১...
"তিনডা মাইয়া আমার লাইগা অইছে? মূর্খ, পোলা মাইয়া অওয়া মরদের উপ্রে থাহে। তুইতো বকলম! এগুলার কি বুঝবি?"
"সাবিনা, খোদার কসম ঘরে চল। রাস্তার মদ্যে ঝামেলা করিস না। ফলাফল ভালা অইত না।"
"কি করবি তুই? আমার জীবনতো আগেই নষ্ট করছস। অহন তালাক দিবি? তুই কি তালাক দিবি, মিথ্যুক! আমি তোরে তালাক দিলাম, তালাক, তালাক, তালাক।"
ঘটনা ততক্ষণে জমে গেছে, মানুষজন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
লোকটা মেয়েটার চুলের মুঠি ধরলো। আমার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। সভ্য হওয়া, আর পড়াশোনা করার এক সমস্যা, যা ইচ্ছে তা করতে পারবেন না। আমি চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম।
এলাকার মস্তান টাইপের ছেলেটা এগিয়ে এল।লোকটাকে হ্যাচকা টানে দূরে নিয়ে গেল।
"ও আমার বৌ।"
"তাতে কি? তর বৌ দেখে রাস্তায় সিনেমা করবি?যাহ ভাগ। আর শুনলি না, তরে তালাক দিল। বইন তুমি খাড়াইয়া রইছ ক্যা? যাও যাও, ফ্যাচফ্যাচানি ভালো লাগে না।"
মেয়েটা তিনটি শিশুকন্যা নিয়ে চলে গেল। আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এই বেয়ারা ছেলেটার মধ্যে কি আছে, যা আশেপাশের আর কারও মধ্যে ছিল না?
২....
কাঁচাবাজার জ্যামে অটোতে বসে আছি। আমার পাশে বেশ স্বাস্থ্যবতী একজন মহিলা বসে আছেন, তার কোলে প্রায় গোল একটা বেবি। আমার উল্টোদিকে মেয়েটা বসে আছে। ছোট, কতই বয়স হবে ১২/১৩ বছর।
মহিলা বললেন,",সারাদিন কি করিস?"
"পড়ি, স্কুলে যাই, আর আম্মাতো অফিসে কাজ করে তাই রাইতের রান্না আমিই করি।"
"আরওতো সময় থাকে, তখন কি করিস।"
"কিছুই না, বইসা থাকি, বই পড়ি, জামাত নকশা করি।"
"মাঝেমধ্যে এই আন্টির কাছে আসলেও তো পারিস।"
মেয়েটা কথা না বলে হাসলো। খুবই আগ্রহ নিয়ে বললো," আন্টি, জানেন, আমি ফ্রিতে স্কুলে পড়ি! আবার উপবৃত্তিও পাই, মাসে ৩০০ টেকা। এবার আমার রোল ১ হইছে।ম্যাডামে কয়, আমার মাথা ভালো!"
"শোন রুমানা, তুই যদি আমার বাসায় প্রতিদিন আসিস আমি তোকে ১০০০ টাকা দিব। আর স্কুলে না গেলে কিছু হয় না। বাসাতেও পড়াশোনা করা যায়।"
রুমানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,"কিন্তু আমারতো মাস্টার নেওয়ার টেকা নাই, ক্লাসে পড়া বুইঝা নেই। আমার স্কুলে যাওয়া লাগে।"
"এই যে কোভিডে স্কুল বন্ধ ছিল, তখন পড়িসনি?ঐভাবে পড়বি।যাহ, আমি তোকে ১২০০ টাকা দিব।তুই প্রতিদিন আসবি, আর এই বেবিটার সাথে খেলবি? আর কাজ নাই।আমি তোকে পড়াব।আচ্ছা?"
মহিলার কল আসায় উনি কথা বলতে লাগলেন।
আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,"রুমানা, পড়াশোনা করে কি করতে চাও?"
মেয়েটা হকচকিয়ে গেল।নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,"আম্মায় পড়াশোনার জন্যে মেলা কষ্ট করে।আমি ব্যাংকে চাকরি করমু, আম্মার আর কষ্ট থাকব না।"
"তাহলে এখনি অটো থেকে নেমে এক দৌড়ে বাসায় চলে যাও। তোমার আন্টির বাসায় গেলে তোমার আর পড়াশোনা হবে না। তোমার আন্টি বাঁচ্চা রাখার জন্য কাজের লোক হিসেবে তোমায় নিচ্ছেন।"
মেয়েটি আমার দিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর দৌড়ে চলে গেল।
উনি কল কেটে ডাকলেন, রুমানা!রুমানা!
আমাকে বললেন," আপনি ওকে কি বললেন?"
"আমি জিজ্ঞেস করেছি, ওর পায়ে জুতা নেই কেন?ও হয়তো জুতা আনতে চলে গেছে।"
"আপনিতো জানেন না, একটা কাজের লোক পাওয়া কি যে ঝামেলা! এখন ও একবার রাজি হলে হয়।"
৩....
বাসে ভাড়া না দেয়াটা একটা আর্ট!আর এই আর্ট অনেকদিন চর্চা করতে হয়(আমার ধারণা)। মানুষজন আমার সাথে বাসে উঠে, পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সুন্দর করে বলে,"ভাড়া দিলাম না, কয়বার দিব!" আমি তাকিয়ে থাকি, তারা এতটুকু সংকোচবোধ করেন না। দেখতে ভদ্র, ভালো পোশাক পরা লোককেও দেখেছি এইকাজ করতে। আমিও চেষ্টা করবো, তাই মুটামুটি স্টাডি করেছিলাম। ফলাফল এরকম
• বাসের শেষের দিকে চলে যেতে হবে।
• মুখ বিরক্ত করে রাখা জরুরি। অনেকক্ষণ জ্যামে দাঁড়িয়ে থেকে আপনি ত্যক্তবিরক্ত এমন ভাব আনতে হবে।
• বসে থাকলে ঘুমের ভান করতে হবে। ঘুমিয়ে গেছেন মানে আপনি অনেকক্ষন আগে বাসে চড়েছেন।
• দৃঢ়ভাবে বলতে হবে,"ভাড়াতো দিলাম, কয়বার নিবা?" আরও জোরালোভাবে বলতে হবে,"কিছুই মনে রাখতে পার না তো হেলপার হইছ কেন? ভাড়া দেন, ভাড়া দেন! এই ঘ্যান ঘ্যানঘ্যান আর করবা না।"
এগুলা করতেই পারলেই কেল্লাফতে। আমি এখনো মাঠে প্রয়োগ করিনি!
৪....
আজ রাত ৮ টা। টিউশনি থেকে ফিরছিলাম।
ঘুটঘুটে অন্ধকার, উত্তরখান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গেটের সামনে একটা উজ্জ্বল আগুনের ফুলকি জ্বলছে নিভছে।
আমি গেটের সামনে আসতেই আলোটা আমার দিকে এগিয়ে এলো।
ছেলেটা আমার চেয়ে খাটোই হবে। আমার মুখে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে সিগারেটটা মাটিতে পিষে দিল।
"বাই, মুবাইলডা দেন একটা কল করমু। আমার মুবাইলে টেকা শেষ।"
ছেলেটার কণ্ঠটাও কিশোরদের মত। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি ফ্লাশ জ্বাললাম। একজন না, তিনজন ছেলে। দুইজনের হাতে ক্ষুর। ছেলেটা মোবাইলটা নিচে নামিয়ে দিল।
"বাই, প্রবলেন চাই না। মুবাইল, ঘড়ি, মানিব্যাগ দিয়া যানগা।"
ডানপাশের জন কাঁপা গলায় হুমকি দিল,"চিল্লাইলে পেডে পোছ দিমু।"
"শোনো ছেলে, আমি তোমার নাম জানি না। তোমার বাবার নাম মীর হোসেন। তুমি যেদিন জন্ম নিয়েছিলে আমি তখন কলেজে পড়ি। তোমার টয়লেটের রাস্তা ছিল না, অপারেশনে বেশ রক্তক্ষরণ হয়।আম্মা তোমাকে রক্ত দিয়েছিলেন। আমার আব্বার নাম সাত্তার চিনতে পেরেছ, আমরা পাশাপাশি ভাড়া থাকতাম?"
"না, মনে নাই।"
"তোমরাতো স্থানীয় মানুষ। তুমি এগুলো করছ কেন?"
"আব্বু কোভিডে মইরা গেছে। চাচারা কিছুই দেয় নাই, বাড়িত্তে বের করে দিছে। আম্মু কিছুই করতে পারে না, হারাদিন একদিগে তাকায় থাহে।"
আবার ডানপাশের জন, খেঁকিয়ে উঠলো,"বাই, আপকে যানগা। অত কতার দরকার কি?"
ছেলেটা রেগে বললো,"কতা কইতাছি তুই চিল্লাস ক্যান?"
"কতা কইয়া লাভ কি? হেয় তরে টেহা দিব? মাইনশেরে দুক্কের কতা কইয়া কুন লাভ নাই।"
৫....
তখন কঠোর লকডাউন। মিঠুন আংকেল কল দিলেন।
"স্যার, একদিন আমাদের এখানে আসেন একদিন। একটা কুকুরের বাচ্চা বয়ামে মুখ ঠুকিয়ে বের করতে পারছে না। কিছুই খেতে পারে না। আসুন, দুইজনে মিলে ধরে বয়াম ছুটিয়ে দিই।"
"আংকেল, এমনে এমনেই ছুটে যাবে। আপনার চিন্তা কি?"
"আমার রাতে ঘুম হয় না, আসুন না।"
আন্টি রাগে গজগজ করছেন,"কেন এগুলা করা লাগবে, কুকুরের খামচা লাগলে জলাতঙ্ক, লোম পেটে গেলে ডিপথেরিয়া। এগুলা করার দরকার নাই।স্যার, আপনি আসবেন না।"
আংকেল একাই নাকি ছানাটাকে ধরে বয়াম খুলে দিয়েছেন। আন্টিও স্বীকার করলেন, সেদিন রাতে তিনি ভালো ঘুমিয়েছেন!
ওদের বাসায় প্রতিদিন পড়াতে যাই এই বজ্জাত কুকুর আমাকে আর আন্টিকে দেখলেই কেবল ঘেউঘেউ করে। তবে কাছে আসে না। আমিও ইট দিয়ে মারতে যাই!
আজকের ঘটনা বলছি।আজকে যখন আংকেল সন্ধ্যায় বাসায় নাস্তা খেতে আসছেন। এই কুকুর আংকেলকে কিছুতেই রাস্তা দিয়ে যেতে দিচ্ছে না। আংকেল যেদিকেই যান সেদিকেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। আংকেল যখন রেগে ইট নিলেন। তখন ঘেউঘেউ শুরু করলো কামড়াতে এলো। কিন্তু কিছুতেই যেতে দিচ্ছিল না।
আংকেল কি ভেবে ফোনের ফ্লাশ জ্বাললেন। দেখলেন একটু দূরেই শাপ-বেজি জড়াজড়ি করে পরে আছে!
পাশেই ফাঁকা জমিতে আংকেল বাসার কাজের জন্য ইট,বালু, সিমেন্ট প্রায় ৪ বছর ধরে ফেলে রেখেছেন। আমি আর আন্টি ভাবছিলাম, আমরা সেখানে থাকলে কি কুকুরটা আমাদের পথ আটকাতো?
৬....
আমাদের বিল্ডিংয়ের সিড়িতে একটা ছাই রঙের বিড়াল থাকে।
অনেক চেষ্টা করছি ওর সাথে ভাব করার জন্য, লাভ হচ্ছে না। বাসার যে কেউ খাবার দিলে খায়, আমি দিলে খায় না।
আমার জুতোয় শিশু করে দেয়(আমরা দেখিনি পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি দেখেছেন)। এইজন্য জুতো বাইরে রাখা যায় না!
আমি বিড়ালটাকে কিছুই করিনি, একদিন একটা জব্বর কিক দিয়েছিলাম আরকি!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২২ রাত ১১:৪০