বগুড়ার শিবগঞ্জে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় শিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে নামাজের প্রস্তুতিকালে মুসল্লিদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় একজন নিহত এবং ইমামসহ তিনজন গুরুতর আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তির নাম মোয়াজ্জেম হোসেন (৭০)। তিনি ওই মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উপজেলার চককানু গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তিদের প্রথমে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসকেরা মোয়াজ্জেম হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অন্তত ১৫ থেকে ১৬ জন মুসল্লি ওই গ্রামের মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে এশার নামাজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওই সময় তিন-চারজন যুবক মসজিদটিতে ঢুকে প্রধান ফটকটি বন্ধ করে দেন। এরপর মুসল্লিদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে পালিয়ে যান। এতে ইমাম শাহিনুর রহমান, মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন, মুসল্লি আবু তাহের ও আফতাব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন।
গুলির শব্দে ভয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে রাত আটটার দিকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন উকিল উদ্দিন (৪৫) নামের একজন মুসল্লি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী উকিল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার অদূরে চককানু আল মোস্তফা মসজিদে গতকাল সন্ধ্যায় শিয়া সম্প্রদায়ের ১৫ থেকে ১৬ জন মুসল্লি মাগরিবের নামাজ আদায় করছিলেন। এ সময় মসজিদের সব জানালা বন্ধ ছিল। খোলা ছিল শুধু পেছনের দরজা।
উকিল উদ্দিন বলেন, শিয়া সম্প্রদায়ের মুসল্লিরা মাগরিব ও এশার নামাজ একই সঙ্গে আদায় করেন। তাঁরা সবাই মাগরিবের নামাজ আদায় করে এশার নামাজের জন্য কাতারে দাঁড়ান। ওই সময় হামলা হয়। তাঁরা দেখতে পান, চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছেন। আতঙ্কিত মুসল্লিরা মসজিদের ভেতর ছোটাছুটি করতে থাকেন।
পেছন থেকে গুলি করার কারণে বন্দুকধারী কারা কিংবা তাঁরা সংখ্যায় কতজন ছিলেন, তা দেখা সম্ভব হয়নি। তবে যেহেতু একসঙ্গে গুলির শব্দ শুনেছেন, সেহেতু বন্দুকধারী একাধিক বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ চারজনকে উদ্ধার করে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে আফতাব উদ্দিন ছাড়া বাকি তিনজনকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে মোয়াজ্জেম হোসেন মারা যান।
২৩ অক্টোবর, ২০১৫: ঢাকায় হোসেনি দালানে গ্রেনেড হামলা, নিহত ২
২৬ নভেম্বর, ২০১৫: বগুড়ায় শিয়া মসজিদে গুলিতে নিহত ১
গতকাল রাত পৌনে আটটার দিকে ওই মসজিদে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উপস্থিত হয়েছেন। মসজিদের মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্ত। কয়েকটি স্তম্ভে গুলির চিহ্ন। মসজিদের সামনে খবর শুনে ছুটে আসেন আশপাশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন। মসজিদের ভেতর থেকে আলামত সংগ্রহ করছেন পুলিশ সদস্যরা।
শিয়া-অধ্যুষিত গ্রামটির কয়েকজন ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, গোলাগুলির শব্দ শুনে তাঁরা মসজিদের দিকে দৌড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু গুলিবর্ষণকারীরা আগেই মসজিদে প্রবেশের মূল ফটকটি ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখায় তাঁরা ঢুকতে পারেননি। খুব দ্রুত ঘটনা ঘটিয়ে গুলিবর্ষণকারীরা মসজিদের সামনের দেয়াল টপকে পালিয়ে যান।
মসজিদের পিলারে গুলির আঘাতের চিহ্ন (বাঁয়ে)। আহত শাহীনুর রহমান বগুড়া মেডিকেলে l ছবি: প্রথম আলোশিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, কে বা কারা, কেন এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা এখনই বলা যাবে না।
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ তিনজনকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসা কর্মকর্তা এস এম জাহিদুল ইসলাম মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেমকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামের মৃত বশির উদ্দিনের ছেলে।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্য দুজন হলেন মসজিদের ইমাম শাহিনুর রহমান (৩০) এবং মুসল্লি ও রাজমিস্ত্রি আবু তাহের (৬০)। রাত নয়টার পর তাঁদের শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়।
জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা এস এম জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মোয়াজ্জেম হোসেন মারা যান। আবু তাহেরের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর ঊরুর ওপরের অংশে গুলি লেগেছে। শাহিনুর রহমানের কোমরে গুলি লেগেছে। তবে তিনি আপাতত শঙ্কামুক্ত।
হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের বাইরে বাবার জন্য অঝোরে কাঁদছিলেন গুলিবিদ্ধ আবু তাহেরের মেয়ে তৌহিদা বেগম (৩৫)। তিনি বলেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন তাঁর বাবা। কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতাও নেই। অথচ অজানা শত্রুরা এভাবে তাঁর বাবাকে গুলি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান রাত নয়টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথাও বলেছি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, এটি দুর্বৃত্তদের হামলা। কারা, কী উদ্দেশ্যে এ হামলা করেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।’ বন্দুকধারীরা কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, তদন্ত না করে বলা সম্ভব নয়। সবকিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে আপাতত বলা যায়, এটা দুর্বৃত্তদের পরিকল্পিত হামলা।
গত তিন মাসে এই নিয়ে শিয়া সম্প্রদায়ের স্থাপনা ও ব্যক্তির ওপর তিনটি হামলায় নিহত হয়েছেন চারজন। নিষিদ্ধঘোষিত জেএমবির একটি অংশ শিয়াদের ওপর এই হামলা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
গত ২৩ অক্টোবর গভীর রাতে রাজধানীর পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় হোসেনি দালানে হাতে তৈরি গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে দুজন নিহত ও দেড় শতাধিক মানুষ আহত হয়। ওই গ্রেনেড হামলার আগের রাতে রাজধানীর গাবতলীতে এক ব্যক্তির ব্যাগ তল্লাশির সময় ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে। ঘটনাস্থল থেকেই পুলিশ মাসুদ রানা নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে। মাসুদ রানার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ২৩ অক্টোবর ভোরে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে একটি মেসে অভিযান চালিয়ে পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে পাঁচটি হাতে তৈরি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। মাসুদের তথ্য মোতাবেক বগুড়া সদর ও আদমদীঘি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় নেতাসহ ২৮ জনকে। ১০ নভেম্বর রংপুরের কাউনিয়ায় মাজারের খাদেম রহমত আলীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১২ নভেম্বর সৈয়দপুরে স্থানীয় শিয়া ইমামবাড়ার খাদেমকে কুপিয়ে জখম করা হয়।
ঢাকা মহানগর ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেএমবির একটি অংশ ঢাকা, রংপুর ও সৈয়দপুরে শিয়া স্থাপনা এবং বিভিন্ন মাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের হত্যা ও হামলার সঙ্গে জড়িত।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। যারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে আইএস রয়েছে—তা প্রমাণ করতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক সব ঘটনা একই গোষ্ঠী ঘটাচ্ছে। তারা দেশের একেকটি জেলায় একেকবার নাশকতামূলক কার্যক্রম করছে। এমন পরিস্থিতির তৈরি করা হচ্ছে, যাতে এ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা হয়। ঘটনাগুলো একটার সঙ্গে একটা মেলালে তাই বোঝা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:৩৭