অপরাধপ্রবণ বাঙালী
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি যখন প্রথম মহাভারত পড়ি, তখন কোনো এক পর্বে যা পড়েছিলাম তা স্মৃতি থেকে বলছি (পরে আবারও পড়েছি, কিন্তু কোন পর্বে মনে নেই)- বঙ্গ পাণ্ডববর্জিত দেশ, ম্লেচ্ছ ও পক্ষিসদৃশ জাতির বাস। পাণ্ডববর্জিত দেশ অর্থ নিকৃষ্ট দেশ, অর্থৎ অসভ্য-ইতর শ্রেণির লোকের দেশ। পুরাণে একথাও কোথাও যেন পড়েছি যে কেউ ম্লেচ্ছ দেশে গেলে ফিরে গিয়ে তাকে প্রায়শ্চিত্য করতে হত। প্রায়শ্চিত্য করার ব্যাপারটি কুসংস্কার, এই আলোচনায় না গিয়ে আমরা মোটের ওপর যা দেখতে পাই তা হলো বঙ্গের মানুষ বর্বর বা অসভ্য। প্রাচীনকালের যে ষোলটি মহা জনপদের নাম উল্লেখ আছে পুরাণে, তাতেও বঙ্গের নাম নেই। প্রথমবার পড়ার পর একজন বঙ্গবাসী হিসেবে আমার বেশ রাগ হয়েছিল কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাসের প্রতি, তখন রামায়ণ-মহাভারতকে নির্বোধের মতো ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করতাম, সাহিত্য হিসেবে নয়। চেতনে-অবচেতনে অনেকবার আমার মাথায় মহাভারতের এই কথাগুলো এসেছে। ভেবেছি মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাসকে নিয়েও, তিনি তো আর খাঁটি ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় নন, ব্রাহ্মণরা লিখলে না হয় বলতাম ঘৃণা থেকে লিখেছে। কিন্তু তিনি তো ধীবরকন্যা সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্র, গায়ের রঙও কালো। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে সেই সময়ে ওই অঞ্চলের নিন্মবর্ণের মানুষেরাও বঙ্গের মানুষকে অসভ্য-বর্বর মনে করত।
আমার বয়স যত বাড়তে থাকে, আমার চারপাশের মানুষ ও সমাজ যত দেখতে থাকি, কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাসের প্রতি রাগ তত কমতে থাকে, এখন আর তাঁর প্রতি কোনো রাগই নেই। কেননা এখন তাঁর মতো আমারও একই উপলব্ধি যে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ইতর, বর্বর, লোভী, প্রতারক, লুণ্ঠনপ্রিয়, ধর্ষকামী হচ্ছে বাঙালী জাতি (পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বাঙালী। খুব বেশি অতীতে যাবার দরকার নেই, গত দশ-বারো বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি একটা উদাহরণ দিই, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের পরে যে সহিংসতা হয়, সারা ভারতে আর কোথাও এমন নজিরবিহীন সহিংসতা দেখা যায় না)। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ অপরাধ প্রবণ।
সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ, গবাদীপশু, কুকুর, বিড়াল, পোকামাকড় সবাই বন্যার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত, এমনকি বিষধর সাপও! কোথাও কোথাও ঘরের ছাদ পর্যন্ত জল, ঘরের জিনিসপত্র ডুবে গেছে, ভেসে গেছে, অসহায় মানুষের কিছুই করার নেই। বৃষ্টির মধ্যে ঘরের ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। এই সময়ে তাদের দরকার একটু নিরাপদ আশ্রয়, একটু খাদ্য, একটু বিশুদ্ধ জল। অথচ মানুষের এই বিপদকে পুঁজি করে তাদেরকে জিম্মি করে ফেলেছে তাদেরই প্রতিবেশি মানুষরূপী এক শ্রেণির জানোয়ার! ৮০০ টাকার নৌকা ভাড়া ৫০,০০০; একটা মোমবাতির দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা; ৫০ টাকার রিক্সাভাড়া ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা; নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ইতর ব্যবসায়ীরা, যা তারা সুযোগ বুঝে সারাবছরই করে! এই অরাজকতার বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নেবার জন্য মানবাধিকার কমিশন দাবি জানিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, শোনা যাচ্ছে মানুষের অসহায়তার সুযোগে শুরু হয়েছে চুরি-ডাকাতি; ভাবা যায়, কী পাষণ্ডদের দেশে আমরা বাস করি! এই নৈরাজ্য একদিনে তৈরি হয়নি, অনেক অপরাধের পরিচর্যার ফল আজকের এই নৈরাজ্য।
অথচ এই এরাই গত ১০ জুন জুম্মার নামাজের পর ভারতের নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে মিছিল করে সিলেট-সুনামগঞ্জের মাটি কাঁপিয়ে দিয়েছে, তখন এরা নিষ্কলুষ মহান ধার্মিক ছিল!
ঈদ এলে বাস-লঞ্চের ভাড়া দেড়গুণ-দ্বিগুণ হয়ে যায়, টাকা যায় রাজনীতিক আর পুলিশের পকেটে। আমলারা ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্ত, ব্যবসায়ীরা সরকারকে উপঢৌকন দিয়ে মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। সাংবাদিক বিক্রি হয়ে যায় অথবা স্বাধীন সাংবাদিকতা করা যায় না,কর্পোরেট খুনীর হাতের রক্ত ধোয়ার বাজেটের ৬০ কোটি যায় সংবাদিক এবং গণমাধ্যম মালিকের পকেটে!
কোথাও বাস অ্যাকসিডেন্ট হলে নিমেষের মধ্যে রক্তাক্ত মৃত কিংবা আহত মানুষের গহনা, টাকা, মোবাইল উধাও হয়ে যায়; ধর্ষণের গ্রাফ আকাশচুম্বী!
চিকিৎসার খরচ প্রয়োজনের তুলনায় এত বেশি যে মানুষ ভারতের ভেলোর, চেন্নাই যায় কম খরচে চিকিৎসা করাতে। যাদের সামর্থ্য এবং সময় আছে তারা এখন ভ্রমণ করতেও ভারত কিংবা অন্য দেশে যায়; কেননা আমাদের দেশের পর্যটনের স্থানগুলো নিরাপদ নয়, কিছুদিন আগেও কক্সবাজারে এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, সিলেটে পর্যটকদের মারধর করা হয়েছে, আর কটুক্তির শিকার হওয়া তো ডাল-ভাত! হোটেল-মোটেলের ভাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় অনেক বেশি, গত ঈদের সময় কক্সবাজারে আলুভর্তা ভাত বিক্রি হয়েছে তিনশো টাকায়! রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসততা, অপরাধ প্রবণতা। আর এই অপরাধ করেও দিব্যি পার পাওয়া যায় এই দেশে, একটি অপরাধ আরেকটি অপরাধকে বাড়িয়ে তোলে, এভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কেউ নেই!
প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গ এক অসভ্য জনপদ; আর কালক্রমে এখানে হয়েছে ব্যাপক শংকরায়ন- পর্তুগীজ জলদস্যু, মগ জলদস্যু, ওলন্দাজ টাউট, ইংরেজ বেয়াদব, আরব ডাকাত, ইরাক-ইয়েমেনী ঠকবাজ সুফিরা তাদের বিষাক্ত বীজ ঢেলে বঙ্গের ভবিষ্যত করে গেছে ভয়াবহ-দুর্বিসহ!
আমি বলছি না যে ভারতের অবাঙালীরা একেবারেই অপরাধপ্রবণ নয়, তাদের মধ্যেও অপরাধ প্রবণতা আছে, কিন্তু বাঙালীর অপরাধ প্রবণতার কাছে তা নস্যি!
হ্যাঁ, বঙ্গে কিছু ভালো মানুষ সেই প্রাচীনকালেও নিশ্চয় ছিল, এই এখনও যেমন আছে। কিন্তু অসংখ্য অপরাধীর বিপরীতে মুষ্টিমেয় কিছু ভালোমানুষ সেই প্রাচীন সমাজের অপরাধ প্রবণতা কমাতে এবং বাইরের রাজ্যের কাছে বঙ্গের অপবাদ ঘুচাতে পারেনি; এই একবিংশ শতাব্দীতেও যেমন পারছে না।
ফলে সীমাহীন দুর্দশা থেকেও বাঙালীর মুক্তি মিলছে না কিছুতেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০২২ সকাল ১১:২৭