প্রায় আট বছর যাবত সৌদি আরব বসবাস করছি, বাংলাদেশি মানুষের জন্য অন্যতম প্রধান কর্মসংস্থানের নাম হচ্ছে সৌদি আরব। প্রায় সব বয়সের মানুষকে কাজের সন্ধানে এই দেশটিতে আসতে দেখেছি। কৌতুহল বসত অনেকের কাছেই জানতে চেয়েছি কেন আসেন জীবনের শেষ বয়সে প্রবাসে? তাদের সাবলিল উত্তর থাকে দেশে কাজ নেই, যা ইনকাম থাকে তাতে সংসার চলেনা। ঢাকায় নিজের বাড়ি আছে এমন লোককেও মধ্যবয়স পার করে এই দেশটাতে কাজের সন্ধানে আসতে দেখেছি। তাদের উত্তর থাকে আগে অন্য কোন দেশে ছিলো সেখানে থেকেই ঢাকায় বাড়ি করেছেন। শেষে ভেবেছেন দেশেই কিছু করবেন কিন্তু পরিস্থিতি তাদের সাথে থাকে না, অবশেষে যখন আবার প্রবাসে পাড়ি জমাতে চান তখন সবাই বেছে নেন এই সৌদি আরবকে। সেক্ষেত্রে তাদের উত্তর থাকে শেষ বয়সে অন্তত ওমরা হজ্জটা করতে পারবেন।
এখন আসি মূল কথায়, এতোদিন যাবত থেকে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা অগণিত। হয়তো লিস্ট করে বললে অনেক লম্বা হয়ে যাবে তবে সংক্ষেপে বললে এমন দাঁড়ায় যে বর্তমান সময়ে সৌদি আরবে কর্মসংস্থান সংকির্ণ হয়ে আসছে। কেননা মুহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরবকে ঢেলে সাজাতে তার নতুন আইন কর্মসংস্থানগুলোকে সৌদিকরণ করার কারণে প্রায় সিংহভাগ কর্মসংস্থান হারিয়েছে প্রবাসিরা। সৌদি নাগরিকগণ হেন কোন কাজ নেই যা তারা এখন করছে না। যেকোন কাজই এখন তারা করতে চাচ্ছে, কয়েক বছর আগেও যা দেখা যেতো না। সৌদি মহিলাদের ঢালাওভাবে তারা কাজ দিচ্ছে, যেকোন রিসিপশনিষ্ট ক্যাশিয়ার বা কফিশপগুলোতে তাদের চড়া বেতনে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মক্ষিণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের প্রবাসিরা। যারা আগে হয়তো কোন ক্যাশিয়ার বা রিসিপশনিষ্ট ছাড়াই তাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন তাদের এখন বাধ্য হয়েই অপ্রয়োজনীয় এই বেতনের টাকাটা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এবার বলি সাধারণ কর্মিদের কথা। যারা দুই দেশের সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে একেকটা ভিসা ২ থেকে ৩ গুন বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। সিন্ডিকেট কেন বললাম তা সহজেই বুঝবেন যখন আমাদের পাশের দেশের মানুষগুলোকে ৬০ থেকে ৮০ হাজার রুপিতে সৌদির ভিসা কিনে সৌদিতে আসতে দেখবেন। আর আমাদের দেশের মানুষকে কিনতে হয় সর্বনিম্ন ৪ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা দিয়ে। এখন আপনার উপর ছেড়ে দিলাম এটাকে কিভাবে যাস্টিফাই করবেন।
এতো চড়া দামে ভিসা কিনে যখন এই লোকগুলো সৌদিতে এসে পৌঁছান তখন এসে পড়েন আরেকদল দালালের হাতে, যারা তাদের বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে মুনাফা খেয়ে থাকে। এখানকার স্থানীয় ভাষায় যেটাকে সাপ্লাই ভিসা বলে চিনে সবাই। ধরুন আমার নিজের একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য লোক হায়ার করবো তখন আমি এইসকল সাপ্লাই কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করবো তারা আমাকে আমার চাহিদা মতো লোক দিবে আর আমি তাদের নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ অর্থ প্রদান করবো। কিন্তু এখানে যে করুন বিষয়টা হয় তা হলো এই সাপ্লাই কোম্পানিগুলো সাধারণ শ্রমিকদের সেই অর্থটা প্রদান করে না। তারা এখান থেকে নিজেদের সুবিধামতো টাকা রেখে শ্রমিকদের ১২-১৮শ রিয়াল প্রদান করে থাকেন। বর্তমানে সৌদিতে প্রায় ৮০% কোম্পনিতে কাজ করে যারা তারা এর আওতায় পড়ে।
এবার আসি এই পরিমাণ বেতনে তাদের ডিউটি টাইম নিয়ে। সৌদি আরবে শ্রমিক আইন মেনেই ৮ ঘন্টা ডিউটি টাইম ধার্য করা আছে। অথচ এইসকল কোম্পানিতে যারা কাজ করেন তারা ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা ডিউটি করে থাকেন। তারা সঠিক আইন না জানার জন্য কোন প্রশ্নও করতে পারেন না, আর কেউ প্রশ্ন করলে তাদের উপর ঐসকল সাপ্লাই কোম্পানিগুলো বিভিন্নভাবে হয়রানি করে থাকে। যার প্রমান হয়তো গত সপ্তাহে স্যোশাল মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে আপনারা পেয়েছেন। যেখানে "টাইম কোম্পানি" নামে একটা কোম্পানি তাদের কর্মিদের জাহেলি যুগের মতো অত্যাচার করছিল। দোষ ছিলো যে কাজে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো সে কাজ তাদের পছন্দ হয়নি। তাদের বিরোদ্ধে যেয়ে আপনাকে কিছুই করার ক্ষমতা থাকবে না যদি আপনি সঠিক নিয়ম-কানুন না জানেন।
এবার বলি যারা কোম্পানির বাইরে কাজ করেন তাদের ব্যাপারে, এক্ষেত্রে অনেকেই সুবিধাজনক জায়গায় আছেন কিন্তু সেটা খুবই কমসংখ্যক লোক। যাদের বিভিন্ন ধরনের কাজে দেখা যায়। তারমধ্যে অন্যতম হলো ট্যাক্সি ড্রাইভিং। এদের প্রায় সবারই আগে থেকেই কোন না কোন আত্মীয়-স্বজন সৌদিতে বাস করে থাকেন। যাদের সহায়তা এবং সাহয্যে তারা এই ব্যয়বহুল পেশাতে জড়িয়ে থাকে। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে শুরু করে গাড়ি কেনা সবই তারা তাদের সাহায্য নিয়ে করতে হয়। এখানেও মাঝে মাঝে সমস্যার সম্মক্ষিণ হতে হয় ভাল কফিল (যেই সৌদির আওতায় তাকে থাকতে হয়) না পেলে।
এবার বলি একজন কর্মির প্রতি মাসের খরচ নিয়ে। ম্যাচ বা হোস্টেল পদ্ধতিতে থাকলে একরুমে গাদাগাদি করে ৫-৬ জন থাকা লাগে আর খরচও সাশ্রয় হয়। সেক্ষেত্রে ৫০-১০০ রিয়াল হবে রুম ভাড়া। আর খাবার ও একই পদ্ধতিতে করে থাকলে ৩০০-৪০০ রিয়াল লেগে যায়। তারপর একজন মানুষের প্রতি মাসের মোবাইল খরচ প্রায় ১০০-১৫০ রিয়াল (সর্বনিম্ন/ এখানে ইন্টারনেট প্যাকেজ বহুমূল্য)। তারপর আপনার দৈনন্দিনের প্রসাধনি আর হঠাৎ হঠাৎ বাইরে একবেলা ভাল খাবার গ্রহণের ইচ্ছে ব্যাক্তির উপর ছেড়ে দিলাম। এভাবে একজন লোককে সর্বনিম্ন ৫০০-৭০০ রিয়াল প্রতিমাসে খরচ করতেই হবে। তাহলে বাকি থাকলো কতো বেতন থেকে?? আর যারা মুন্সিপলিটি বা বলদিয়ায় (আমাদের দেশের সিটি কর্পরেশন) কাজ করেন তাদের বেতনই হয় ৬০০ রিয়াল তবে থাকা ফ্রি। দেশে কত পাঠাবেন?? এতো এতো টাকা ব্যয় করে কী আসলেই আপনার মধ্যপ্রাচ্যে (বিশেষ করে সৌদি আরব) আসা ঠিক হবে ?? ভেবে দেখবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ১২:১৪