কুথান বলেন, ‘কোনো কোনো অনার্য জাতি এই চিহ্নকে বলে স্বস্তিকা চিহ্ন। স্বস্তিকা চিহ্ন দুই রকমের হয়ে থাকে- একটা এরকম ডানমুখী, অন্যটা বামমুখী। অনার্যদের বিশ্বাস অনুযায়ী ডানমুখী স্বস্তিকা চিহ্ন সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক। এটাকে তারা আলোকিত এবং শুভ বলে মনে করে। তাই তারা তাদের নগর, গৃহ, মন্দির, বিপণী প্রভৃতির দ্বারে এরকম ডানমুখী স্বস্তিকা চিহ্ন এঁকে রাখে। আর বামমুখী স্বস্তিকা চিহ্ন অন্ধকার বা অশুভ বলে গণ্য হয়।’
নানা বয়সের নারী ও পুরুষকে তোরণের নিচ দিয়ে নগরে প্রবেশ করতে এবং বের হতে দেখা যায়, প্রায় সবাই অনার্য, মাত্র দুজন আর্যকে দেখা যায়। কোনো কোনো নারীর কপালে গোলাকার রক্তিমবর্ণ ফোঁটা এবং কপালের উপরে চুলের মাঝখানে করা সিঁথিতেও রক্তিমবর্ণ একটি দাগ। রক্তিমবর্ণ এই রঙকে সিঁদূর বলে, কেবল বিবাহিত অনার্য নারীরাই কপালে ও সিঁথিতে সিঁদূর পরে, অবিবাহিতরা পরে না। বিবাহিত নারীরা হাতে সাদা চুড়ি পরে, সমুদ্রের শঙ্খ বা শাঁখ কেঁটে তৈরি করা হয় বলে এই চুড়িকে অনার্যরা শাঁখা বলে। কোনো অনার্য নারী বিবাহিত নাকি অবিবাহিত তা বোঝা যায় তাদের কপালের সিঁদূর আর হাতের শাঁখা দেখে। নগরের উচ্চ শ্রেণির মানুষের পরনে সুক্ষ্ম সুতি বস্ত্র আর নিন্ম শ্রেণি এবং নগরের বাইরের পল্লী থেকে আসা মানুষের পরনে মোটা বস্ত্র। আশপাশের উপ-নগর বা পল্লী থেকে প্রতিদিন কৈলাসনগরে লোকেরা আসে তাদের উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রি এবং প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে। দুই চাকার একটা পণ্য বোঝাই গরুর গাড়ী নগরের ভেতর থেকে এসে বাইরে বেরিয়ে যায়, গাড়ীর সামনের দিকে উপবেশিত একজন অনার্য পুরুষ গাড়োয়ান। আসবার পথে ছোট্ট একটি নগরে এরকম গাড়ী প্রথম দেখেন কল্পক, যা তিনি অতীতে কখনো দেখেননি। না দেখারই কথা, কারণ এবারের পূর্বে তিনি কখনো স্বর্গের বাইরে পা রাখেননি। পাহাড়ী উপত্যকায় স্বর্গ অবস্থিত, সমতলের মতো পথ নেই, দেবতারা পণ্য ঘোড়া এবং গাধার পিঠে কিংবা নিজেদের মাথায় ও পিঠে বহন করেন। পাতালের পথে পথে কল্পক এত এত গরুর গাড়ী দেখেছেন যে এখন আর মোটেও বিস্মিত হন না, গরুর গাড়ীতে আরোহণও করেছেন তিনি।
তোরণ এবং তোরণের নিচ দিয়ে আসা মানুষের দিকে কল্পককে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুথান বলেন, ‘কল্পক, চলুন, চলুন; আপনার জন্য আরো অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে নগরের অভ্যন্তরে! নিজ চোখে সব অবলোকন করে তারপর নির্ধারণ করবেন কারা শ্রেষ্ঠ জাতি!’
তোরণের কাছে যেতেই লাঠি হাতে একজন স্বাস্থ্যবান দ্বাররক্ষী তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে কুথান নিজের পরিচয় দেন এবং কাঁধের ঝোলা থেকে একটা গোলাকার পোড়া মৃত্তিকার চাকতি বের করে দেখান। যা দেখে দ্বাররক্ষী তাদের পথ ছেড়ে দেয়। গোলাকার চাকতিটা সখা অনল তাকে দিয়েছেন, যাতে দ্বাররক্ষীরা তাকে নগরে প্রবেশ করতে দেয়। চাকতিতে অনল এবং তার বিপণীর নাম ক্ষোদন করা।
ধীরলয়ে কল্পকের অশ্ব হাঁটে কুথানের অশ্বের পাশে পাশে আর তিনি বালকের বিস্ময়ে সড়ক, নারী-পুরুষ এবং দু-পাশের গৃহগুলি দেখতে থাকেন। নগরের পথ চলতি লোকেরাও তাকিয়ে দেখে অশ্বারোহী গৌরবর্ণের দুই আগন্তুককে। নগরের প্রধান সড়কটি বেশ প্রশস্ত, নগরের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে উত্তর-পশ্চিম দিকে; প্রধান সড়ক থেকে অনেকগুলি গলিপথ চলে গেছে দু-দিকে। প্রধান সড়ক এবং গলিপথগুলি পোড়া ইট, চুন, সুরকি এবং পাথর দিয়ে তৈরি। সড়কের দু-পাশে পাথরের ঢাকনা দেওয়া নর্দমা, নগরের বর্জ্য ও বৃষ্টির জল এই নর্দমা দিয়ে নগরের বাইরে চলে যায়। সড়কের দু-পাশে কিছুদূর অন্তর দীপাধারের ওপর রাখা মোটা সলতের প্রদীপ, সন্ধ্যার পর তাতে চর্বি ঢেলে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করা হয়।
সড়কের দু-পাশে পোড়ানো রক্তিমবর্ণ ইট এবং চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি একতলা ও দ্বিতলা গৃহ; ছোট-বড় নানা আকৃতির গৃহ। বাটীতে প্রবেশের দেউড়ি ব্যতিত বাইরের পথের দিকে গৃহের কোনো দরজা-জানালা নেই, দরজা-জানালা গৃহের ভেতরের দিকে তৈরি করা হয় এজন্য যে যাতে বাইরের কেউ সহজে গৃহের বাসিন্দাদেরকে আক্রমণ করতে না পারে। প্রায় প্রত্যেকটা বাটীর দেউড়িতে রক্তিমবর্ণে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা, এমনকি কোনো কোনো গৃহের দেয়ালেও। কোনো কোনো গৃহের নিচে বাইরের অংশে বিপণি রয়েছে, সেখানে বিক্রি হয় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য।
সড়কের পাশের একটা ছোট্ট খোলা জায়গায় কদম্ব বৃক্ষের তলায় বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনি দিয়ে একটি অস্থায়ী মন্দির বানানো হয়েছে, ভেতরে অধিষ্ঠিত এক নারীমূর্তি, মূর্তিটি এখনো সম্পন্ন হয়নি, রঙ করা বাকি। মন্দিরের মেঝেতে বসে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ কয়েকটি ছোট মৃৎপাত্রে রঙ গুলাতে ব্যস্ত, তার পরনে ধুতি, উদোম কালো শীর্ণ শরীর, মাথার লম্বা ঘনকৃষ্ণ কেশ চূড়ো করে বাঁধা, দাড়ি-গোঁফ কামানো; তার হাতেই গড়া মূর্তিটি।
মন্দিরের সামনে অশ্ব থামান কল্পক, কুথানকেও থামতে বলে মূর্তিটি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কিসের মূর্তি কুথান?’
কণ্ঠ শুনে মধ্যবয়সী মানুষটি মুখ তুলে কুথান আর কল্পকের দিকে তাকান কয়েক নিমেষের জন্য, তারপর আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেন। কল্পকের প্রশ্নের উত্তর দেন কুথান, ‘কিছু কিছু অনার্য জাতি এই মাতৃকা মূর্তিকে ধরিত্রী জননী হিসেবে, সৃষ্টির আদ্যাশক্তি হিসেবে পূজা করে। প্রতিটি অনার্য পরিবারের মধ্যমণি থাকেন মাতা, মাতা পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন, তাই তারা মাতাকে খুব সম্মান-শ্রদ্ধা করে, বোধকরি এজন্যই তারা নানা প্রকার মাতৃকা মূর্তির পূজা করে থাকে।’
‘এই মূর্তি কী দিয়ে তৈরি?’
‘মৃত্তিকা দিয়ে তৈরি করা মূর্তি, উনিই তৈরি করেছেন। তবে এই কৈলাসনগরে অনেক শিল্পী আছেন যারা পাথর এবং ধাতু দিয়েও দৃষ্টিনন্দন মূর্তি গড়তে পারে।’
‘দেখতে অপূর্ব সুন্দর হলেও এসব অনাসৃষ্টি, অনাচার; যাগ-যজ্ঞ বাদ দিয়ে কী-সব মূর্তিপূজা করে!’
‘যদিও যাগ-যজ্ঞ আর মূর্তিপূজা, উভয়ের ফলাফলই শূন্য!’
‘কখনোই নয়; যজ্ঞে দেবপতি ইন্দ্র, ভগবান বিষ্ণু, অগ্নিদেব তুষ্ট হলে অবশ্যই ফল পাওয়া যায়।’
কুথান হেসে বলেন, ‘কল্পক, আমরা যাজ্ঞিক আর্যরা বহু রকমের যজ্ঞ করে থাকি, তবু তো সময় মতো বৃষ্টি হয় না, ফসল উৎপাদন ব্যহত হয়; দাবানলে পুড়ে ছারখার হয় অরণ্য, পশুপাখি মারা যায়; পঙ্গপাল ফসল খেয়ে ফেলে, রোগ-ব্যাধিতে ভুগে মানুষের অকাল প্রয়াণ ঘটে! তেমনি এরাও অনেক রকম পূজা করে, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে এরাও রক্ষা পায় না; পঙ্গপাল এদের ফসল ভক্ষণ করে, বাঘে গবাদীপশু ভক্ষণ ফেলে, এমনকি সুযোগ পেলে এদেরকেও; এরা সর্পপূজা করে, তবু সর্পের কামড়ে এদের অনেক লোক মারা যায়; আর রোগ-ব্যাধি তো আছেই! আমাদের যাগ-যজ্ঞ আর এদের মূর্তিপূজা উভয়ই বৃথা, এসবের সমালোচনা করা যেতেই পারে, কিন্তু নিজের ধর্ম-সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠজ্ঞান করে অন্যদের ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে কটু বাক্য বলার মধ্যে কোনো ঔদার্য নেই।’
মধ্যবয়সী প্রতিমাশিল্পী মাঝে মাঝে তাকিয়ে কুথান আর কল্পকের কথা শোনেন, কিন্তু তাদের ভাষা তিনি হয়ত তেমন বুঝতে পারেন না। কল্পক বলেন কুথানের উদ্দেশে, ‘আপনার পরকালের ভয় করে না কুথান? ঈশ্বর যদি আপনাকে দণ্ড দেন?’
‘না, ভয় করে না। কেননা পরকাল বলে কিছু আছে আমি তা বিশ্বাস করি না। আর ঈশ্বর বলে কেউ থাকলে তবেই না দণ্ড দেবার প্রশ্ন আসে! এই ধরণী কোনো ঈশ্বর সৃষ্টি করেননি, আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়েছে। ধরণী ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ধরণীতে প্রাণের জন্ম হবে, জরা-ব্যধি হবে, মৃত্যুও হবে। জন্ম-মৃত্যুতে কোনো ঈশ্বরের হাত নেই। চলুন এগোনো যাক।’
তাড়া খেয়ে আবার তাদের অশ্ব হাঁটতে শুরু করে। কল্পকের কৌতুহলী প্রশ্ন আর কুথানের উত্তরে বেশ কিছুদূর এগোনোর পর কিছুটা দূর থেকে সড়কের ওপর বিভিন্ন বয়সের অনেক নারী-পুরুষের ভিড় এবং গরু ও গাধায় টানা গাড়ী দেখতে পেয়ে কল্পক প্রশ্ন করেন কুথানকে, ‘এখানে এত লোকের ভিড় কেন?’
‘এখানে সড়কের পাশে নগরের হাট রয়েছে, পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। সারাদিনই এখানে লোকের ভিড় থাকে। নগরের বাইরের বিভিন্ন পল্লী এবং দূর-দূরান্তের নগর থেকেও এখানে মানুষ আসে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে।’
সড়কের ভিড়ের মাঝে পৌঁছায় তাদের অশ্ব, সড়কের পাশের একটি খোলা মাঠের তিনপাশে স্থায়ী বিপণী, সড়কের দিকটা উন্মুক্ত। সড়ক থেকে মাঠের ভেতরে দুটি সরু পথ চলে গেছে, এই পথদুটির দু-পাশে নানান পণ্যের পশরা সাজিয়ে অস্থায়ী বিপণী বসেছে। হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার বেশ ভিড়, কেউ পণ্য ক্রয় করছে, কেউবা বিক্রয়, কেউ ক্রয়কৃত পণ্য সড়কের পাশে রাখা গাধার পিঠে কিংবা গরুর গাড়িতে বোঝাই করছে, কোনো কোনো গাড়ী হাট ছেড়ে যাচ্ছে। কল্পক তাকিয়ে মানুষ দেখেন আর দেখেন তাদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা, নানা ধরনের পণ্য, বেশিরভাগ পণ্যই তার অচেনা। ক্রেতারা পণ্য ক্রয় করে বিক্রেতার হাতে মূল্য হিসেবে মুদ্রা নামক ধাতুখণ্ড তুলে দিচ্ছে, পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে যে মূল্য হিসেবে এই ধরনের ধাতুখণ্ড ব্যবহার করা হয় তা আসবার পথে ছোট ছোট নগরে প্রথম দেখেন কল্পক।
কয়েকজন মানুষ দেখে অশ্বের রজ্জু টানেন কল্পক, এমন অদ্ভুত ধরনের পোশাক পরিহিত মানুষ তিনি জীবনে দেখেননি। ঘাড়ের নিচ থেকে পা পর্যন্ত লম্বা সাদা রঙের পোশাক, মাথায় মহিষের শিঙ আকৃতির উষ্ণীব। গাত্রবর্ণ গৌর, নীলাভ চোখ। সড়কের ধারের একটা বিপণীর সামনে দাঁড়িয়ে তারা ধাতুর পণ্য হাতে নিয়ে দেখছে আর দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে, কল্পক তাদের কথায় মনোযোগ দেন, কিন্তু সচেতন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একটি শব্দও তার বোধগম্য হয় না। কুথানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এরা কোন অঞ্চলের মানুষ, কোন জাতির? এদের ভাষা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
কুথান বলেন, ‘প্রথম যেদিন আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, সেদিন রাত্রেই পশ্চিম অঞ্চলের অরট্ট নগরীর বাসিন্দা তৌরুর কথা বলেছিলাম মনে আছে?’
কল্পক ঘাড় নাড়েন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয় মনে আছে।’
‘এরা তৌরুর ওই অরট্ট নগর কিংবা ওই অঞ্চলেরই মরহষি, এলাম, সসা, নিশ্য প্রভৃতি নগরের মানুষ। হয়ত বিশাল তরণীতে প্রথমে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, তারপর নদীপথে এখানে এসেছেন বাণিজ্য করতে।’
‘বিষ্ণু, বিষ্ণু; এরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছেন! কী সাংঘাতিক ব্যাপার!’
‘এই হাটে তাদের বসতিরও অনেক পণ্য দেখতে পাবেন। এখানকার পণ্য ওদের ওই অঞ্চলে যায়, আবার ওদের অঞ্চলের অনেক পণ্যও এখানে আসে। এটাই বাণিজ্যের রীতি। ক্ষুধা পেয়েছে খুব, চলুন কিছু আহার করা যাক। তারপর হাটে ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে অতিথিশালায় যাওয়া যাবে।’
‘হ্যাঁ, তাই চলুন, মধ্যাহ্নভোজ হয়নি, আমারও বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে। বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকলে আমার আবার অম্ল হয়।’
দুজনে অশ্ব থেকে নেমে বৃক্ষের সঙ্গে অশ্ব বেঁধে রেখে নিকটের একটি খাদ্যবিপণিতে প্রবেশ করেন, ঘড়ায় জল নিয়ে বাইরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে পুনরায় বিপণীতে প্রবেশ করে ভূমিতে পাতা আসনে উপবেশন করেন। অনার্যদের ভাষা বোঝেন না কল্পক, কেবল ওদের কৃষ্ণবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কুথান অনার্যদের ভাষা বোঝেন, তিনি অনার্যদের ভাষায় বিপণীর এক যুবককে আহার বিষয়ে নির্দেশ দেবার কিছুক্ষণ পর মৃৎপাত্রে যবের রুটি আর মহিষের ধোঁয়া ওঠা ঝোলসমৃদ্ধ মাংস দেয় এক যুবক। আহার শুরু করার পর কুথান বলেন, ‘এদের রন্ধনপ্রণালী এবং উপাদান আমাদের থেকে পৃথক, আহারে অসুবিধা হচ্ছে না তো আপনার?’
কল্পক বলেন, ‘না, না কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তবে ঝাল একটু বেশি।’
‘হ্যাঁ, এরা আমাদের চেয়ে অধিক ঝাল আহার করে।’
‘তবে এদের রন্ধন অত্যন্ত সুস্বাদু, এমন রন্ধন কখনো আহার করিনি! মনে হচ্ছে এরা কোনো পন্থা অবলম্বন করে চর্বি তরল করে ফেলেছে।’
কুথান হেসে বলেন, ‘না, না, এরা চর্বি তরল করেনি। তরল চর্বির মতো যা দেখছেন তার নাম তেল। এরা সরিষা নামক এক প্রকার শস্য চাষ করে, ক্ষুদ্র দানার সেই সরিষা পিষে একপ্রকার তরল পদার্থ বের করে, যার নাম তেল। এই তেল এরা মৎস্য, মাংস, সবজী রন্ধনে ব্যবহার করে।’
‘তেলের কারণেই কি মাংসের রঙ এমন হয়েছে?’
‘শুধু তেলের কারণে মাংসের রঙ এমন হয়নি। এই যে দেখছেন মাংসে আঠালো পদার্থ জড়িয়ে আছে, এর নাম মসলা। এরা আমাদের মতো শুধু লবণ-মরিচ দিয়ে মাংস সিদ্ধ করে না, মাংসের সঙ্গে নানারকম উপাদান দেয়, যাকে এরা মসলা বলে, মসলা মাংসকে সুস্বাদু করে তোলে।’
‘উপাদানগুলোর নাম জেনে নিয়ে রন্ধন প্রক্রিয়াটা শিখে যাব অনার্যদের কাছ থেকে।’
‘খুবই ভালো কথা, আমি এই কথাই অনেকদিন ধরে বলে আসছি যে অকারণ রক্তপাত বন্ধ করে আর্য এবং অনার্য উভয় পক্ষেরই উচিত পণ্যসামগ্রী ও সংস্কৃতির বিনিময় করা, তাতে দুই পক্ষই সমৃদ্ধ হবে, দু-পক্ষের হাত ধরে সভ্যতা এগিয়ে যাবে।’
কল্পক কুথানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘কিন্তু ওরা আমাদের সমকক্ষ কখনোই নয়!’
কুথানও নিচু স্বরে বলেন, ‘কেবল সমকক্ষই নয়, বরং যুদ্ধ ব্যতিত ওরা সকল কিছুতেই আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। থাক, এই আলাপ এখানে নয়, এদের কেউ কেউ দেব ভাষা কিছু কিছু বোঝে, শুনে ফেললে গুপ্তচর ভেবে কেউ আমাদের প্রহার করতে পারে!’
দুজনই খুব ক্ষুধার্ত থাকায় পাতের রুটি শেষ হলে পুনরায় রুটি আর মাংস চেয়ে নেন। আহার শেষ হলে মূল্য চুকিয়ে বিপণী থেকে বেরিয়ে দুজনে হাটে ঘুরতে থাকেন।
(চলবে.......)