১....
"আম্মা, তুমার না জ্বর।পাক ঘরে কি কর? আব্বায় তো রাইতে ভাত খায় না, আমারও খিদা নাই। তুমি রানবার আইছ কেন?"
নাজমা বেগম কিছুই বলেন না। মনোযোগ দিয়ে ভর্তা মাখছেন, রসুন ভর্তা, কালোজিরা ভর্তা,টাকি মাছ ভর্তা,কুচো চিংড়ি ভর্তা, টক নাইল্যা পাতা ভর্তা,কচু পাতা ভর্তা,ডিম ভর্তা আর শুকনো নাইল্যা পাতা ভাজি। ঘরে সরিষার তেল নাই এক ফোটা, তেল ছাড়া ভর্তা কেমন লাগবে কে জানে?
নাফির বাবা চর কালীবাড়ির চেয়ারম্যান, মাহবুব আলম চৌধুরি। এবাড়ি এখন কেবল নামেই চৌধুরি বাড়ি, আগের জৌলুশ আর নেই। চেয়ারম্যান হয়েই কত কি করা যায়!মাহবুব আলম এই নিয়ে দুইবার চেয়ারম্যান হল, তার উন্নতি হয় না। এবার নির্বাচন করার সময় পাটগুদামের কাছে ১০ কাঠা জমিও বন্ধক রাখা হয়েছে।
লোকটার সব দিকে খেয়াল, কার ঘরে চাল নেই, কে অসুস্থ, কার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কাদের মধ্যে বিবাদ; সব তিনি তুড়িতে সমাধান করে দিবেন। কেবল নিজের পরিবারের খোঁজ নিতে পারেন না। ছেলের বয়স ১০ বছর, তাকে এখনো মুসলমানি করানো হয় নাই! নাজমা বেগমের ভীষণ জ্বর, উনি জানেন না। উনি নাজমাকে নানা পদের ভর্তা করতে বললেন। গতকাল রাতে নাজমার ডিমপাড়া দুইটা মুরগি ধরে নিয়ে গেছেন, ঐ ডিম থেকে নাফিকে একটা খাওয়াতেন আর বাকিগুলো হাটের দিন বিক্রি করে টাকা জমাতেন। নাফি মাংস,ডিম পছন্দ করে, এখন কি হবে তিনি ভেবে পান না!
নাফি মায়ের গায়ে হাত রেখে অবাক হয়।
"ঐ আম্মা, জ্বরে তর শইল তো পুইড়া গেল।"
"যা তো বাজান, ঘরতে কাচের বাডি আন।ছেনাগুলান তুইলা দেই,ডাকবাংলায় দিয়া আয়। তর বাজান কহন আয়ে ঠিক নাই। ঠাণ্ডা অইলে ছেনা-ভাতে স্বাদ নাই।"
নাফি মায়ের কথায় রেগে গেল। রাগারই কথা, ওর হাসান ভাইয়া এই জ্বরেই হুট করে মারা গেল।
সেদিন রাতে নাফি আর ওর ভাইয়া শুয়ে ছিল। ভাইয়া প্রতিদিন রাতে একটা গল্প বলে। সেদিন বলল না। ভাইয়ার গলা কেমন হয়ে গেল, ফ্যাশফ্যাশে গলায় কথা বললো।
"বাবু, আজকে ভালা লাগতাছে না। মাথা কেমুন করে, আমার জ্বর। আমার মাতাত পানি দিয়া দিবি?"
"আগে একটা কিসসা কও, পরে মাতায় পানি দিবনে।"
"বাবুরে, আমার গা ছুইয়া দেখ, জ্বরে পুইড়া গেলাম। একটু পানি আন, যা ভাইয়া।"
"আমি পাড়তাম না, আম্মারে ডাক পাড়ি।"
"থাক বাবু, লাগতো না। আম্মায় ঘুমাক, আম্মা একবার জাগলে আর ঘুমাইতে পারে না।"
সকালে দেখা গেল হাসান মারা গেছে।এর পর থেকে জ্বর মানেই, নাফির কাছে গা পুড়ে যাওয়া জ্বর।আর মাথায় পানি না দিলে সে মারা যাবে, এটা ওর বিশ্বাস।
"তুইয়ো কি ভাইয়ার মত মরবার চাস নাকি? কলপাড়ে ল, তর মাতায় পানি দিয়া দেই।"
নাজমা ছেলের কথায় কান দিলেন না, বটিতে ভর্তা সাজাতে লাগলেন।
এইসব ভর্তা যাবে শম্ভুগঞ্জ ডাকবাংলোয়, সেখানে স্বাস্থ্য সচিব জনাব মিযান তার পুরো পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। এখানে থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ দেখবেন, বিলে বক-কালেম শিকার করবেন, পরে যাবেন বিরিশিরি। আসলে পুরো পরিবার বিরিশিরি যাবার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে ছিল, কিন্তু বড় মেয়ে নীলা বেঁকে বসল সে ব্রহ্মপুত্র দেখবে।ভরা মৌসুমে যৌবনপ্রাপ্ত নদের রূপ কে এড়িয়ে যেতে পারে? মেয়েটাও সে রূপের প্রেমে পড়েছে।
নাফি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"আম্মা, আমরা এত্তগুলা ছেনা দিমু হেরা কি বদলে আংগরে মুরগির ছালুন দিবনি?তাইলে রাইতে ভাত খামু!"
নাজমা বেগম হাসেন।
"বাজান,তুই বড় ছুছা! খাওন দিলেই খাইতে বসিস না, শরম! তগেরে উচ্চ বংশ, বংশের মান রাহিস।"
২....
নাফি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। কয়টা বাজে কে জানে? ও একা একা বাড়ি ফিরতে পারবে না। পথে যে গহীম জংগলটা পড়ে ওতে শকসো থাকে, তার চেয়েও ভয়ংকর হল পরী!এরা সুন্দর ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়। নাফির চেহারা ছবি মাশাল্লাহ, এইজন্য নাজমা বেগম পইপই করে বলে দিয়েছেন সে যাতে একা না ফিরে।
নাফির বাবার খবর নাই, সে সাহেবের বড় মাইয়ার পিছনে লেগে আছে। সাহেবের বড় মেয়েটা পাগল কিসিমের, একদিকে চেয়ে চুপ করে বসে থাকে, মুবাইলে একটু কথা বলে অনেকক্ষণ কাঁদে। মাহবুব চৌধুরীর ধারণা মেয়েটা একটা অঘটন ঘটাবে। তবে তিনি তা ঘটতে দেবেন না, এই গ্রামেতো অবশ্যই না। গ্রামে তার একটা সম্মান আছে না!
কৃষ্ণপক্ষ চলছে, পাড়াগাঁয়ে নিশুতি রাত। এমন রাতে অতিরূপবতী কেউ রেল লাইন ধরে হেটে যাচ্ছে, এটা গাঁয়ে একদম নতুন। ময়লাকান্দা আসতেই নীলার পিছু নিল তিনটা ছেলের একটা দল। কিছুদূর আসার পর তারা হুট করে পিছুপিছু আসা বন্ধ করে দিল। তবে পেছনে আগুনের বিন্দুটা আসছেই। নীলা নিশ্চিত হল, এই আগুনের বিন্দুটা শুরু থেকেই ওর পিছুপিছু আসছে। আর তাকে দেখেই ছেলের দলটা চলে গেল।
নীলা কিছুটা এগিয়ে রেল ব্রিজের উপর দাঁড়ালো। আলোর বিন্দুটা একটু দূরেই থেমে গেল। নীলা ব্রিজের রেলিঙে হাত দিয়ে দাঁড়াতেই আলোর বিন্দুটা দ্রুত এগিয়ে এল।
"মায়াগো, আপনের পায়ে ধরি পিছায়া আসেন। পিছায়া আসেন, আল্লার দোহাই লাগে এই কাম করবেন না।"
"আমি কিছুই করছি না, আপনি কে বলুনতো?"
"আমি মাহবুব চেয়ারম্যান, সহালে আপনের বাপের লগে আমারে দেখছুইন।পিছায়া আসেন, মায়া। ভরা নদীত পরলে আর বাঁচন নাই।"
"আপনি সকাল থেকেই আমার পিছন পিছনে লেগেই আছেন, কেন? আমি কুড়পাড়ে বসে রইলাম, আপনি দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন;আমি বড় বটগাছটার নিচে বসে ছিলাম তখন ধান ক্ষেতের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন, নদীর পাড়ে গেলাম যখন তখনও পিছু ছাড়লেন না? আপনি কাধের ফেরেশতার মত পিছু লেগে আছেন। ভাবলাম রাতে আমাকে ছেড়ে দিবেন, রাতেও পিছু নিলেন।কেন?"
"মায়া, আপনে খুব ঠাহর কইরা চলেন। মায়া, বাইতে চলেন। এগুলা নিয়া আমরা পরে কতা কমুনে।"
"আপনি চলে যান, আমি আর বাড়ি ফিরবো না।"
"আরেকজনের জইন্যে নিজের কষ্ট দিয়া, মইরা গিয়া লাভ কি? সে তো আপনেরে ভুইলা গেছে।"
"আপনি জানলেন কিভাবে?"
"মায়া, নিজগুনে ক্ষমা দিবেন। আমি লুকাইয়া লুকাইয়া হুনছি......."
মাহবুব চৌধুরী কথা শেষ করতে পারলেন না।পানিতে টুপ করে শব্দ হল। মাহবুব চৌধুরী একটু পর পানিতে লাফ দিলেন, একটু কষ্ট করুক!মরার সময় সবাই বাঁচার গুরুত্ব বুঝতে পারে, তখন বাঁচতে চায়। তিনি আস্তেধীরে বিড়ি শেষ করে পানিতে ঝাঁপ দিলেন।
মাহবুব চৌধুরী নীলাকে পাড়ে আনলেন। নীলার চোখ বন্ধ, আহারে!কি সুন্দর মুখ। আল্লাহ নিখুঁতভাবে কিছুই তৈরি করেন না, একটা খুত দিয়ে দেন!
ডাকবাংলা এতক্ষণ শান্ত ছিল,হুট করে চেঁচামিচি শুরু হল। বাড়ির বড় মেয়েকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকাবাসী হইচই করে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো।
পুব দিকে রাস্তায় মাহবুব চৌধুরী আর নীলাকে পাওয়া গেল। লোকজন দেখামাত্রই তিনি কথা বললেন,"সাহেবের মাইয়াটা অতি বুকা, একা একা নদীত নৌকা বাইতে গিয়া নদীত পইরা গেছে। আল্লার কি রহমত আমিও ঐ পথেই যাইতাছিলাম, চিৎকার হুইন্না পানিততে তুইল্লা আনছি।"
নীলা অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা চোখের পলক না ফেলে মিথ্যা বলে গেল।
ডাকবাংলায় পৌঁছানোর পর সবাই একে একে চলে গেল।
তখন জনাব মিযান মাহবুব চৌধুরীর হাত ধরে বললেন,"চেয়ারম্যান সাহেব, আপনি আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছেন, সবার কাছে মিথ্যে বলে আমার সম্মান বাঁচিয়েছেন। এই টাকাটা রাখুন।"
মাহবুব চৌধুরী মাথা নিচু করে বললেন,"হায়াৎ-মউতের মালিক আল্লাহ, আমি উছিলা মাত্র। মাইয়াডারে তাড়াতাড়ি বিয়া দিয়া দেন, এই রুগের একমাত্র চিকিৎসা বিয়া। মাইয়া যারে ভালাবাসে হের কাছে বিয়া দেওয়াই ভালা।
আর টেকা দিয়া আমারে শরমিন্দা করবেন না। মেলা রাইত হইছে, আমি বাড়িত যাই।"
নাফি আর মাহবুব চৌধুরি বাড়ি ফিরছেন।
"আব্বা, টেকা নিলা না কেন? আম্মারে মুরগি,ছাগল কিইন্না দিবার পারতা"
"এইডা তুই বুঝবি না, আগে বড় হ।এই যে টেকা নিলাম না, এইডা বিরাট কাজে দিব।হেরা বড়লোক মানুষ, আমারে মনে রাখবো। বড়লোক মানুষের সাথে খাতির থাকন ভালা,হেরা হইল মাতার উপরে ছাতার মত। কহন দরকার লাগে কওন যায় না।"
পরদিন সকাল থেকেই গ্রামে জানাজানি হয়ে গেল, মাহবুব চেয়ারম্যান ঢাকাই সরকারি সাহেবের মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছে। এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে। মেয়েটা এই এলাকায় ডুবে মারা গেলে এলাকার বিরাট বদনাম হইত!
৩....
ঢাকা মেডিকেল গেটে কাছে বিরাট জটলা। ঘটনা অতি সাধারণ।
মাহবুব আলম ইন করে শার্ট পড়া এক লোককে জিজ্ঞেস করেছেন,"ভাইজান, আপনে কি হাসপাতালের দালাল? আমি খবর পাইছি, দালালরা এমুন ফিটবাবু হইয়াই থাহে। আমার কাছে লুকানির নাই, আমার পুলার অসুখ!আমাকে একটা সিট জুগার কইরা দিতে পারলে আপনের কিনা গুলাম হইয়া থাকমু।টেকা পয়সা কুন ব্যাপার না।আরও ফিরিতে একটা গুলাম পাইলেন।"
দেখা গেল, লোকটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর উপুল তালুকদার। এই নিয়েই ঝামেলা। প্রফেসার সাব এত রাগলেন, তাকে পুলিশে দিতে চাইলেন। লোকজন তাকে বাঁচালেন!
তবে তিনি দালালের সন্ধান থামালেন না। হাসপাতালে ভালো সিট পাওয়ার প্রধান উপায় হল "দালাল"। তাকে কে বোঝাবে, করোনা আসার পর সবাই উধাও!
নাজমা বেগম বারবার ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখছেন।
"ওই, ওই! নাফির বাপ, নাফির বাপ আমার কথা শুনেন। পোলায় কি এমনেই মইরা যাইবনি? সবাই কয় আমার পুলার করোনা হইছে। হইলে হইছে! লন, বাড়িত যাই। আমি পুলারে মরতে দিমু না। বাড়িত নিয়া কবরেজ দেহামু, মুন্সি দেহামু! ছানাছানি করলে আমগর রোগ হইলে হইব।লন, বাড়িত যাইগা।"
নাফির বাবার বিরাম নাই! তিনি হাসপাতাল গেটের এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়াচ্ছেন, যদি কোনভাবে একটা সিট পাওয়া যায়।টাকা কোন বিষয় না, গ্রামে গিয়া জমিন বিক্রি কইরা আনতে যতক্ষণ। উনি একে তাকে জিজ্ঞেস করছেন, লাভ হচ্ছে না।
গত ৩ দিনে এই এক চিত্র ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল গেটের সব দোকানদার দেখেছে, সাদা পাঞ্জাবি পড়া মিশমিশে কালো লোকটা ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য কত কিছুই করছেন। কোন ফন্দিই কাজে আসছে না।
ময়মনসিংহ ছোট শহর, হাসপাতাল কম। ঢাকা বড় শহর, অনেক হাসপাতাল। মাহবুব আলম ভেবেছিলেন, এখানে ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে পারবেন।সে আশার গুরে বালি!
লোকটা ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারে নাই।সিট খালি নাই, করোনা রোগিতে হাসপাতাল ভরা। ছেলের পেটের অসুখ।
নাফি বাবার হাত ধরে বারবার বলে,"আব্বা, তলপেডত বেদনা।"
তিনি ছেলেকে স্বান্তনা দেন,"আগই কইছিলাম, দুফুরবেলা চাইল ভাজা বাইরে হাইট্টা হাইট্টা খাইস না। আমার কতা হুনবি না। এখন বুঝ, তর বাতাস লাগছে।খারাপ বাতাস! পেডত নাড়ি প্যাঁচাইয়া গেছে। অহন ডাক্তারই ভরশা।চিন্তা নাই। একটা ব্যবস্থা করবই। তুই বেটা কি আউল ফাউল মাইনশের পুলানি? তুই চেয়ারম্যানের পুত, তর বাপেরে স্বাইস্থ সচিবে চিনে, তগেরে বাড়িত গিয়া থাইকা আসছে। চিন্তা নাই! বাইতে লোক পাঠাইছি, মিযান সাবের নাম্বার নিয়া আইব। আমার মাথার ঠিক নাই, নম্বর খাতায় লিইখা থুইছি। এখন খাতা পাইলে অয়!
তর চিন্তা নাই, তুই ঘুমা।"
পরিষ্কার সাদা পাঞ্জাবি গায়ে মিশমিশে কালো লোকটা স্ত্রীর কাছে এসে কথা বলেন না। স্ত্রীর গালে চড় দেন।
"মাগী কয় কি!পোলা মরব!পোলা মরব! তরে না কইলাম তুই বাড়িত যা। গেলি না কেন?মরা ছাড়া মাগির মুহে কতাই নাই!"
নাজমা বেগমকে দোষ দিয়ে লাভ কি?
মানব দেহে সকল বস্তুরই একটা সীমা আছে। মাতৃস্নেহও অসীম নয়, সন্তানের শরীর যখন ঠান্ডা হয়ে আসে, নিঃশ্বাস থেমে যায়; মাও তখন সন্তানের কাছে থাকতে চায় না।ভূতের ভয় পায়!
নাজমা বেগমের মৃত্যু নিয়ে এমনেও কোন আবেগ নাই, হাসান মারা যাবার পর সব চোখের পানিতে ধুয়ে গেছে।
তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে শহীদ মিনারের বেদিতে যান, যেন কিছুই হয় নাই।উনার সাদা পাঞ্জাবীর কোণা ছেলের লালা পরে ভিজে গেছে, সেদিকে খেয়াল নেই।তিনি ছেলের পায়ের তলায় ঘষা দেন, মুখে মুখ লাগিয়ে দম দেন, বুকে চাপ দেন। ছেলে চোখ খুলে, কথা বলে না।
মাহবুব চৌধুরি আশাহত হন না। কথা বলতে থাকেন,"বাপজান আর কিছুক্ষণ দম ধইরা রাখ। কামরুল বাইতে গেছে, এইযে আইলো বইলা। মিযান সাবরে কল দেয়ার লগে লগে দেখবি তরে নিয়া ডাক্তারেরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করবো, সিট তো দিবই।এইহানে চিকিৎসা না হইলে সিংগাপুর নিয়া যাইব।আমি কি যেই সেই লুক নাকি? আমার লগে স্বাইস্থ সচিবের বিরাট খাতির! হের মাইয়ার জীবন আমি বাঁচাইছি,টেকা লই নাই!আংগর বাড়িতে কত আদর যত্ন করছি।হেয় নিজে কইছে, বিপদে পরলে ফুন দিতে।"
কামরুল বিকেলের আগেই ফিরে আসে। মাহবুব চৌধুরি দ্রুত কল দেন।
"ছালাম, সচিব সাব......"
"আমি ব্যস্ত আছি, পরে কল দিন।"
তিনি হতাশ হন না। সবাইকে বলেন,"আমার আপনা লুক, আমার নাম্বার হের কাছে আছে। দেখবাইন একটু পরেই কল দিব।"
কতক্ষণ যায়, কে জানে? মিযান সাহেব কল দেন না।
মাহবুব চৌধুরি আবার কল দেন।
"স্যার, চিনবার পারছেন? আমি মাহবুব, মাহবুব চৌধুরি! শম্ভুগঞ্জ চর কালীবাড়ির চিয়ারম্যান।"
"চিনতে পারছি না, কেন বারবার বিরক্ত করছেন?"
মিযান সাহেব কল কেটে দেন।
নাফি জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে,"আব্বা, চিনবার পারলো এইবার?"
মাহবুব চৌধুরি ছেলেকে উত্তর দেন নাল। উনার রাগ হয় না, মন খারাপও হয় না।
উনারা বড় মানুষ, কত লোকের সাথে দেখা হয়। সবার কথা কি আর মনে থাকে? তিনি আবার কল দেন।
"স্যার, আমি মাহবুব। আপনে আংগর বাড়ির পিছে বইসা মাছ ধরলেন।আমি আপনার মেয়ে নীলার জীবন বাঁচাইছি, ও নদীতে ঝাঁপ দিছিল। মনে পরছে? আপনে আমারে এইজইন্যে টেকা দিছিলেন, আমি লই নাই!"
ওপাশ থেকে কথা শোনা যায় না।মাহবুব চৌধুরির ধৈর্য টেকে না, তিনি কথা বলেই যান।
"স্যার গো, দয়া কইরা মনে করুইন। আমার পুলার বিরাট অসুখ, পেডত বেদনা। আমার পুলা সকালতে কতা কইতে পারে না।মেডিকেলে ভর্তি লয় না, একটা ব্যবস্তা কইরা দেইন।আপনেগর তো মেলা ক্ষেমতা! আমিতো আপনের কাছে টেকা চাইনা, পুলাডারে ডাক্তার দেহানের ব্যবস্তা কইরা দেন। হেরা করোনা করোনা কইরা রুগি দেহে না, ভর্তি লয় না।স্যার....."
উনি কথা শেষ করতে পারেন না। ওপাশ থেকে লাইন কেটে যায়।
নাজমা জিজ্ঞেস করে,"চিনলো? চিনলো আপনেরে? পুলায় মেডিকেলে ভর্তি হইব? কোন ব্যবস্তা করবো,কি বলছে?"
মাহবুব চৌধুরি পাঞ্জাবির হাত দিয়ে চোখ মুছেন। নাফিকে কোলে তুলে নেন।
"লও নাজমা, বাইত যাই। ইটা-পাত্ততের এই শহরে মাইশ্যের মনডাও পাত্তরের মতই শক্ত,দয়া-মায়া নাই। এত কিছু কইলাম, আর হেয় চিনবার পারল না!"
এ শহর কত পরাজিত বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, কে জানে?
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:২৩