somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বঃ যাও পাখি বলো তারে...

দ্বিতীয় পর্বঃ কাটে না সময় যখন আর কিছু তে, টুয়েন্টিনাইন খেলাতেও মন বসে না



ধান কাটা, মাড়াই হয়ে গিয়েছে। কিন্তুডিসেম্বর মাস হিসেবে আবহাওয়া বেশ খারাপ। গত কয়েক দিন হালকা বৃষ্টি হয়েছে। ধান ভালো মতো শুকানো যায় নি, ভেজা ভেজা রয়েছে। এই ধান ভালো দামে বিক্রি করা সম্ভব না। ধানের পরিমাণ অবশ্য খুব সামান্য, ৪০ মনের মতো।

মুহিব কে বললাম - ভাই এই ধান কি করে বিক্রি করব? কে এই ভেজা ধান কিনবে? মুহিব বলল - দুশ্চিন্তা করিও না, রাতের বেলা বেচে দিব। আমি বললাম না - এভাবে বেচা ঠিক হবে না । তোর বেশি কথা বলার দরকার নাই তুই আমার সাথে চল- বলে মুহিত আলচনা শেষ করলো । ( আমাদের মাঝে তুই-তুমি দুটাই চলে।) মোবাইলের যুগ শুরু হয়নি, বাবার সঙ্গে পরামর্শ করব সেই সুযোগ নেই।

গরুর গাড়িতে ধান চলে গেছে, বাই সাইকেলে করে দুই বন্ধুহাটের দিকে রওনা দেই। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে- রবি আর বৃহস্পতি বার। সেটা ছিল বৃহস্পতিবার । মুহিবের দোকানে প্রচন্ড ভিড়। ধান বেঁচার অভিজ্ঞতা আমার নেই, আর এই মুহূর্তে মুহিবের পক্ষে দোকান ছেড়ে আসা সম্ভব না। এর মাঝে কয়েকটা খারাপ মুখ এসে মুহিবের সাথে ফিসফিস করে গেল। বুঝলাম আজ মুহিব আবারো নেশার আড্ডায় বসবে।


গঞ্জের হাট, সব জায়গায় ইলেকট্রিসিটি নেই। বেশিরভাগ ছোটখাটো দোকানদাররা লন্ঠন বা কুপি জ্বালিয়ে কেনাবেচা করছে। বড় বড় কিছু দোকানদার আছে যারা হ্যাজাক লাইট ব্যবহার করেন। দু'চারজন অ্যাডভেঞ্চারাস লোক আছেন যারা বিদ্যুৎ এর খুঁটি থেকে তার দিয়ে কানেকশন বের করে বাল্ব জ্বালান।

একদিকে ঘোলা বাল্বের আলো, আর একদিকে বিরাট কুপি। মাঝখানে ধান কেনা বেচা চলছে। মুহিব আমাকে নিয়ে যায়। আমার ছটফটানি দেখে বুঝতে পারে যে ভেজা ধান বিক্রি করতে আমার সমস্যা। হাতে-মুখে আমাকে ইশারা করতে থাকে চুপ থাকার জন্য।

ধান মাপার পরে টাকা বুঝে নিয়েছি। কিন্তু আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। বললাম- ভাইজান ধানটা একটু দেখে নেন, ভেজা আছে। লোকটা আমাকে বলল - দাওতো বাবা টাকাটা একটু, বলে আমার হাত থেকে টাকার বান্ডিলটা নিয়ে নিল। মুহিবের চেহারা দেখে মনে হয় আমাকে ধরে এই মারে কি সেই মারে। লোকটা টাকার বান্ডিল থেকে একটা ৫০০ টাকার নোট সরিয়ে পকেট থেকে আর একটা ৫০০ টাকার নোট দিয়ে বলল- যাও। এইখানটাতে সন্ধ্যার পরে যারা ধান বিক্রি করতে আসে, তারা কি ধান বেচে আমরা ভালো করেই জানি। তুমি সত্য কথা বললে, তোমাকে আর জাল টাকা দিলাম না।

আড় চোখে মুহিবের দিকে তাকাই। বেটার মুখে কথা নাই। হাঁটের মসজিদে এশার নামাজ শেষ। হাট প্রায় ভেঙে গেছে। হাট থেকে তিনশ গজ মত দুরে সিনেমা হল, নটায় সেকেন্ড শো শুরু হবে। ততক্ষণ কিছু মুদি দোকান আর খাবার দোকান খোলা থাকবে। মুহিব বললো তুমি দোকানে বস, আমি একটু পরে আসতেছি, কাজ আছে।

এই এলাকায় হেরোইন দশ পনেরো টাকায় এক পুরিয়া পাওয়া যেতো। পরে যখন ফেন্সিডিল আসে ১৫ টাকা বোতলও বিক্রি হতে দেখেছি। একজন ভ্যান ড্রাইভার সারাদিনে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা উপার্জন করতো। পনেরো টাকায় দু কেজি চাল হয়ে যেতো। নেশা খুব এক্সপেন্সিভ ছিলো না, কিন্তু গায়ে লাগে না এমনও না।

ধান বিক্রির টাকা প্যান্টের ভিতর প্যাকেটে গুজে নিয়ে সব গুছিয়ে নিলাম। মুহিব আসতেই বেরিয়ে পড়লাম। ও আমাকে একশ গজ মতো এগিয়ে দিলো। রাস্তার অবস্থা কহতব্য নয়। যুক্তফ্রন্টের সময়ে একজন এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আর একজন এমপি আমাদের গ্রাম থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে স্থানীয় পলিটিক্সের ফাঁদে পড়ে গ্রামের সামনে দিয়ে যাওয়া এই রাস্তাটি হিংসার কারণে আর কেউ উন্নয়নের কাজ করেন নি ।

কথিত আছে জটিল ডেলিভারি কেসের মহিলাকে এই রাস্তায় ভ্যানে করে নিয়ে গেলে তার ডেলিভারি সহজে হয়ে যায়। বিষয়টা আসলে পুরোপুরি মিথ্যে না। কয়েক বছর আগে আয়নাল ভাইয়ের স্ত্রীকে থানা সদর হাসপাতালে নেওয়ার সময় তিনি এই রাস্তায়ই ভ্যান এর মধ্যেই বাচ্চা প্রসব করেন। তবে থানা হাসপাতালে কর্মরত আমার জেঠাতো ভাই অন্য কথা বলেন । তিনি বলেন আসলে আয়নালের স্ত্রীকে নিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। রাস্তা ভালো থাকলেও উনিরাস্তাতেই বাচ্চা প্রসব করতেন।

ঐ সময়ে সৌখিন লোকেরা ফনিক্স সাইকেল ব্যবহার করতেন (গ্রামাঞ্চলে এই উচ্চারনই প্রচলিত ছিলো, ফিনিক্স কারো মুখে কখনো শুনি নি)। ডাবল রড এর একটা চায়না ফনিক্স এর নতুন অবস্থায় দাম ছিল ৫২০০ টাকা, প্রায় ২৫ মণ ধানের সমান। আমাদের কাছে ছিল একটা অ্যাভন সাইকেল, তেরোশো টাকার। কলেজে থাকতে বন্ধুর ধার করা সাইকেল চালিয়ে কিছু প্র্যাকটিস করেছি, অভিজ্ঞতা সুখকর না। এই রাস্তায় চালানো সম্ভব না।

তো আমি গ্রামের দিকে হাটা দিলাম। সম্বল সাথে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ , ব্যাটারি একটু দুর্বল, তবে চলে যাবে। পকেটের ধান বেচা প্রায় আট হাজার টাকা, একটা চাকু আরেকটু লবণ। গ্রামদেশে কুসংস্কার আছে রাতের বেলা পথ চলার সময় সাথে আগুন-লোহা-লবন রাখার জন্য। তবে আমার সাথে লবন আর চাকু কুসংস্কারের কারণে না। বাজারে কচি কচি ক্ষিরা উঠেছে, আমার খুব পছন্দের। ক্ষিরা খাওয়ার জন্য বাসা থেকে লবণ আর একটা চাকু এনেছিলাম।

আমার আরেক হাতে একটা অ্যালুমিনিয়ামের জগ, জগ এর মধ্যে কিছু মিষ্টি। আমাদের এলাকায় মিষ্টি নেওয়ার কাজে লোকে অ্যালুমিনিয়ামের জগই ব্যবহার করতো দেখেছি। দই এর জন্য মাটির হাড়ি ব্যবহার করলেও মিষ্টির জন্য মাটির হাঁড়ি এতটা প্রচলিত ছিল না। কাগজ বা প্লাস্টিকের বাক্স আরো পরে এসেছে। পরদিন খাবার জন্য কিছু মিষ্টি নিয়েছিলাম।

বাজার থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় দুই আড়াই কিলোমিটার পথ। বাজারের পরে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। এরপরে গুচ্ছগ্রাম। এরপরে আবারো ফাঁকা জায়গা, আর একটা গ্রাম, ফাঁকা জায়গা, এরপরে সাওতাল (খ্রিস্টান)দের একটা কবরস্থান, গ্রাম, ফাঁকা জায়গা, মুসলমানদের কবরস্থান, বাঁশ ঝাড়, এর পরেই আমাদের গ্রাম।

সাওতালদের কবরস্থান খুব পরিস্কার। একটা ভাত পড়লে তুলে খাওয়া সম্ভব। ভয় লাগার মতো কিছু নেই। পক্ষান্তরে মুসলমানদের খবর গুলো ঝোঁপ- জঙ্গলে পরিপূর্ণ। শীতকাল ছাড়া অন্য সময়ের ভিতরে ঢুকতে সাপ-জোকের ভয় লাগে। এখন ডিসেম্বর, সাপের ভয় নেই। মুসলমানদের কবরস্থানে নিয়মিত দোয়া দরুদ পড়া হয় বলে এখানে খারাপ কিছু থাকার সম্ভাবনা আছে বলে আমার কখনোই মনে হয় নি।

গ্রামে কুসঙস্কার আছে যে শনি-মঙ্গলবারে কেউ মারা গেলে কালো যাদুর জন্য তার লাশ খুব কাজে লাগে। এই লাশ ফকির/তান্ত্রিকরা চুরির জন্য সুযোগ খোঁজে। আত্মীয়দের মাঝে একাধিক জন শনি-মঙ্গলবারে মারা গেছে, আমিও কবর পাহারা দিয়েছি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি কাফন চোরদের কারনে এই রকম গুজব ছড়ায়। যাকগে, আসলে বলতে চাচ্ছি ঐ বয়সে অশরীরির ভয় আমার তেমন ছিলো না। শ্মশান সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা শুনেছি, আমাদের এলাকায় কোন শ্মশান নেই। কুকুর আর সাপ ছাড়া আমার অন্য কিছুতে ভয় কম। কুকুর এই এলাকায় খুব কম। শীতে সাপ নেই।

তবে ভুতের চেয়ে মানুষ অনেক বেশি ভয়ঙ্কর । রাস্তায় একটা পুরনো কালভার্ট আছে , কালভার্টের এখানে ঝোপের মাঝখানে মাঝে মাঝে কিছু হিরোইন খোর বসে থাকে, চাকু হাতে। নিরীহ কাউকে পেলে তার টাকা পয়সা কেড়ে নেয়। আমাদের পরিবার মোটামুটি এলাকায় প্রভাবশালি হওয়ায় আমার এরকম কোনো শঙ্কা নেই।

সে যাকগে, গুচ্ছগ্রাম এলাকা পার হওয়ার পর রাস্তায় লোকজন আর চোখে পড়ল না। এরশাদ সাহেব অনেক অপকর্ম করেছেন, তবে গুচ্ছগ্রামের প্রকল্পটা ভালো ছিল। এখন সরকারের ত্রাণ এর টাকা সব বড়লোকেরা পায়। আমাদের এলাকায় শুধু প্রকৃত গরিব লোকেরাই গুচ্ছগ্রামে জমি পেয়েছিলেন।

ভূতের গল্প আমাবস্যার রাতে জমে। তবে ঐদিন আমাবস্যা ছিলনা। কৃষ্ণপক্ষও না। শুক্লপক্ষের চাঁদ। গল্পের খাতিরে আপনারা কৃষ্ণপক্ষ ধরে নিলে আমার কোনো বাধা নেই।

ডিসেম্বর মাসে বেশ ভালো কুয়াশা পড়েছে। সাওতালদের কবর স্থান পার হওয়ার সময় দেখলাম একজন ঢ্যাঙা মত লোক , ধুতি পরা, হাতে একটা কঞ্চি, শুয়োরের পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাঁওতালরা শুয়োর খায়। কাজেই এই দৃশ্য খুব অস্বাভাবিক না। কিন্তু ঐ বেটা পার হয়ে যেতেই আমার মনে হলো- রাত আটটায় শুয়োর কোথা থেকে নিচ্ছে? মনে পড়ে গেল তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পের কথা। দিনের বেলা এইসব কথা মাথায় আসে না কিন্তু রাতের বেলা একা থাকলে নির্জনে এইসব অপ্রাকৃত গল্প গুলো একে মনে পড়ে যেতে থাকে।

পিছনদিকে মনে হল বিড়ালের মত কিছু একটা হাঁটছে। আমার মায়োপিয়া। সাড়ে তিন ডায়াপ্টারের চশমা পরি। নিশ্চিত করে বলতে পারবোনা। স্কুলের রমজান স্যারের গল্প মনে পড়ে গেল। আমাদের হায়ার ম্যাথ পড়াতেন । উনি বলেছিলেন রাস্তাঘাটে এরকম ছোটখাটো জিনিস গুলো মোটেও পাত্তা দেবে না । যদি ষাড়ের মতো বড় কিছু দেখো, তবে এগুলো ভয়ঙ্কর। এগুলো থেকে দূরে থাকবে। যদিও গ্রামের রাস্তায় বিড়াল মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু মনকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য এই জিনিসগুলো যথেষ্ট।

নীচের বাকি অংশটুকু গুরুত্বপূর্ণ।


গ্রাম থেকে কয়েক শ গজ দূরে বাঁশঝাড়ের এখানটাতে এসেছি। একটা গোঙানোর মতো আওয়াজ পেলাম। বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছি। লোকে বলে বাড়ির কাছে কুত্তার জোর। আমি একটু সাহস সঞ্চয় করে বললাম- কে ওখানে? কোন জবাব নেই। কিন্তু গোঙানির আওয়াজ বাড়ছে। আবার বললাম কে? এরপর হাতের টর্চ জ্বালিয়ে ফোকাস করতেই দেখি- কুঁজো ভিক্ষুকের মতো কেউ একজন বসে আছে । গায়ে কাপড় মুড়ি দেওয়া।

আবছা আলোয় মানুষের চোখের কোন কোষ গুলো ভালো কাজ করে না । ফটোপিক ভিশন নেই, স্কোটোপিক ভিশন। রং বোঝা মুশকিল। আমার কাছে মনে হয়েছিল সাদা রং। ভগবানে বিশ্বাস থাকলেও ভুতে আমার বিশ্বাস নেই। সাহস সঞ্চয় করে একটু গলা উঁচু করে বললাম - কে ? কি চাই?

কুঁজো হয়ে থাকা মূর্তি মুখ তুলে তাকায়। কুয়াশার ভিতরে টর্চের দূর্বল আলোয় দেখি দগদগে ঘা এ ভরা বীভৎস মুখ। আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার গলার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার হাত থেকে টর্চ পড়ে যায়। জগ পড়ে যায়। আমি পকেট থেকে চাকু বের করে চিৎকার দেই- সাবধান, চাকু মারে দিবো। মূর্তি আমার গলায় হাত দেয় ।

আমি ঘোরের মধ্যে চাকু দিয়ে আঘাত করি (অন্তত আমি তাই বিশ্বাস করি)। মূর্তীর ধাক্কায় আমি চিৎ হয়ে পড়ে যাই। মূর্তী আমার গলায় চাপ বাড়ায়। আমি পাল্টা মূর্তির গলায় হাত দিয়ে চাপ দেই। ধাক্কা দিয়ে মূর্তীকে ফেলে দেই। তার বুকের উপরে বসে গলায় চাপ দিতে থাকি। মূর্তি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মূর্তি আমার বুকের উপরে উঠে আসতে চায়। আমি চিৎকার করে উঠি। হাত দিয়ে মূর্তির মুখের মধ্যে ধাক্কা মারি। মূর্তির মুখে হাত দেওয়ার পর আমার মনে হলো আমার হাত যেন আগুনে পুড়ে গেল। আমি চিৎকার করে উঠি এবং এর পরে অজ্ঞান হয়ে যাই।

রাত এগারোটার দিকে জুয়া খেলা এক পার্টি গ্রামে ফেরার সময় আমাকে ওই জায়গায় পড়ে থাকতে দেখে। জামায় রক্তের দাগ। হাতে দগদগে ঘা। আমাকে ওরা হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার কপাল ভালো, আমার জেঠাতো ভাইয়ের স্ত্রী হাসপাতালে ওই দিন নাইট ডিউটিতে ছিলেন। ওনারা পরীক্ষা করে হাতের তালুতে এসিডে পোড়ার কিছু দাগ পান। গায়ের জামায় রক্তের মতো কিছু একটার দাগ ছিলো, কিন্তু ওটা আমার নিজের রক্ত না। আসলে রক্ত কি না তা টেস্ট করার মতো সুবিধা ঐ এলাকায় ছিলো না।

টর্চ ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছিল, ব্যাটারি শেষ। মিষ্টির জগওই জায়গায় ছিল, তবে মিষ্টিগুলোধুলার উপরে পড়া। আমার টাকা খোয়া যায়নি। ঐ জায়গায় ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ণ ছিলো। কিন্তু আমি ছাড়া কোনো মানুষের পায়ের ছাপ ছিলো না।

ঐদিন ভোরবেলা (শুক্রবার) আমার প্রবল জ্বর আসে । জ্বরের ঘোরে অনেক ভুল বকি। হাসপাতালে কর্মরত ভাবি আমাদের পরিবারের তখন কেবল নতুন যুক্ত হয়েছেন, আমার সম্পর্কে ধারণা ছিল না। আমি শহরে ছেলে, নেশা ওভারডোজ বা নেশা করে মারামারি করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি এরকম সম্ভাবনা ওনার মনে ছিলো। উনি আমার হাতে সুইয়ের চিহ্ন খুজেছিলেন। কোন চিহ্ন ছিল না। মুখে কোনো গন্ধ ছিলো না। তবে কাপড়ে পচা গন্ধ ছিলো।

সুই বা মুখ ছাড়াও মাদক নেয়া যায়, ব্লাড টেস্ট না করে এটা বোঝা সম্ভব না। গ্রামের হাসপাতালে ব্লাড টেস্ট করার সুযোগ ছিল না। গ্রামে প্র্যাংকের ঘটনা রেয়ার। অপরিচিত ছিনতাইকারি ? নাকি আর কিছু? যাহোক শনিবার আমি অনেকটা সুস্থ হই (হাসপাতাল ছাড়ার মতো না, তবে কথা বলার এবং মুখে খাওয়ার মতো) , কি ঘটেছিলো বলি। মামলা করা দরকার কি না আমার জ্যাঠাতো ভাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

তবে রোববারের পর ঘটনা বদলে যায়। রোববার ভোর বেলা আমাদের গ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে কালভার্টের নিচে পাওয়া যায় মিতালীর লাশ। মিতালী পাশের থানার ১৭ বছরের একটা মেয়ে। লাশের মুখটা এসিডে ঝলসানো । পেটে চাকু মারা হয়েছে। গলায় হাতের দাগ।

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুসারে মিতালীকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পরে মুখে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সম্ভবত লাশের পরিচয় গোপন করতে চেয়েছিল। লাশের পেটে চাকু মারা হয়েছিল, হত্যা নিশ্চিত করার জন্য। মৃত্যুর সময় শনিবার রাত এগারোটা থেকে শুরু করে রবিবার ভোর পাঁচটা। শীতকালে নাকি এর চেয়ে বেশি একুরেটলি টাইম অফ ডেথ বের করা সম্ভব না।

মিতালীর বিধবা মা রেবা রায় শনিবার দুপুর থেকে মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিলো না। সন্ধ্যায় থানায় গিয়েছিলো, থানা ওয়ালারা অপমান করে তাড়িয়ে দেয় মেয়ে কারো সাথে ভেগে গেছে এই বলে।

আমি ওই সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। তাছাড়া পরিবার মোটামুটি প্রভাবশালী। থানা হাসপাতালে কর্মরত জ্যাঠাতো ভাই খুব চৌকস লোক। ওসি-টিএনওর সাথে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলেন। আমি পুলিশি ঝামেলা থেকে বেঁচে যাই। এক সপ্তাহ পরে আমি শহরে চলে আসি , এবং সেখান থেকে বাবা আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। কয়েকদিন পরে ইউনিভার্সিটি খুলে যায়।

এই ঘটনা আমাকে অনেক ধাক্কা দিয়া যায়। পরবর্তীকালে গ্রামে যেয়ে অনেক অনুসন্ধান করে যাওয়া জানতে পারি, মিতালীর বিধবা মা একটা সেলাই মেশিন চালিয়ে জীবন চালাতো। মিতালী একটা কলেজে গার্লস কলেজে এইচএসসির ছাত্রি ছিলো। তবে প্রতিবেশী নিত্যানন্দের অত্যাচারের ওর কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিত্যানন্দ বহুবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু জাত মেলে না বলে মিতালীর মা রাজি হয় নি। মিতালীর মা মিতালীর বিয়ের জন্য বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু হিন্দু সমাজে পন ছাড়া মেয়ের বিয়ে দেওয়াটা, বিশেষ করে বাবা না থাকলে, খুব মুশকিল।

নিত্যানন্দের মাইক-ব্যাটারির ব্যবসা। এসিড জোগাড় করা কোনো সমস্যা না। পুলিশ নিত্যানন্দ কে এরেস্ট করে। নিত্যানন্দ কবুল করে সে মিতালীর দিকে খারাপ নজর দিয়েছিল, সুবিধা করতে না পেরে তান্ত্রিকের কাছে যেয়ে তন্ত্র-মন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু কিডন্যাপ বা খুনের ব্যাপারে সে কিছুই জানেনা । তান্ত্রিককে পুলিশ খুঁজে পায়নি, তান্ত্রিক ওই ঘটনার পর থেকে লাপাত্তা। তবে নিত্যানন্দের ঘরে একটা কাপড়ের পুতুল পাওয়া যায়, পেটে সুই, মুখ পোড়া।

নিত্যানন্দ হাজতে মারা যায়। গলায় লোকে বলে গলা টেপা অবস্থায় লাশ পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ দাবি করে আত্মহত্যা।হাজতে অনেক ধরনের অপরাধি থাকে । এরা নতুন কয়েদিদের কে নিয়ে হাত পা টিপিয়ে নেয়। নারী নির্যাতনকারী দের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়। এদেরকে দিয়ে অনেক রকমের আবদার মেটানো হয়। নিত্যানন্দ এরকম কোন কিছু শিকার হয়ে থাকবে বলেই আমার মনে হয়।

দীর্ঘকাল আমার বিশ্বাস ছিল আমি এই মৃত্যুর সাথে জড়িত। সন্দেহে করেছিলাম আমি সম্ভবত সেই রাতে নেশা করেছিলাম, যেটা আমার ব্রেন আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। অসৎ সঙ্গে পড়ে মানুষ অনেক কিছুই করে। মুহিব স্বীকার করেছে যে নেশার আড্ডায় সে নিত্যানন্দ কে দেখেছে, কিন্তু নিত্যানন্দের সঙ্গে তার এর বেশি কোন আলাপ ছিল না।

আমার ধারণা ছিল নেশার ঘোরে নিত্যানন্দ, মুহিব আর আমি ওই খুনের প্ল্যান করেছিলাম। আমি পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় ওরা দুজন মিলে এই কাজটা করে । কিন্তু মুহিবকে আমি বহুবার জিজ্ঞাসা করেছি, মুহিব কখনো স্বীকার করেনি। এর আনুমানিক ১৫ বছর পর মুহিব নেশা ছেড়ে দেয়। আমার জানা মতে ও গত দশ-পনেরো বছরে কোন নেশা করেনি। এলাকায় বিদ্যুৎ-কম্পিউটার আসার পর কিছুদিন সিডি-ভিসিডির ব্যবসা করেছিল। মোবাইল ফোন আসার পর কিছুদিন পল্লী ফোনের ব্যবসা করেছিল । এখন ফ্লেক্সি লোড বিকাশের ব্যবসা করে।

চাকরি পাওয়ার পর বেতনের টাকা জমিয়ে আমার মাথার দুটো এমআরআই করাই। ডাক্তারদের মতে নিউরো মার্কার গুলো সব ঠিকঠাক আছে । আমার মধ্যে স্প্লিট পার্সোনালিটি বা বাই পোলারিটির কোনো লক্ষণ নেই।

২০০৪/০৫ সলে আমার ব্যাচমেট মোখলেস জেলা সদরের ডিএসপি হয়ে আসলে তাকে ব্যাপারটা জানিয়ে অনুরোধ করি লাশের গলায় হাতের ছাপের কোনো রেকর্ড থাকলে আমার হাতের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে । বন্ধুটি আমার সঙ্গে একটু রাগারাগি করে আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

২০০৯ সালে আরেক ব্যাচমেট ওই জেলাতে এসপি হয়ে আসার পর তাকে পুনরায় এই অনুরোধ জানাই। সে আমাকে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট কোয়ালিটির সন্দেশ পরোটা এবং চা খাইয়ে খুব ভদ্রভাবে বলে এত পুরাতন মামলা ওপেন করার সুযোগ তার নেই। এছাড়া মামলাটি ক্লোজড । মোখলেস তাকে আমার কথা আগেই বলেছে। আমার পুনঃপুনঃ অনুরোধে সে কয়েকদিন পর আমাকে জানায় আমাদের দেশের যে আবহাওয়া, যে পরিবেশে আলামত রাখা হয়, তাতে ঐ হাতের ছাপের রেকর্ড নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

যে নেশার আড্ডা চালায় তাকে চাপ দিয়ে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছি, তার এক কথা আমাকে নেশার দ্রব্য বিক্রি করার সাহস তার নেই। এ রকম কোন ঘটনা ঘটে আমার ভাইয়েরা তাকে জবাই করবে।

চার বিয়ের কথা ভাবলে মনে একটু-আধটু পুলক যে হয় না এমন না , তবে এরকম পুলক মনে জাগলে তা দূর করার জন্য এই ঘটনাটা আমি স্মরণ করি, সব পুলক দূর হয়ে যায় ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১৫
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×