somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রসঙ্গঃ একুশে ফেব্রুয়ারির মূল চেতনা, ভাষা সাম্রাজ্যবাদ ও হালের কিতাবমেলা

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৭:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজ মহান রাষ্ট্রভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির এই দিনে পুলিশ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে মিছিলরত অকুতোভয় ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে – এই ঘটনাটি স্মরণ করা এবং এটাকে কেন্দ্র করে শোকের আহাজারি কিংবা মাতম করা, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য শহীদমিনারে ফুল দেওয়া, সেই দিনের ঘটনা পত্রপত্রিকায় বর্ণনা করা, টেলিভিশনে একুশ নিয়ে টক শো ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা, সেই আন্দোলনে কে কে সেদিন ভাষাসৈনিক হিসেবে রাজপথে উপস্থিত ছিলেন, তাদের মিডিয়ার সামনে নিয়ে আসা এবং তাদের থেকে সেদিনের স্মৃতিচারণ করানো, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা জ্ঞানীগুণীদের একুশে পুরষ্কার প্রদান ইত্যাদি – এগুলোকে আমরা একুশের মূল চেতনা বলে মনে করলেও এগুলো আসলে একুশের চেতনার কতিপয় উল্লেখযোগ্য দিক কিন্তু একুশের মূল চেতনা নয়। বরং একুশের চেতনা হচ্ছে অসাম্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির প্রতিবাদের চেতনা যে তারা পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিন পর থেকেই লক্ষ্য করতে থাকে যে পাকিস্তানী শাসক সম্প্রদায় তাদের সঙ্গে যে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে তা বাঙালি জাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ, এমন অবস্থা চলতে থাকলে বাঙালির অস্তিত্ব বিপন্ন নয় বরং বিলীন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। একুশের চেতনা শুধু অসাম্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনাই নয় বরং একাধারে ধর্মনিরপেক্ষতা-স্বাধিকারবোধ-প্রগতিশীলতাসহ সর্বোপরি রাষ্ট্রের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের চেতনা।



এই চেতনা একান্তভাবেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির চেতনা কেননা উচ্চবিত্ত শ্রেণী দেশের সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্কহীন, তাদের কাছে দেশমাতৃকা নয় বরং তাদের নিজস্ব ব্যবসাবাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক স্বার্থই একমাত্র চিন্তার বিষয়। আবার দেশের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা তথা সচেতনতা নেই। তাদের অবস্থাটা এমন যে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। জীবনযাপনের জন্য দুই পয়সা রোজগার করতেই তাদের সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, ফলে একুশ নিয়ে ভাবার সময় ও সামর্থ্য কোনোটিই তাদের নেই।

ধর্মভিত্তিকভাবে সৃষ্ট পাকিস্তান ছিলো একটি অবাস্তব তথা উদ্ভট রাষ্ট্র। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন সেটি ছিলো খুবই হাস্যকর এবং চরম ভুল একটি সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ সৃষ্টি ছিলো সেই ভুলের সংশোধন যদিও বাংলাদেশও স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সেই পাকিস্তানের পথেই পুনরায় হাঁটতে শুরু করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এর প্রধান রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী এবং তারা প্রথম থেকেই পরিকল্পনা শুরু করে যে কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানী বা বাঙালিদের অবলুপ্ত করা যায়। তারা বুঝে গিয়েছিলো যে, বাঙালি জাতিকে পঙ্গু বা নিঃশেষিত করে দিতে সবার আগে ভাষার ওপর আঘাত হানতে হবে কেননা ভাষা শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয় বরং ভাষার সাথে একটি জাতির অস্তিত্ব, জীবিকা, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও উন্নয়ন বিজড়িত। রাষ্ট্রভাষা উর্দু করা হলে উর্দু না জানা বাঙালি সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়বে, উর্দু মাতৃভাষা না হওয়ার কারণে উর্দুতে বাঙালি চাইলেই দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না, ফলে শিক্ষাদীক্ষা, চাকরিবাকরি, জীবিকা নির্বাহসহ সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়বে, পাকিস্তানীরাও সেই পিছিয়ে পড়াকে কাজে লাগিয়ে বাঙালিদেরকে সবদিক থেকে শোষিতবঞ্চিত করার একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যাবে। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলা ভাষার চর্চার পথ রহিত হবে ফলে খুব জলদিই বাঙালি তার কৃষ্টি ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে, পুরো জাতিটা এক কথায় চিন্তাচেতনায় পঙ্গু হয়ে যাবে এবং সবক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানীদের একচ্ছত্র আধিপত্য সৃষ্টি হবে। বাঙালি জাতির অস্তিত্বহীনতা ও বিপন্নতা তথা পাকিস্তানী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিলো প্রথম বড় ধরনের প্রতিবাদ যা মানুষের মনে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজ তথা স্বাধিকারের চিন্তাভাবনার চারাগাছ বপন করে দেয় এবং এই চেতনাই পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে জনতাকে অনুপ্রাণিত করে।

একুশের চেতনা গভীর অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদেরও চেতনা কেননা, ১৯৪৮ থেকে যেই বাঙালি মুসলমানেরা ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলো, সেই তারাই ক্রমাগত ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতি দ্বারা শোষিত ও বঞ্চিত হয়ে একটু একটু করে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারাছিলো এবং সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে ধর্মের চেয়ে যে ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি, সেটি ক্রমশঃ উপলব্ধি করছিলো। বাঙালি মুসলমান থেকে ক্রমশ তারা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি হয়ে উঠছিলো।



১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির চেতনা থেকে বাঙালির মধ্যে এক নতুন ধরনের সাহিত্যধারার জন্ম হয়েছিলো। ১৯৫২ পূর্ববর্তী সাহিত্যগুলো ছিলো অত্যন্ত দুর্বল মানের, শিল্পবোধহীন, বিষয়বস্তুহীন এবং প্রাচীনপন্থী। সেসময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিকদের বাইরে আমাদের নিজস্ব কোনো নামকরা সাহিত্যিক বলতে গেলেই ছিলোই না। বরং দেখা যেতো, সেসময়ের সাহিত্য ছিলো শুধুমাত্র পাকিস্তান ও তার রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে স্তবস্তুতি বা চামচামি কিংবা ধর্মীয় প্রশস্তিমূলক সাহিত্য যেমনঃ কায়েদে আজম জিন্দাবাদ, লিয়াকত আলী জিন্দাবাদ, খোশ আমদেদ মাহে রমজান কিংবা ঈদের খুশি ইত্যাদি। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারির পর থেকে স্বাধিকারপ্রত্যাশী প্রতিবাদমুখর বাঙালি লেখকদের মধ্যে ‘পাকিস্তানবাদ ও ধর্মবাদ’ বিরোধী মনোভাবের উন্মেষ ঘটে এবং সেসব অপসাহিত্য থেকে বাংলা সাহিত্য ক্রমশ প্রগতিশীলতা, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ও আধুনিকতার পথে হাঁটতে থাকে। সেসময়ের বাঙালি লেখকদের মধ্যে বিজাতীয় আরবী ফারসী ও উর্দু শব্দ বর্জন করে সংস্কৃত শব্দের পরিশীলিত বাংলায় সাহিত্য রচনার প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। এই যে ইরান তুরান আরব বুখারা সমরখন্দের প্রতি বৈষম্যপীড়িত বাঙালি লেখকদের একটা অনীহা, অনাগ্রহ ও চাপা ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায়, এটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সমৃদ্ধ হয় আমাদের বাংলা সাহিত্য।



বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগণ একে শুধু হিন্দুদের কিংবা পৌত্তলিকদের ভাষা বলে প্রচার করেই ক্ষান্ত থাকেননি বরং বাংলা ভাষার হরফ পাল্টানো থেকে শুরু করে তাতে দুর্বোধ্য উর্দু, আরবি শব্দ ঢুকিয়ে কার্যত বাংলাকে তার হাজার বছরের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালানো হয়। কবি শামসুর রাহমান এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। যে অবস্থান প্রাচীন পারসিক কবি ফেরদৌসি গ্রহণ করেছিলেন। তার নেতৃত্বে পারসিক কবি ও সাহিত্যিক গোষ্ঠী তাদের রচনায় আরবি দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার নীরব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ যুগে কবি শামসুর রাহমানও পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় তার কবিতায় আরবি, উর্দু শব্দ ব্যবহার বর্জন করতে শুরু করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অগ্নিবর্ষী কোনো কবিতা লেখেননি, কিন্তু সম্ভবত নিজের অজান্তেই নিজের কবিতায় উর্দু, আরবি ও ফার্সি শব্দ বর্জন দ্বারা ভাষা আন্দোলনে যে নীরব ভূমিকা পালন করেন তাকে নীরব বিপ্লব বলা চলে। আরবি, ফার্সি, উর্দু শব্দ বর্জন শামসুর রাহমানের অভিপ্রেত ছিল না। এটা ছিল তার মনের নীরব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সাময়িক বহিঃপ্রকাশ। কবির এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ভাষা আন্দোলনকে অনেক বেশি শক্তি জুগিয়েছে। তৎকালীন অনেক তরুণ কবি সরকারি রোষের মুখেও শামসুর রাহমানের কবিতা লেখার নীতিকে অনুসরণ করেন। তখনকার তরুণ কবিদের এই অবস্থান ভাষা সংগ্রামকে কম শক্তি জোগায়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অবশ্য শামসুর রাহমান তার কবিতায় আবার সহজবোধ্য আরবি, উর্দু শব্দ, এমনকি ফরাসি ও ল্যাটিন শব্দও ব্যবহার শুরু করেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অস্তিত্ববাদী উপন্যাসগুলোতে প্রত্যক্ষভাবে একুশ নিয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করা না থাকলেও আমরা দেখতেই পাই - সেখানে একটি বদ্ধ সমাজে বসবাসের দুরবস্থা ও যন্ত্রণাকে চমৎকার শৈল্পিকতায় প্রকাশ করা হয়েছে যা আগেকার পাকিস্তানবাদী ও ধর্মবাদী সাহিত্যগুলোর বিরুদ্ধে তথা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসাম্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে একপ্রকার চরম প্রতিবাদ। এসব ছিলো ষাটের দশকে একুশের চেতনার উৎকৃষ্ট ফসল, শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। একুশ ক্রমাগত বাঙালিকে এভাবেই নিজেদের দুর্দশা এবং লাঞ্ছনা বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে প্রেরণা যুগিয়েছে, তাদের মনের স্বাধিকার ও সাম্যের বোধ সৃষ্টি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং রক্ষণশীলতা ও কূপমণ্ডূকতাকে বিদায় জানিয়ে আধুনিকতা ও বহুমাত্রিকতার পথে হাঁটতে শিখিয়েছে। তাই, একুশই আসলে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম বা প্রাথমিক মাইলফলক যার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পরবর্তীতে বাঙালি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু করে।



অকুতোভয় ভাষাশহীদগণ সেদিন ১৪৪ ধারা ভেঙে অসীম সাহসের এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন এবং তাদের গুলি করে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করাটা নিষ্প্রাণ বাঙালি জনতার মনে পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে চরম রাগ, ক্ষোভ ও যন্ত্রণার রুদ্ররোষ সৃষ্টি করে যে - এই রাষ্ট্র থেকে আমাদের কিছুই পাওয়ার নেই, এই রাষ্ট্র থেকে বাংলা ও বাঙালিকে যে কোনো মূল্যে আলাদা করতেই হবে। সেদিনের পুলিশ দ্বারা রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর প্রমুখদের এহেন হত্যাকাণ্ডটি সঙ্ঘটিত না হলে বাঙালি কখনো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতো কিনা সন্দেহ। ভাষাসৈনিকদের প্রসঙ্গে আসি। অধিকাংশ ভাষাসৈনিকদের প্রতি আমার খুব বেশি শ্রদ্ধা নেই, কারো কারো ক্ষেত্রে শ্রদ্ধা একেবারেই নেই। কেননা এমন অনেক ভাষাসৈনিকদের আমি দেখেছি বা জেনেছি যারা ওই মিছিলে উপস্থিত থাকলেও পরবর্তীতে দেশের জন্য এমন কিছুই করেননি বা করতে পারেননি যাতে নতুন প্রজন্ম একুশের চেতনা, স্বাধিকারের চেতনা কিংবা আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার চেতনা ধারণ করতে পারে। সবাই না হলেও তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ এর পরে অনেকটাই নিষ্প্রভ, নিঃশেষিত, পরিত্যক্ত এবং অপাংক্তেয় হয়ে গেছেন। অবাক তথা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ব্যাপার এই যে, এমন অনেক ভাষাসৈনিক আছেন যারা ১৯৫২ সালে মিছিলে উপস্থিত থাকলেও পরবর্তীতে একুশের চেতনা এমনকী স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছেন।



আজকে আমরা শহীদ দিবসকে যে ২১শে ফেব্রুয়ারি বলে অভিহিত করি, সেটি খ্রিষ্টীয় বর্ষের একটি দিন। যেই ভাষার জন্য এতোগুলো মূল্যবান প্রাণের বলিদান হলো, সেই ভাষার জন্য লড়াই করার দিনটি যে বাংলা সন ও তারিখের বিচারে কবে – সেটাই আমাদের দেশের ৯৯% মানুষ জানে না। তারিখটি হচ্ছে ৮ই ফাল্গুন, সাল ১৩৫৮। না, আমাদের ইংরেজি কিংবা পরের ভাষার প্রতি কোনো বিদ্বেষ থাকা উচিত নয়। পরের ভাষা শেখা বা জানা খুবই ইতিবাচক একটি বিষয় কিন্তু শহীদ দিবস যেহেতু ‘বাংলা ভাষার ওপর অন্যায় আক্রমণ’ থেকে সৃষ্ট, সেহেতু খ্রিষ্টীয় সনতারিখের পাশাপাশি বাংলা সনতারিখেও এই দিনটি মনে রাখা আবশ্যকীয়। ৮ই ফাল্গুন হিসেবে উল্লেখ করার পর ২১শে ফেব্রুয়ারি বলা যেতেই পারে কিন্তু কখনোই ‘৮ই ফাল্গুন’ না জেনে বা ভুলে যেয়ে নয়।

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে – ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। অনেক চড়া দামে কেনা স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশকে দেখতে হয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে ভূমিকা রাখা আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলগুলোর মধ্যেকার অন্তর্কোন্দল। পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করার আগ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে একদম চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে যায়। দেশে যেই ধ্বংসস্তূপের পাহাড় ছিলো সেই পাহাড় ভেঙ্গে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো, জনগণকে ক্ষুধা ও দারিদ্র থেকে মুক্তি দেওয়া, তাদের অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে কেন, পৃথিবীর কোনো দলের পক্ষেই এতো অল্প সময়ে সম্ভবপর হতো না। কিন্তু র‍্যাডিক্যাল বিপ্লবে বিশ্বাসী বামপন্থীরা দেশের এই দুরবস্থা মেনে নিতে না পেরে এবং ক্ষমতার অংশীদারিত্ব না পেয়ে রাগান্বিত হয়ে দেশে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ডে রত হয়। পুরোপুরি নয় তবে মোটামুটিভাবে প্রগতিশীল এই ২ দলের মধ্যেকার এই লড়াইয়ের ফসল ঘরে তোলে মৃতপ্রায় ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী দলগুলো। আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের লড়াইয়ে মানুষ ক্রমশ ভুলে যেতে থাকে স্বাধীনতার কথা, সাম্যবাদের কথা, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের কথা, শোষণ-মুক্তির কথা, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, আধুনিকতার কথা। ১৯৭২ সালের প্রথমদিকে একুশের চেতনা বাস্তবায়নের স্বপ্ন জনগণের চোখে মুখে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ২-৩ বছরের মধ্যে সেই স্বপ্ন বেদনাদায়কভাবে নষ্ট হয় এবং সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ চেতনা তাদের মধ্যে প্রবলভাবে জেঁকে বসে। যদিও নামে বামপন্থী তবুও ২ নৌকোয় পা রাখা এদেশের ছদ্মবামপন্থীরা ক্ষমতা লাভের উন্মত্ত নেশায় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করে মানুষের মনে পরধর্মবিদ্বেষ এবং পরজাতিবিদ্বেষ সৃষ্টি করে। ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত প্রেতাত্মার জায়গা নেওয়া পাকিস্তানের জায়গায় এবার বামপন্থীরা বসিয়ে দেয় অসাম্প্রদায়িক ভারতকে যেই ভারত পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে বাংলাদেশকে আক্রমণ করেনি বা রেখে দেয়নি বরং যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ১৭ই মার্চ বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লোভে বামপন্থীরা দেশের মানুষের মধ্যে সুকৌশলে ভারতভীতি ও ভারতবিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেয় আর যুদ্ধের মাধ্যমে সব কিছু হারানো জনগণও তাদের শিক্ষাদীক্ষার দুর্বলতার কারণে এই ফাঁদে পা দিয়ে একুশের চেতনার আত্মাহুতি ঘটাতে থাকে। সেসময়ের লেখকদের মধ্যে তখন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেই সাহিত্য রচিত হয় সেখানে কোনো মৌলিক চিন্তাধারা দেখা যায় না বরং দেখা যায় সব উপন্যাসের কাহিনীই মোটামুটি একরকম – পাকিস্তান বাহিনী আসলো, মানুষ মারলো, ধর্ষণ করলো, তারপর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো ! কিভাবে স্বাধীন হলো, কারা সাহায্য করলো আর স্বাধীনতার পরে দেশের জন্য কী কী দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে – সেসব নিয়ে কোনো কথা লেখা নেই, সামান্যতম দিকনির্দেশনা দেওয়া নেই। মানুষ মরা আর ধর্ষিতা হওয়া কী যুদ্ধজয় ? নাকি ওটা নিজেদেরই পরাজয় ? লেখকরা ভেবেছিলেন এসব মানুষ মরা আর ধর্ষণের গল্প লিখলে পাঠকদের কাছে ব্যাপারটা খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে ! এই কী একুশের চেতনা ছিলো ? একুশের চেতনা বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে – বুদ্ধিজীবী হত্যা। পরাজয়ের আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাকিস্তান বাহিনী প্রকারান্তরে জিতেই গেলো, পঙ্গু করে দিয়ে গেলো পুরো বাংলাদেশকে, একুশের চেতনা মানুষের মনে প্রজ্বলিত করার জন্য এদেশে কেউ রইলো না।



ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখেছিলাম যেখানে দেশের শিশু কিশোর তরুণ তরুণীদেরকে একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হচ্ছে। তাদের কেউ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, কেউ বলছে এদিন নাকি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, কেউ নির্লজ্জের মতো হাসছে আবার কেউ বা উদ্ভটভাবে যা খুশি তাই বলেছে। কেন এমন হলো ? এর জন্য সবার আগে দায়ী এদেশের ছদ্মবামপন্থীরা যারা দেশের সরকারকে একটুও শান্তিতে কাজ করতে দেয়নি, পদে পদে প্রতিবন্ধকতা, প্রোপ্যাগান্ডা রচনা এবং প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের মাধ্যমে দেশকে নষ্টভ্রষ্ট করেছে। তৎকালীন সরকারও কিছুটা দায়ী, তাদের দুর্বলতার ও ক্ষমাশীল মনোভাবের সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী কিছু বিশ্বাসঘাতক সরকারী দলের বড় বড় পদে আসীন হয়ে ছদ্মবামপন্থীদের অপকর্মগুলো জায়েজ তথা আরো সহজ করে দেয়। শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিশ্বাসঘাতকদের বলি হন আর বামপন্থীদের গুরু কর্নেল তাহের বলি হন ডানপন্থী জিয়াউর রহমানের হাতে। জিয়াউর রহমান একুশের চেতনাকে খুবই সুকৌশলে হত্যা করতে থাকেন। পাকিস্তান আমলে প্রচলিত ‘জিন্দাবাদ’ নামক উর্দু শব্দকে তিনি বাংলাদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন, ‘বেতার’ নামক বাংলা শব্দকে ঝেটিয়ে বিদায় করে রেডিও পাকিস্তানের আদলে তিনি নামকরণ করেন – ‘রেডিও বাংলাদেশ’। সেই সকল কবিদের কবিতা পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত করা হয় যারা ছিলেন পাকিস্তানপন্থী এবং যাদের লেখায় বাংলা ভাষার চেয়ে উর্দু, আরবী ও ফারসী শব্দের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। যেমনঃ ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, তালিম হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবীব, সানাউল হক, মোফাখখারুল ইসলাম, আবুল হোসেন, বেনজীর আহমদ, আবুল হাশেম,মঈনুদ্দীন,মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আব্দুর রশীদ খান, আব্দুস সাত্তার ইত্যাদি। যাদের অধিকাংশের নাম বাঙালি বা বিশ্ব জানতো না। প্রবন্ধ, নাটক ও রসরচনায় নিয়ে আসা হয় - মওলানা আকরম খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, মুজিবুর রহমান খাঁ, ইব্রাহিম খাঁ, আব্দুল হাই, সৈয়দ আলী আহসান, মনসুর উদ্দিন, বন্দে আলী মিয়া, আলাওল ইত্যাদিকে। এদের লেখায় বাংলা ভাষার পাশাপাশি উর্দু আরবী ফারসি বিভিন্ন ভাষার অতিব্যবহার দেখা যেতো যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের পথ রুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। জিয়াউর রহমান দেশের জনগণকে শিক্ষিত না করে শ্রমিক হওয়ার দাসভিত্তিক জীবনে ঠেলে দেন মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে, তাদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে। এভাবেই নষ্ট হতে থাকে একুশের চেতনা। এদেশের জনগণের শিক্ষার পেছনে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থব্যয় করা হতো, তাহলে তারা এক দিনে হয়তো অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে পারতো না কিন্তু সময়ের প্রবাহে এই শ্রমিক বাঙালিরাই যথাযথ শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ব্যারিস্টার হয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতে পারতো, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকজীবনের অর্থনৈতিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি ভালো হতো। অর্থও থাকতো, সম্মানও থাকতো, মধ্যপ্রাচ্যে চাবুকের বাড়ি খেয়ে কিংবা অপরাধ করে শিরশ্ছেদের শিকার হয়ে কিংবা তাদের অনুগত গোলাম হয়ে দিন কাটাতে হতো না।

এই যে টিভি চ্যানেলের শাশুড়ি-বৌমার ঝগড়াঝাটি, মেয়েদের একে অপরের প্রতি ঈর্ষা কিংবা ইন্টারনেটের রেডিও মুন্না, রেডিও পদ্মা, বাঁশের কেল্লা, বঙ্গমিত্র পেজ, ডেসপারেটলি সিকিং গ্রুপস কিংবা অশ্লীল সাইট/পেজগুলোর নোংরামি - এগুলো সবই একুশের চেতনাবিরোধী। টেলিভিশন আর ইন্টারনেট এক দিনে দেশজুড়ে মানুষকে যেভাবে সঙ্কীর্ণ, হীনমনা আর প্রগতিবিমুখ করে তুলছে, তাতে অসাধারণ মূল্যবান লেখকদের বই বছরের পর বছর আসলেও চেতনার ক্ষতিপূরণ করতে পারবে না। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার চরম ত্রুটি এবং মানুষের মনমানসিকতায় আগে থেকেই ঢুকে থাকা ভুল ধারনাগুলো একসাথে একুশের চেতনাকে গলা টিপে হত্যা করছে। শিক্ষাব্যবস্থার গতানুগতিক ধারার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে, বাজেটে শিক্ষার জন্য অন্তত ৭% বরাদ্দ না করলে এবং সর্বোপরি জাতির শিক্ষার জন্য নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো বাস্তবে কার্যকরী করতে না পারলে একুশের চেতনা কখনোই দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।

একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন যে, একুশের চেতনা বই পড়ার চেতনা যেই বইগুলো মানুষের স্বাধীনতা ও কল্যাণের কথা বলে। এটি ধর্মীয় চেতনার মতো কোনো উগ্র চেতনা নয় যে তার প্রকাশ হইচই, হিংস্রতা, উত্তেজনা বা গোলমালের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাবে। একুশের চেতনা মাইক দিয়ে প্রচার করে বা মিছিল করে প্রকাশ করার নয়। কল্যাণকর বইগুলো কখনোই চিৎকার চ্যাঁচামেচি বা হিংস্র হুংকারে করে বলে না যে, এগুলো পড়তেই হবে। আজকে বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয় বই আছে যার ভেতরে হালকা ধাঁচের আটপৌরে প্রেম বা পাগলামি রয়েছে। এসব বই সাধারণ জনগণের পড়তে খুব ভালো লাগে কেননা এগুলোতে জ্ঞানের কিছুই নেই বলে দেশের অধিকাংশ শিক্ষাহীন বা অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর খুব সহজে মাথায় ঢোকে, তারা এসব অপাঠ্য বইপত্র নিয়েই পড়ে থাকে। এসব বই একুশের চেতনা বিরোধী কেননা এগুলো মানুষকে জ্ঞানী, স্থিতধী, প্রগতিশীল ও বাস্তববাদী করার বদলে সস্তা চটকদারিতা, মূর্খতা ও পাগলামির দিকে ধাবিত করে। এছাড়া আছে ফেসবুকের কতিপয় অর্বাচীন তরুণদের লেখা বই যা আসলে তাদের ফেসবুকেরই বিভিন্ন সময়ের পোস্টের সংকলন এবং এসবের ভেতরে জ্ঞান কিংবা তথ্য কিছুই নেই, আছে খালি মনগড়া উদ্ভট বক্তব্য।

আমাদের দেশে লেখা বইগুলোর ৯৫% ই অপাঠ্য কেননা আমাদের সমাজে সাক্ষরতা হার ৬০%ও কম। ফলে শিক্ষার হার আরো কম এবং শিক্ষার ধরন অত্যন্ত নিম্নমানের ও ত্রুটিপূর্ণ। ফলে এদেশে যারা শিক্ষিত, তারাও শেষপর্যন্ত অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত এবং অসচেতন। প্রকৃত শিক্ষার চর্চা না হওয়ার কারণে সাংস্কৃতিকভাবে এরা অত্যন্ত নিম্নরুচিসম্পন্ন এবং এদের লেখা বইগুলো শেষপর্যন্ত জাতিকে জ্ঞানের পথে, দর্শনের পথে ধাবিতে করতে বা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দিকনির্দেশনা দিতে একেবারেই ব্যর্থ।



ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাতত্ত্ববিদ জার্মানির ভন হামবোল্টের কথায়- ‘ভাষা হচ্ছে একটি জাতির চেতনার অভিব্যক্তি, অভ্যন্তরীণ রূপের বাহ্যিক প্রকাশ। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ঐ জাতির ধারণার প্রকাশ রূপ। একটি ভাষার বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর ঐ জাতির মানস-সংস্কৃতি ও সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সুতরাং ভাষা ও জাতীয় ইতিহাস অচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত।’ ভাষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ভাষা জড় পদার্থ নয়। এটি কোন সমাপ্ত কর্মও নয়। ভাষা একটি জীবন্ত প্রবাহ। একটি ভাষা তার বিকাশের প্রক্রিয়ায় অন্য ভাষার সাথে আদান-প্রদান করে। কিন্তু ‘ক্ষমতার ভাষা’ এ পথে চলতে চায় না। ক্ষমতার সাথে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, সবকিছুই জড়িয়ে থাকে। ক্ষমতা হচ্ছে নিয়ন্ত্রক শক্তি। ক্ষমতার ভাষা তার ক্ষমতার দাপটে অর্থনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য ভাষাকে গিলে ফেলতে চায়। ক্ষমতার এই ভাষাই হচ্ছে ভাষা-সাম্রাজ্যবাদ। আধিপত্যশীল এই ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে আগামী শতাব্দীতেই মানুষের মাঝে প্রচলিত পাঁচ হাজার ভাষার মধ্যে সাড়ে চার হাজার ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে কোন জাতির ভাষাকে নিঃশেষ করে ফেলতে পারলে সেই জাতির ওপর সবদিক থেকে আধিপত্য বিস্তার করা সহজ হয়ে পড়ে। ভাষা চলে গেলে একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-জ্ঞান-প্রজ্ঞা-দর্শন সবকিছুই চলে যায়। নতুন আধিপত্যশীল ভাষা-সভ্যতায় সে তখন অনায়াসেই বিলীন হয়ে যায়। এজন্য মানবিক অস্তিত্ব রক্ষার যতরকম সংগ্রাম আছে তার মধ্যে ভাষা রক্ষার সংগ্রাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কথায় ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভাষামুক্তির সংগ্রাম গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবস জাতিসংঘের ইউনেস্কোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে অনেকে মনে করেন বিশ্বের দরবারে আমাদের জাতি ও ভাষার সম্মান, মর্যাদা বা গৌরব বেড়ে গেছে। কিন্তু এটি একেবারেই ভুল ধারনা কেননা এই সম্মান জাস্ট প্রতীকী সম্মান, এই দিবস পালন হওয়ার মানে এই নয় যে সারা পৃথিবীতে বা জাতিসংঘে বাংলা ভাষা চর্চা শুরু হয়ে গেছে বা পৃথিবীর মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি অনেক সম্মানবোধের সৃষ্টি হয়েছে। এই পৃথিবীতে ৬৫০০+ ভাষা রয়েছে যার মধ্যে ২০০০+ ভাষার ১০০০ থেকেও কম ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। ভাষাতাত্ত্বিকভাবে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, হিন্দী ইত্যাদি শক্তিশালী ভাষা। এদের আধিপত্যের কারণে পৃথিবীর অনেক ভাষার অবস্থা চরমভাবে বিপন্ন। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির সুযোগ নিয়ে তথা সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় প্রভাবে শক্তিশালী ভাষাগুলো পৃথিবীজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এই ভাষাগুলোকে বিভিন্ন দেশের মাতৃভাষার পাশাপাশি শক্তিশালী করে তোলা হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোতে সরকার তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে সচেতন নয় বলে তারা মাতৃভাষা বিকাশ ও প্রসারের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না আর সেই সুযোগে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো দেশে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং সবাইকে ইংরেজি শেখার দিকে ধাবিত করছে। আন্তর্জাতিকভাবে পুরষ্কার দেওয়া হচ্ছে যেসব বইকে যেগুলোর শুধুমাত্র ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে। ফলে পুরষ্কার পেতে গেলে ইংরেজি শিখতে হবে এবং ইংরেজিতেই লিখতে হবে – এমন চিন্তাভাবনা লেখকদের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে নিজের ভাষার কোনো বিকাশ বা প্রসার ঘটছে না এবং এই চর্চাহীনতার কারণে ক্রমশ মানুষ নিজের ভাষার অনেক শব্দই ভুলে যাচ্ছে। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষাভাষী নয় এমন দেশগুলোর সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সম্যকভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয় বলে দেখা যাচ্ছে, সেসব দেশের শুধু ভাষা আর সাহিত্যই নয় বরং সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রসার অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই আধিপত্যবাদকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বহুমুখী চেতনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

অত্যন্ত দুঃখজনক এই যে, এই মুহূর্তে বাংলা শুধুমাত্র নামেই রাষ্ট্রভাষা কিংবা জনগণের মুখের ভাষা যা আমাদের দৈনন্দিন যোগাযোগে ব্যবহৃত হয় কিন্তু প্রশাসনে, সামরিক বাহিনীতে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বাংলার চেয়ে বর্তমানে ইংরেজির প্রচলন অনেক বেশি এবং উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে ইংরেজি ভালো জানে, সে চাকরি পাচ্ছে কিন্তু যে বাংলা ভালো জানে, সে চাকরি পাচ্ছে না। অথচ ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, জাপানিজরা কিন্তু তাদের নিজেদের ভাষাতেই সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করছে এবং প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের ভাষাই ব্যবহার করছে। পক্ষান্তরে আমরা নিজেদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা না করে ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকই আমাদের প্রজন্মকে পড়াচ্ছি। এতে করে এদেশের মানুষের মধ্যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য কিংবা প্রযুক্তির ব্যাপারগুলো শিখতে তথা হৃদয়ঙ্গম করতে সমস্যা হচ্ছে। মাতৃভাষায় এসব পুস্তক রচনা করা হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়গুলো আমাদের সাধারণ মানুষের মাথায় অতি সহজে ঢুকতো এবং তারা অনেক বেশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখী হতে পারতো। দেশের জ্ঞানীগুণীদের উচিত ছিলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক বাংলায় রচনা করা, যত ধরনের গবেষণাপত্র আছে তা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও রচনা করা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই যেহেতু বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সামরিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেজন্য মাতৃভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা ও পাঠ্যপুস্তক রচনা আজ অতি প্রয়োজনীয়।



আমাদের দেশে বাংলা একাডেমীকে ছাগলশালা বা পাঠাশালা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। এখানে প্রত্যেকটি সরকার তার মনমতো কিছু তোষামোদকারী মূর্খ চাটুকারকে মহাপরিচালক বানিয়ে দেয় যারা বাংলাতে শুদ্ধভাবে লিখতেও পারেন না, ভুল বাংলায় টাইপ করে সকলের হাসির পাত্র হন। এজন্যই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে শক্তিশালী করা আজ সময়ের দাবি। আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় একটি প্রকৃষ্ট ব্যাকরণ বা অভিধান গ্রন্থ রচিত হয়নি। বাংলাভাষার কতগুলো আঞ্চলিক উপভাষা আছে এবং সেগুলোর রূপ কেমন – সে সম্পর্কে দেশের জনগণের বৃহত্তর অংশই অজ্ঞাত। ফলে প্রায়ই এক অঞ্চলের মানুষের আরেক অঞ্চলের মানুষের ভাষা বুঝতে অত্যন্ত অসুবিধায় পড়তে হয়। এছাড়া বাংলা একাডেমী বানানের যে অদ্ভুতুড়ে নিয়ম তৈরি করেছে তাতে মানুষের বানান সচেতনতা তো আসেইনি বরং বানান নিয়ে রীতিমত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের বানানো অনেক নিয়মই বাস্তবে কার্যকরী হয় না বলে এদেশের মানুষ শুদ্ধ বানানে লিখতে যেয়ে বড়ই অস্বস্তিতে পড়ে। বাংলা একাডেমীর প্রধান কাজ হওয়া উচিত ছিলো জ্ঞানচর্চার বিকাশ কিন্তু এটির প্রধান কাজ হয়ে গেছে বইমেলা আয়োজন। এই বইমেলা আয়োজন একটা হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত হয়েছে কেননা পুরো বইমেলা জুড়েই দেখা যায় চরম অব্যবস্থা যা থেকে মনে হয়ে একাডেমীর কর্মকর্তারা জাস্ট গতানুগতিকতা রক্ষা করতে হবে এই মানসে দায়সারাগোছে বইমেলা আয়োজন করেন ! বইমেলায় দেখা যায়, ভুতের মতো কালো বোরকা পরিহিতা কিছু ছাত্রীদের দিয়ে দাজ্জালের আগমন, জিহাদের লক্ষ্য – এরকম কিছু হাস্যকর অপাঠ্য চটিবই বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রগতিশীল বইপত্রকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তাদের লেখক ও প্রকাশকদের গ্রেফতার ও বিভিন্ন হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ লেখালেখি একটি স্বাধীন পেশা, জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে প্রস্তাবিত ফ্রিডম অফ স্পিচ আর এক্সপ্রেশনের স্বাধীনতাকে তুড়ি মেরে বই, প্রকাশক, লেখক ইত্যাদিকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশকে প্রগতিহীনতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ! বইমেলাকে তাই বইমেলা নয় বরং কিতাবমেলা হিসেবে এখন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ব্যঙ্গাত্মকভাবে অভিহিত করছেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানে যে কী এমন আহামরি কাজ হচ্ছে – তা আজ পর্যন্ত বোধগম্য হলো না।



আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক উৎসব নেই বলে বাংলা একাডেমীর বইমেলাই প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসব হয়ে উঠেছে যার কৃতিত্বের মূলে মুক্তধারা নামক নামকরা প্রকাশনী সংস্থার চিত্তরঞ্জন সাহা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি ৮ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউসের সামনে বটতলায় একটুকরো চটের উপর কলকাতা থেকে আনা ৩২ টি বই সাজিয়ে তিনি স্বাধীন দেশের প্রথম বইমেলা শুরু করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত একাই তিনি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে মেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ তার সাথে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমী বইমেলার সাথে সরাসরি সংযুক্ত হয়। ১৯৭৯ সালে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এ সংস্থাটিও সংগঠিত করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। এই মানুষটি মনেপ্রাণে ধন্যবাদার্হ এবং শ্রদ্ধার পাত্র কিন্তু বাংলা একাডেমী নিন্দার্হ যে এতো বছর ধরে মেলা আয়োজন করেও কর্তৃপক্ষ এই মেলার কোনো সংস্কারসাধন করতে পারেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তথা নামকরা বইমেলা ফ্র্যাংকফুর্টের চাকচিক্য আমাদের বইমেলায় থাকতে না পারে কিন্তু অন্তত কোলকাতা বইমেলার মানের কাছাকাছি তো হওয়া উচিত ছিলো ! তাও সম্ভব হয়নি। আমাদের বইমেলা হচ্ছে গ্রামের নদীতীরের মেলার মতোই সেকেলে। এই মেলায় ধুলোতে আকাশ ঢেকে যায়, বাশি আর ঢোল বাজে, চটফটি, ফুচকা আর চানাচুর ঝালমুড়ির গন্ধ ওড়ে। বইমেলার বাঁশের স্টলগুলো অত্যন্ত সাদামাটা, বইমেলার যে একটি সৌন্দর্য থাকা উচিত তার কিছুই নেই আমাদের বইমেলায়। এই বইমেলায় আজকাল শোভা পায় আলতুফালতু বিষয়বস্তুহীন বিভিন্ন বই যার মধ্যে জ্ঞানের ‘জ্ঞ’ টিও নেই। আজকাল যে কেউই যা খুশি তাই লিখে বই লিখেছে বলে দাবি করছে যাদের শিক্ষাদীক্ষা ও জীবনঅভিজ্ঞতা কিচ্ছু নেই। কিছু সস্তা প্রেমের উপন্যাস, বৈজ্ঞানিক ভুতের গল্প, কিভাবে জিহাদ করা যায়, কিভাবে স্ত্রীকে বশ করা যায়, কিভাবে সাফল্য লাভ করা যায়, কিভাবে যৌনসক্ষমতা ধরে রাখা যায়, কিভাবে পরকীয়া থেকে স্বামী/স্ত্রীকে বাঁচানো যায় – এসব চটিবইগুলোই এখনকার বইমেলার শোভা। ব্যক্তিগত উদ্ভট ধারনা সংবলিত হযবরল টাইপের হাস্যকর, অবিজ্ঞানময় সস্তা বইপত্র দিয়ে এখনকার বইমেলা ভর্তি। মৌলিক চিন্তাসম্পন্ন বই একদমই নেই। কতিপয় অনুবাদগ্রন্থ, রবীন্দ্র/শরৎ/সুনীল রচনাবলী আর কিছু পুরোনো বই এগুলোই বইমেলার একমাত্র সম্বল। একে তাই বইমেলা না বলে কিতাবমেলা বলাটাই মনে হয় যুক্তিযুক্ত হবে। বর্তমানে কবিতার বইগুলো পড়লে মনের অজান্তেই খিলখিলিয়ে হাসি পায় ! জাস্ট অন্ত্যমিল বজায় রাখলেই কী তাকে কবিতা বলে ? এযুগের লেখক ও কবিদের ভাষাজ্ঞান অত্যন্ত দুর্বল, তাদের বাক্য সংগঠন খুবই সরল – ক্লাস ফাইভের শিশুর পাঠ্যবইয়ের মতো, তাদের বাক্য সংগঠনও অনেক ক্ষেত্রেই ভুল, যতিচিহ্ন রহিত এবং লেখার মধ্যে ভাষার যে সৌন্দর্য, রূপক ও উপমার যথাযথ ব্যবহার, তৎসম শব্দের প্রয়োগ - তার ছিটেফোঁটা প্রকাশ পায় না। হুমায়ুন আহমেদের অপন্যাসগুলো তরুণ প্রজন্মকে ভুল পথে চালিত করেছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মানের দুর্বলতার কারণে তারা যেহেতু সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল, যেহেতু তারা আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়ে দেখার সুযোগ পায়নি বা গতানুগতিকতার সীমা পেড়িয়ে মনেপ্রাণে আধুনিকতাকে ধারণ করতে পারেনি, তাই তাদের কাছে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’র পাগলামি কিংবা হালকা ধাঁচের গতানুগতিক আটপৌরে প্রেমের কাহিনীকেই অনন্য অসাধারণ মনে হয়েছে। গ্রামের যুবক ঢাকায় এসে বড় বড় হাই রাইজ বিল্ডিং দেখলে যেমন তাদের চোখ বড় বড় হয়ে যায় এবং ভাবতে শুরু করে এর ওপরে আর কিছু হতে পারে না, ঠিক তেমনি হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসগুলো পড়ে এদেশের তরুণ প্রজন্মের ঠিক একই রকম অবস্থা হয়েছে। জাফর ইকবাল যদিও বেশ কিছু ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক অবদান রেখেছেন, তবুও পশ্চিমা সায়েন্স ফিকশন থেকে নকল করে লেখা তার বৈজ্ঞানিক ভুতের গল্প শিশু কিশোরদের মাথার ঘিলুকে আরো দুর্বল করে দিয়েছে। এসব নকল সায়েন্স ফিকশন তরুণ প্রজন্মের জ্ঞানবিকাশ ও জ্ঞানপ্রসারে কোনো ভূমিকা রাখতে তো পারেইনি বরং তাদের আরো অবাস্তব, উদ্ভট চিন্তাভাবনার দিকে ঠেলে নিয়ে গেছে।

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ইংরেজি হয়ে উঠেছে ক্ষমতা, অর্থ, গৌরব আর সামাজিক সম্মানের ভাষা আর সেই দেশের মাতৃভাষাগুলো হয়ে আছে শক্তিহীনতা, অর্থহীনতা, লজ্জা, অগৌরব ও সামাজিক সম্মানহীনতার ভাষা। উল্লেখ্য যে, মাতৃভাষাকে শক্তিশালী করার মানে বিদেশী ভাষাগুলোকে ঘৃণা করা নয়। অবশ্যই শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদান রাখা গুরুত্বপূর্ণ বইসমূহ আমাদের পড়তে হবে এবং সেজন্য সেসব ভাষা শেখা অবশ্যই ইতিবাচক কিন্তু বিদেশী ভাষাই প্রভু হয়ে উঠবে আর নিজের ভাষার চর্চা একেবারেই ভুলে যেতে হবে – এমনটা সমীচীন নয়। আজকে আমরা কম্পিউটার ও মোবাইলে বাংলা ভাষাকে ঢোকানোর জন্য ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে যা করছি, সেটি যথেষ্ট নয়। সরকারের উচিত কম্পিউটার, মোবাইলসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল ক্ষেত্রে বাংলাকে সহজভাবে মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা। কেন আমরা চিরকাল ভিক্ষুক মানসিকতাসম্পন্ন থাকবো যে নিজেরা কিছু সৃষ্টি করার বদলে অন্যদের অনুকরণ করবো, আমদানি করবো, ভিক্ষা করবো ? কেন আমাদের দেশের মানুষ বাংলাতেই কোনো কম্পিউটার বা মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করতে পারলো না ? এর প্রধান কারণ নিজের ভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টি না হওয়া এবং চর্চা না করা।



মুঠোফোনের এসএমএসে বানান ও ব্যাকরণগতভাবে অশুদ্ধ বাংলা লেখার মাধ্যমে বাংলাভাষাকে যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, যেভাবে বেতারে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে, যেভাবে এফএম রেডিওর অশিক্ষিত রেডিও জকিগুলো অশুদ্ধ বাংলা লিখে যাচ্ছে, যেভাবে বিভিন্ন অভিনেতাঅভিনেত্রীদের মুখে ‘করসি’, ‘খাইসি’, ‘পরসি’র মতো অশুদ্ধ বাংলা শোনা যাচ্ছে নাটক চলচ্চিত্রে তাতে কোন না কোনো দিন যে আমাদের বলিভিয়ার ভাগ্য বরণ করতে হবে না, তা কে জানে? পঁচাত্তর পরবর্তী নব্য অভিজাত শ্রেণী বাংলার পরিবর্তে ক্রমশ ঝুঁকে পড়েছে ইংরেজি ভাষার প্রতি। বিদেশের অন্ধ অনুকরণ করতে যেয়ে আজ দাপ্তরিক কাজগুলোতে ইংরেজি ব্যবহারের প্রচলন দেখা যায়, দোকানের বাংলা নাম ইংরেজিতে লেখা হয়, বিয়ে, জন্মদিন, মিলাদ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র লেখা হয় ইংরেজিতে, অধ্যাপকগণ ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময় প্রায়ই ইংরেজি ভাষায় লেকচার দেন, অনেক ক্ষেত্রেই যদিও তা একদম পুরোপুরি শুদ্ধ ইংরেজি নয়। আমলা, মন্ত্রী এবং তথাকথিত শিক্ষিতগণ প্রচার মাধ্যমে না বলতে পারেন শুদ্ধ বাংলা না বলতে পারেন শুদ্ধ ইংরেজি, তারা বাংলা ও ইংরেজির এক বিকট মিশ্রণে কথা বলেন। এই যে শপিং মল শব্দটি, এটিকে কী বিপণী বিতান বলা যায় না ? মডেল টাউনকে আদর্শ নগর, মোবাইলকে মুঠোফোন, প্রেসক্রিপশনকে ব্যবস্থাপত্র – বললে আমাদের কী এমন ক্ষতি হয় ?



১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর বিগত প্রায় এক যুগে এশিয়া -আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশে বহু ভাষা মরে গেছে, বহু ভাষা চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে। লন্ডনের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক পিটার কে অস্টিনের মতে পৃথিবীজুড়ে বিদ্যমান সাত হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় চার হাজার ভাষাই এখন বিপন্ন। বিগত দুই বছরে তিন শ’য়ের বেশি ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেছে এবং এ ঘটনা ঘটেছে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পরে। একুশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিপন্ন হাজার তিনেক ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে বলে ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন। ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি বা সোয়াহিলির মতো রাজনৈতিক অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভাষাগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়বে দুর্বল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। জেরু, খোমানি, ওরো উইন, কুসুন্ডা, আইনু, গুউগু যিমিধিইর, কেট, বো–এসব ভাষা খুব শিগগিরই হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন পিটার কে অস্টিন। ইতোমধ্যে ২০১০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলোর একটি বো ভাষায় কথাবলা বোয়া সিনিয়র নামের একমাত্র মানুষটির মৃত্যু হয়েছে। আন্দামানের পোর্ট ব্লোয়ারে বোয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হারিয়ে গেল বো ভাষা। আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যে এমনি হারিয়ে যাবে শত শত ভাষা। ভাষা সাম্রাজ্যবাদ যে শুধু ইংরেজি, হিন্দী, স্প্যানিশ ভাষাগুলোই দেখিয়ে যাচ্ছে, তা নয়। একটি দেশে একাধিক ভাষা থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান ভাষাটির দাপটের শিকার হচ্ছে অন্যান্য ভাষাগুলো। বাংলাভাষা যেমন ইংরেজি কিংবা হিন্দীর কাছে দাঁড়াতে পারছে না তেমনি বাংলাদেশের আদি নৃগোষ্ঠীর ভাষাসমূহও দাঁড়াতে পারছে না বাংলা ভাষার কাছে। কেন্দ্রের দাপটে প্রান্তিক মানুষদের মতো প্রান্তের ভাষারও আজ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কেন্দ্রলাঞ্ছিত প্রান্তের জনগোষ্ঠীর ভাষাসমূহের উন্নয়নের পরিবর্তে লক্ষ করা যায় কেবলি বিপন্নতা, কেবলি অবহেলা। প্রান্তিক মানুষদের মাতৃভাষা রক্ষাকল্পে কার্যকর কোনো উদ্যোগ বাংলাদেশে নেওয়া হয়নি। সংখ্যালঘু বলে কেউ তাদের ভাষার কথা ভাবে না, কারো এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই আর সমাজে তাদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত না বলে তাদের মধ্যে থেকেও কোনো মাথা নিজেদের ভাষার পক্ষে দাবি নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না।

টেলিভিশন আর ইন্টারনেটের দৌরাত্ম্যে আজ আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির প্রতি কোনো আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায় না। যারা তারপরও শহীদ মিনারে যায়, তাদের মূল লক্ষ্য থাকে তাদের প্রেমিক প্রেমিকার সঙ্গে দেখাসাক্ষাত বা শুধুমাত্র মজার উদ্দেশ্যে ঘোরাঘুরি করা। আবার তরুণ প্রজন্মের অনেকে সারা রাত ইংরেজি বা হিন্দী চলচ্চিত্র দেখে সকালবেলা প্রভাতফেরিতে ছোটে যা স্ববিরোধিতার নামান্তর এবং হাস্যকর। শহীদ মিনারে খালি পায়ে ওঠার যে রীতি রয়েছে এই রীতি যদি মাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনেই সীমাবদ্ধ থাকে আর বাকি দিনগুলোতে না থাকে তাহলে এই রীতি তুলে দেওয়াই উচিত কেননা এই রীতির কারণে দেশের জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই প্রভাতফেরিতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকে। ফলে, শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের সাথে এদেশের জনগণের সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে খালি পায়ের সেন্টিমেন্টের বিপক্ষেই আমার অবস্থান কেননা এমন কোনো আইন নেই যে খালি পায়ে ছাড়া শ্রদ্ধা নিবেদন করা সম্ভবই নয়। এদিকে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এই ফুলদানকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার করে আসছে। বস্তুত, এটি যদি ইসলামবিরোধী হয় তবে অনেক কাজই ইসলামবিরোধী যেমন টেলিভিশন দেখা, গান শোনা, চলচ্চিত্র দেখা ইত্যাদি। ফুল একটি প্রতীকী বিষয় যার মূল উদ্দেশ্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। এই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মধ্যে কোনো হিংস্রতা নেই, উগ্রতা নেই বা এর কারণে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় না, কোনো অকল্যাণই সাধিত হয় না। সুতরাং, ফুল দেওয়া নিয়ে মৌলবাদীদের এসব যুক্তিহীন ওজরআপত্তির কোনো অর্থই হয়না।



পরিশেষে এটাই বলতে চাই, সমাজ ও আমাদের জীবনের সর্বস্তরে শুদ্ধভাবে নিজের মাতৃভাষাকে বলতে ও লিখতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাংলাদেশীদের মধ্যে এটির চরম অভাব রয়েছে। আমরা যেন বানান ও ব্যাকরণ সচেতন হয়ে অতঃপর ফেসবুকে বা অন্যান্য মাধ্যমে কোনো কিছু লিখি এবং প্রুফ রিডিং দিয়ে অতঃপর সেটিকে পোস্ট করি, দায়সারাগোছে প্রুফ রিডিং না দিয়েই নয়। উদ্ভট বানান ও ভুল ব্যাকরণে বাংলা লিখলে ভাষা বিকৃতি দিনদিন আরো প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে, এতে ভাষার বিকাশ ব্যহত হয়। কথ্য ভাষার ক্ষেত্রে যেন ‘করসি’, ‘খাইসি’, ‘পড়সি’ এর বদলে শুদ্ধভাবে ‘করেছি’, ‘খেয়েছি’, ‘পড়েছি’ – ইত্যাদি ব্যবহার করি। প্রমিত ভাষায় কথা বলা ও লেখার অভ্যাস তৈরি হলে আমাদের বাংলা ভাষা আরো বেশি আধুনিক তথা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:২৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×