ধে খারাপ অভিযোগ আছে, তুমি এই মালাউন মাইয়াডারে নিজের মাইয়া বানাইয়া ফষ্টিনষ্টি কর। এক বিছানায় ঘুমাও।"
"চুপ করেন জনাব, এই মিথ্যা কথা আল্লাহ সহ্য করবেন না। পরী আমার নিজের মেয়ের মত।"
"মেয়ের মত, মেয়ে ত না।" মাতবর দাঁত খিচিয়ে উত্তর দিল।
ইমাম সাব ঈষৎ রেগে গেলেন।
"আমি যে এই কাজ করেছি, এর প্রমাণ কি?"
"সাক্ষী, প্রমাণ ছাড়া ছালাম মাতবর কিছুই বলে না।
মালেক সাক্ষী, সে বিয়ানে তোমারে ডাকবার গিয়া দেহে তুমি আর পরী এক বিছানায় ঘুমাইয়া রইছ।"
মালেক মাথা নেড়ে সায় দিল।
ইমাম সাব কেঁদে ফেললেন।
"সব ইবলিশ শয়তানের কারসাজি! আল্লাহ তুমি আমারে এত বড় পরিক্ষায় ফেল না।"
ইমাম আয়তুল কুরসি, সুরা আহাদ, সুরা নাছ পড়ার চেষ্টা করলেন, কিছুতেই আয়াত মনে করতে পারলেন না। এই তিন সুরা সকল বিপদ থেকে রক্ষা করে।
"মাওলানা, তুমি সবাইরে কও তুমি এই কাম করছ।"
ইমাম সবার দিকে করজোড়ে দাঁড়িয়ে বললেন,"আপনারা বিশ্বাস করেন, পরী আমার মেয়ে। আমি এই পাপ কাজ করি নাই।"
"মাওলানা, মালেক নিজের চৌক্ষে দেখছে। তুমি অস্বীকার করতাছ। তোমারে আমি নেংটা কইরা সারা গেরামে না ঘুরাইলে আমার বাপের হইব কালা কুত্তা।এহনো সময় আছে, অপরাধ মাইনা লও।"
"আমি যা করি নাই, তা মানবো কেন?"
"মাইনা লইলে মাফ দিব।সবার সামনে কান ধইরা মাফ চাও, অপরাধ স্বীকার কর।মিছা কতা কইয়ো না।"
"আমি এই কাজ করিই নাই, মাফ চাইব কেন?"
ছালাম মাতবর রেগে গেলেন। তার পালা ষণ্ডাদের হুকুম দিলেন ইমামের কাপড় খুলে নেয়ার। ওরা তিনজনে ইমাম সাবের পাঞ্জাবি ছিড়ে ফেলল।
পরী বাইরে বেড়িয়ে এল।
"আপনেরা আব্বারে এমনে অপমান করতাছেন কেন?........"
কথা শেষ আগেই মাতবর ওর গালে দিল কষে চড়। পরী মাটিতে পরে গেল।
মাতবর গজগজ করতে লাগলেন,"মাগীর সাহস দেখছ, পুরুষ মানুষের সামনে কতা কইতে আহে।"
"আচ্ছা, মাতবর সাব আমি এই কাম করছি। আমারে মাফ করেন।"
মাতবর হেসে বললেন,"হুন, হুন গেরাম বাসী। এতক্ষণে বুলি ফুটছে।মাওলানা, তুমি এতক্ষণ স্বীকার করলা না কেন, মিছা কথা কইলা কেন?"
"আমি এই কাম করি নাই, এইজন্য।"
"তাইলে অহন স্বীকার করলা কেন?"
"জান বাঁচানোর জন্য, ইজ্জত বাঁচানোর জন্য করছি।"
"তোমার মান ইজ্জতের আমি খেতাপুড়ি।"
ইমামকে সত্যিই বিবস্ত্র করে সারা গ্রামে ঘুরানো হল।
বিকালের আগেই মালেকের মাথা খারাপ হয়ে গেল। সে সারা গ্রামে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো।
"ইমাম সাব কোন খারাপ কাম করে নাই, আমি মাতবরের টেকা নিয়া মিছা কতা কইছি।আমার আল্লা-নবীর কিরা।"
এই প্রথম মালেক সত্য কথা বললো, অথচ কেউ বিশ্বাস করলো না। সবাই ধরেই নিল, ইমাম ওকে তাবিজ করেছে। মালেক পাগল হয়ে গেছে।
পরদিন সকালে মসজিদের পাশে বকুল গাছটায় ইমাম সাব আর পরীর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেল।ছোট্ট নাফিই প্রথলে লাশ দেখলো।
সেদিন সকালে বকুল তলা ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল।আচ্ছা, পরী কি বুঝতে পেরেছিল, সকালে বকুলগাছর নিচে মেলা ঘ্রাণ পাওয়া যায়, কেমন নিশা নিশা লাগে?
এটা নাফি আর কোনদিন পরী আফাকে জিজ্ঞেস করতে পারবে না। নাফি প্রতিজ্ঞা করলো,বড় হয়ে প্রথমে সে মাতবরকে খুন করবে।
ফাঁস দিয়ে মরা লাশ, জানাযা দেয়া যাবে না। কেউ ছুঁতেও এল না। মালেক একাই মাটিচাপা দিল। মানুষটা ১০ বছরে কত মূর্দার জানাযা পড়েছিল,অথচ তার বেলায় কেউ নেই!
নাফি আসতে চেয়েছিল, ওর মা আসতে দেয়নি।ঘরে বেধে রেখেছে। ছোট হবার খুব জ্বালা! নাফি শেষবারের মত পরী আফার সুন্দর মুখটা দেখতে পেল না।
আশেপাশের গ্রামেও মালেক পাগল বেশ পরিচিত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, সাথে সবসময় পাক কোরআন রাখে।
পরিচিত-অপরিচিত সব মানুষের হাত ধরে ভদ্রভাবে বলে,"বিশ্বাস করেন, ইমাম সাব খারাপ কাম করে নাই। টেকার লুভ বিরাট লুভ গো, আমি বুঝবার পারি নাই। আমি নামাজ পড়ি,এই যে দেহেন পাক কালাম ছাইনা কইতাছি, আমার আল্লা নবীর কিরা, ইমাম সাব খারাপ কাম করে নাই।মালেক টেকা চায় না, চায় আপনের বিশ্বাস।"
ওর কথা কেউ বিশ্বাস করে না। পাগলের কথা বিশ্বাস করার কি আছে?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:১৯