আমার বিশ্বাস একুশ শ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে আমাদের পরিচয় হবে দক্ষিণ এশীয়। এর আগেও হতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করছে এ অঞ্চলের নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও বাস্তব প্রচেষ্টার উপর।
কিছুদিন আগে দিল্লিতে চৌদ্দতম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সেখানে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অভিন্ন মুদ্রা চালুর আহ্বান জানালেন। ১৩তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আশপাশের সময় এ নিয়ে উপমহাদেশীয় পত্রপত্রিকায় বিশ্লেষণধর্মী ও তাত্ত্বিক লেখালেখিও হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়া অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (সাপটা) স্বাক্ষরিত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৯৫। সাপটারই অগ্রসর সংস্করণ ২০০৪-এর ৬ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত সাফটাÑ দক্ষিণ এশীয় মুক্তবাণিজ্য এলাকা চুক্তি। ১ জানুয়ারি ২০০৬ থেকে সাফটা কার্যকরও হয়ে গেছে এবং পর্যায়ক্রমে ২০১৫ সালের মধ্যেই এর সকল চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা।
সার্ক দেশের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিরা দক্ষিণ এশীয় দেশে আগাম ভিসা না নিয়েই (অর্থাৎ ভিসাবিহীন) যাতায়াত করতে পারছেন। সাম্প্রতিক সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে প্রতিটি সার্কভুক্ত দেশের ৫০ জন করে সাংবাদিককে দক্ষিণ এশীয় ভিসা স্টিকার দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পরিধি ধীরে ধীরে আরো বাড়বে। এভাবে একসময় এ অঞ্চলের সকল নাগরিকের জন্য সীমান্ত উš§ুক্ত হতে খুব বেশিদিন লাগবে কি?
ভারতের সঙ্গে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার ভিসার নিয়মাবলি এমনিতেই অত্যন্ত শিথিল। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশেরও ভিসার কড়াকড়ি নেই। শ্রীলঙ্কা বহু আগেই দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকদের জন্য ভিসামুক্ত যাতায়াত সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করে রেখেছে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের থিম ‘ফিল কানেকটিভিটি’। এই থিম লালনের ‘বাড়ির পাশে আরশীনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে’র কথাই কি মনে করিয়ে দেয় না আমাদের?
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াতের সুবিধা ক্রমেই সহজ থেকে সহজতর হবে। আশা করা যায়, ঢাকার সঙ্গে কলকাতার রেল যোগাযোগ পুনরারম্ভ হবে আগামী জুলাই মাসে। ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-আগরতলা বাসচলাচল চালু হয়েছে। একইভাবে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেও ট্রেন ও বাস চলাচল অব্যাহত আছে অনেকদিন। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নতি হয়ে যাবে আগামী ২০/২৫ বছরের মধ্যেই।
এবারের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যার ক্যাস্পাস থাকবে সার্কভুক্ত সব কটি দেশে। এভাবে আগামী বছরগুলোতে প্রতিটি দেশে দক্ষিণ এশীয় বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এ সব প্রতিষ্ঠানে বিনির্মিত হতে শুরু করবে দক্ষিণ এশীয় চিন্তাচেতনার নাগরিক।
দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মানুষ এ পৃথিবীর ২৫ শতাংশের বেশি জনসংখ্যা সমৃদ্ধ। আমাদের রয়েছে প্রাচ্য দেশীয় অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আমাদের দারিদ্র্য ও অগ্রগতির অবস্থাও সামঞ্জস্যপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের গর্ব করার মতো কতো কী-ই আছে? মহাস্থানগড়, ওয়ারি বটেশ্বর, হরপ্পা মহেঞ্জোদারো, অজন্তা ইলোরা, লাল কেল্লা, তাজমহল, সালিমার বাগান, প্রাচীন কান্দাহার শহর ইত্যাদি থাকতে ঐতিহ্যের আর কী চাই? আমাদের আছে হিমালয়ের পর্বতরাজি, এভারেস্ট শৃঙ্গ, কে-টু পর্বতমালা ও শৃঙ্গ, সুন্দরবন, কক্সবাজারে পৃথিবীর একটানা দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বত, পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু কোরাল দ্বীপÑমালদ্বীপ। অহঙ্কারের জন্য আমাদের আর কী প্রয়োজন?
যখন দক্ষিণ এশিয়া ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন এ অঞ্চলের ছোট ছোট জাতিসত্তার অথবা আঞ্চলিক স্বাধীনতাকামীদের আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। শ্রীলঙ্কার তামিল, ভারতের কাশ্মিরকে আর শ্রীলঙ্কা অথবা ভারতের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রাণপাত করতে হবে না। কারণ তখন শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ সব দেশেরই স্বাধীন অস্তিত্ব একটি ইউনিয়নে সমর্পিত হয়ে অখণ্ড সামষ্টিকতায় উত্তীর্ণ হবে।
নেপালের মাওবাদীরা যে সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে প্রকাশ্য ও মূলধারায় চলে এসেছে সেটা সম্ভবত এই ভবিষ্যৎ উপলব্ধি থেকেই। ভুটানেও যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন শুরু হয়েছে সেটাও এশীয় ইউনিয়ন গঠনে বিশেষ সহায়ক হবে।
দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন হলে নিজেদের মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কলহ আর যুদ্ধের আশঙ্কা থাকবে না। তাই সামরিক খাতে ব্যয় কমবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। সামরিক খাত থেকে বেঁচে যাওয়া অর্থ (ঢ়বধপব ফরারফবহফ) আমরা বিনিয়োগ করতে পারবো ব্যাপক দারিদ্র্য নির্মূলে। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে। আমাদের শ্রমবাজার উš§ুক্ত হবে। এতদঞ্চলের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্প-বাণিজ্যের সকল অগ্রগতি ও অর্জনের ফল সমানভাবে ভোগ করতে পারবো সবাই।
দক্ষিণ এশিয়ায় পানিবিদ্যুতের যে সম্ভাবনা, তা আমাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি থেকে মুক্ত রাখবে। আমরা থাকবো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সংস্কৃতিতে ঐশ্বর্যশালী। আমরা হবো পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কমিউন। আর সর্বোপরি এটি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিশাল বৈচিত্র্যের বর্ণাঢ্য জনপদ, যেখানে বিশ্বের অন্যান্য জনপদ থেকে অগণন ভ্রমণপিপাসু পর্যটক বেড়াতে এসে আহ্লাদিত হবেন, অবাক হবেন। সার্কভুক্ত দেশে আসার জন্য আমাদের দূতাবাসগুলোয় আবেদনের পাহাড় জমবে। মানুষের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আমরা গর্বিত হবো।