সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত বিষয় এখন জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি প্রসংগ। পেট্রলের নতুন দাম ১৩০ টাকা, যা এত দিন ৮৬ টাকা ছিল, ডিজেলের দাম ১১৪ টাকা লিটার, যা এত দিন ৮০ টাকা ছিল আর অকটেনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৪৬ টাকা। এত দিন অকটেন ৮৯ টাকা লিটার বিক্রি হতো। অর্থাৎ পেট্রলের, ডিজেলের এবং অকটেনের দাম বেড়েছে লিটারে যথাক্রমে ৪৪ টাকা, ৩৪ টাকা এবং ৪৬ টাকা ।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি মন্ত্রণালয়ের প্রণিত কোন আইনের তোয়াক্কা না করে, একেবারে রাতারাতি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইনের ২২ ও ৩৪ ধারামতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির একক এখতিয়ার বিইআরসির। ৩৪ (৬) ধারামতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব অবশ্যই বিইআরসির কাছে পেশ করতে হবে। ৩৪ (৪) ধারামতে স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষদের শুনানি দেওয়ার পর বিইআরসি মূল্য নির্ধারণ করবে। এই যে কোন আইনের তোয়াক্কা না করে যে একেবারে রাতারাতি মুল্যবৃদ্ধির মত মারাত্মক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এতে হতবিহবল এ জাতি পড়ে গেছে পুরাই বিপদে।
আসুন জানা অজানা কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে নেওয়া যাক আজকে
ইস্যু ১ - আসলেই কি মূল্য বৃদ্ধি অস্বাভাবিক, তা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।
তর্কের খাতিরেই কিনা স্বীকার করেই নিতে হচ্ছে যে নন রিনিউয়েবল এনার্জি তথা অনবায়নযোগ্য শক্তি যেমন তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি সময়ের সাথে সাথে নি:শেষ হতে থাকবে, এটা বিজ্ঞানীদের শত বর্ষেরও আগের প্রেডিকশন। এর বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তি তথা সোলার এনার্জি, উইন্ড এনার্জি, ওয়াটার অয়েভ দ্বারা সৃষ্ট এনার্জি ইত্যাদি বহু আগে থেকেই প্রস্তাবিত। তবু মানুষের স্বভাব বরাবরই যেন "যতদিন আছে চলুক, শেষ হয়ে গেলে অন্য চিন্তা করবো নে"। যদিও এই শক্তির উৎসসমূহ থেকে শক্তির আধার পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে বাড়াবাড়ি রকমের অপচয় হয়, তবে শক্তি যদি সত্যি নিঃশেষ হওয়ার পথে থাকে, এর ফল শুধু পশ্চিমা দেশগুলোই না, পুরো পৃথিবীর সব দেশের সকল নাগরিক উপলব্ধি করবে । তবে আমাদের দেশে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ধীরে ধীরে বাড়ানো যেতো কিন্তু রাতারাতি করাটা নি:সন্দেহে সমার্থনযোগ্য নয়। (উপরের কথাগুলো শুনে প্লিজ ভাববেন না এই অস্বাভাবিক এবং রাতারাতি জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি কে কোনভাবে আমি জাস্টিফাই করছি)
ইস্যু ২- আইএমএফ এর শর্ত মেনে কি এই মূল্যবৃদ্ধি?
নি:সন্দেহে। আসুন আপনাদের কাছে হিসাবটা একেবারে পরিস্কার করে দেই । এখানে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আইএমএফ এমন একটা শর্ত (জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে) দিল কেন? উত্তর: সরকার ভর্তুকি দেয় জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে। সকল শ্রেণির মানুষ যারা কিনা তেল ব্যবহার কম করে তারাও টাকা দিয়ে এই ভর্তুকি দেয়। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় যারা বেশি পরিমান তেল খরচ করে তারা খরচের পরিমান কমাচ্ছে না, সুতরাং সরকারের ভর্তুকির পরিমান বাড়ছে, আর সকল জনগন মিলে ভর্তুকির টাকা পে করছে। সুতরাং এখন থেকে কোন ভর্তুকি নয়, যার যার ভর্তুকি সে সে দিবে। Pay as you go (যত ব্যবহার তত ব্যয়) নিশ্চিত করতেই এই শর্ত। তাহলে তো আরেকটা প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক, সব জনগণ ভর্তুকি দিতে চাইলে আইএমএফ এর সমস্যা হল কেন? এটার উত্তরঃ আইএমএফ যখন ঋণ দিবে তখন ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে কি না, তাও দেখবে। আবার কি করলে ঐ দেশ ঋণ পরিশোধ করতে পারবে তাও শর্ত হিসেবে দিবে। তো আইএমএফ এর হিসেব মতে বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু জনগণের তেল ব্যবহারের জেরেই ভেঙে পড়তে পারে, কারণ এখানে দীর্ঘদিন ধরে অযৌক্তিক ভর্তুকি দিয়ে দিয়ে তেলের ব্যবহার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আগে ভর্তুকির পরিমান কম ছিল সরকার সহজেই বহন করতে পারছে কিন্তু এখন বহন করতে রিজার্ভে হাত দিতে হচ্ছে। সরকার অধিক পরিমানে ভর্তুকি দিতে থাকলে দেশের রিজার্ভের পরিমান কমতে থাকবে। আর রিজার্ভের পরিমান কমতে থাকলে টাকার মান কমতে থাকবে, সম্পত্তির মূল্য কমতে থাকবে, দেশ দেউলিয়ার পথে হাটতে থাকবে। আইএমএফ এর ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না!
ইস্যু ৩ - জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ কি কি?
হয়তো অবাক হচ্ছেন, এখানে আবার সুবিধা কি হতে পারে। জ্বী, হ্যা, অবশ্যই পারে। যেমন:
ক) জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ ব্যক্তিগত যান কম ব্যবহার করে গণপরিবহনমূখি হলে রাস্তায় যানজট কমবে
খ) অনেকে আবার সাইকেল চালানো কিংবা হাটা শুরু করবেন। এতে স্বাস্থ্যের মংগলের কথা নতুন করে আর কই বলবো
গ) তেলবাজ একটি জাতির এবার যদি তেলবাজিটা কিছুটা হলে কমে
ঘ) মানুষের মধ্যে মিতব্যয়ীতা (কিপ্টেমি ভেবে বসবেন না) বাড়বে ইত্যাদি
এই সুবিধার ৪টি পয়েন্টই আমার ব্যক্তিগত ধারনা থেকে বলছি আর অসুবিধা, সে আমি আর নতুন করে না বলি, এগুলা সবার জানা । তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করতে পারি, সকল গনপরিবহনের ভাড়া আবারও লাগামছাড়া হতে যাচ্ছে বা অলরেডি হয়ে গেছে । আর ঢাকা শহরে ভিক্ষুকের পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়বে ।
ইস্যু ৪ – বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি কি আমাদের দেশে জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধির পিছনে অন্যতম কারণ?
উত্তরঃ নীতিনির্ধারক মহল থেকে বলা হচ্ছে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারনে দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তিনদিন আগে রয়টার্সের রিপোর্টে বলা হয়, ‘বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। গত জুলাই মাসে বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন ও জাপানে শিল্পোৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে তেলের চাহিদা কমেছে।’ বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং ইকোনমিকসের হিসাবে গত ১লা আগষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ডাব্লিউটিআই অপরিশোধিত (ক্রুড) তেলের দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমে প্রতি ব্যারেল হয় ৯৩.৩০ ডলার। এর পাশাপাশি লন্ডনের ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ৪ শতাংশ কমে প্রতি ব্যারেল হয় ১০০.১৫ ডলার। তাহলে বিশ্ববাজারে তো তেলের দাম কমছে । এক্ষেত্রে হিসাব তো মিলছে না ।
দেশের বর্তমান অবস্থা অনেক রাজনৈতিক বোদ্ধার অনেক আগের প্রেডিকশন। ক্ষমতা নিয়ে কিছু বলবো না। সেই ইস্যু নিয়ে বহু আগেই প্রিয়জনদের অনুরোধে মুখে কলুপ এটেছি।
এই জাতির শিকড়ে পচন ধরেছে, আমার মত অধিকাংশই মুখে কলুপ আটতে পছন্দ করে কারণ আমাদেরকে পলিটিকালি সেইফ পজিশনে থাকা দরকার বলে আমরা বোধ করছি । এখানে চোখের সামনে অন্যায় করেও অনেকে পার পেয়ে যায় । আমরা শুরু থেকে চুপ থেকেই ধাপে ধাপে অন্যায়সমূহকে প্রশ্রয় দিয়ে অন্য অন্যায়সমূহের জন্ম দিয়েছি বা দিচ্ছি ।
আমি মনে করি কানাডার বেগমপাড়ার গর্বিত মালিকসমূহ এবং সুইস ব্যাংকের একাউন্ট ধারী বাংলাদেশীদের সাথে সাথে এ দেশে জন্ম নিতে পেরেছি, এটা ভেবেই আমাদের অহংকার করে যাওয়া উচিত, এসব জ্বালানী তেলের দাম বেড়ে যাওয়াটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে গেলেই কেবল আমাদের মত তেলবাজ জাতির উন্নতির ধারা অব্যাহত থাকবে...