কুথান আর কল্পক যখন ষাঁড়ের লড়াইয়ের প্রাঙ্গণের কাছে পৌঁছান তখনও লড়াই শুরু হয়নি, লোকজন তখনও তাদের প্রিয় ষাঁড় নিয়ে আসছে। ষাঁড়ের লড়াইকে কেন্দ্র করে রীতিমতো মেলা বসে গেছে; ক্ষুদ্র বণিকেরা কাপড় বিছিয়ে নানা প্রকার পণ্যের পসার সাজিয়ে বসেছে, বংশীবাদক মেলা ঘুরে ঘুরে বংশীর সুরের ঐন্দ্রজালে মুগ্ধ করছে মানুষকে, প্লবক তার হাতের রজ্জু দ্বারা ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করছে, সৌভিক মৃত্তিকার পুতুল হাতে যাদুনৈপুণ্য প্রদর্শন করছে। কৈলাসনগরের যাদুবিদ্যার খুব খ্যাতি রয়েছে, দূর দূরান্ত থেকে মানুষ কৈলাসনগরে আসে সৌভিকদের কাছ থেকে যাদুবিদ্যা শিখতে, আবার সৌভিকেরাও যাদুনৈপুণ্য প্রদর্শন করতে যান বিভিন্ন স্থানে।
প্রাঙ্গণের মাঝখানের একটা অংশে বাঁশের বেষ্টন দিয়ে ঘেড়া, চারিদিকে প্রবেশ দ্বার রাখা, এই বেষ্টন দিয়ে ঘেরা অংশেই হবে ষাঁড়ের লড়াই। বাঁশের বাইরে চারপাশে বিপুল সংখ্যক লোক; কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ অকারণ ঘোরফেরা করছে, কেউবা অস্থায়ী বিপণী থেকে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে খাচ্ছে কিংবা পছন্দের পণ্য ক্রয় করছে।
কুথান আর কল্পকও ঘুরে ঘুরে মেলার বিপণীগুলোর পণ্য দেখতে থাকেন। মৃত্তিকার তৈরি টেরাকোটা, পুতুল, বাসন, অলঙ্কার; হস্তীর দাঁতের অলঙ্কার, সামুদ্রিক শঙ্খ এবং শঙ্খ কেটে তৈরি করা শাঁখা ও হাতা, কাপড়ের নানারকম পোশাক-পরিচ্ছদ; তাম্র দিয়ে তৈরি মূর্তি ও অলঙ্কার, বর্শা, ছোরা, কুঠার, বাটালি, ক্ষুর, করাত, বড়শি, কাস্তে, শলাকা, সূচ ইত্যাদি বাহারী সব পণ্যের বিপণী দেখে কল্পকের বিস্ময়ের সীমা থাকে না! একটি তাম্রমূর্তি ও অলঙ্কারের বিপণীর সামনে দাঁড়িয়ে বেশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন তিনি। অনেক মূর্তির মধ্যে মাত্র দুটি মূর্তি তিনি চিনতে পারেন; শিবের মূর্তি, যা তিনি কৈলাসনগর এবং অন্যান্য বসতিতে অনেকবার দেখেছেন; ধরিত্রী মাতৃকার মূর্তি, কয়েকদিন আগেই মহাসমারোহে যে মূর্তিকে পূজা করেছে কৈলাসনগরবাসী। আর রয়েছে শিশ্ন, সেটাও তিনি বহুবার বহু জায়গায় দেখেছেন।
এরপর কল্পক তাম্রের দুটি চুড়ি হাতে নিয়ে দেখতে থাকেন, তার মনঃশ্চক্ষে ভেসে ওঠে স্বর্গে থাকা প্রেয়সীর সুন্দর দুটি হাত। বলেন, ‘কুথান আমি চুড়ি দুটি নিতে চাই।’
কুথান মৃদু হেসে বলেন, ‘আপনার প্রিয়তমার জন্য বুঝি?’
কল্পক কিছু না বলে কেবল কুথানের দিকে তাকিয়ে হাসেন, কুথান চুড়ি দুটির মূল্য পরিশোধ করেন।
অলঙ্কারের বিপণী ত্যাগ করে দুজনে হাঁটতে থাকেন ষাঁড়ের লড়াইয়ের প্রাঙ্গণের দিকে, হঠাৎ-ই কুথানের মনের আকাশের সূর্যটা বিষন্নতার মেঘে ঢেকে দেয় ওই চুড়ি দুটো, কল্পকের মতো তারও দুটি চোখে ভেসে ওঠে দেবায়ণীর কোমল দুটি হাত আর মায়াভরা দু-মুখ, কতবার কত জায়গায় গিয়ে দেবায়ণীর জন্য কত কী অলঙ্কার ক্রয় করতে ইচ্ছে করেছে, কিন্তু তিনি ক্রয় করতে পারেননি, কেননা ঋষি দেবায়ণী পুষ্প ব্যতিত কোনো অলঙ্কার পরিধান করেন না। তাই তিনি দেবায়ণীর আশ্রমে গেলে কোনো না কোনো পুষ্প নিয়ে যান, দেবায়ণী সে-পুষ্প খোঁপায় কিংবা মালা গেঁথে গলায় পরিধান করলে তিনি অপার আনন্দে ভাসেন।
ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ-ই মহিষের কালো শিং হাতে একজন অনার্য বৃদ্ধ তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, কল্পক কিছুটা চমকে গিয়ে কুথানের হাত শক্ত করে ধরেন, বৃদ্ধ উচ্চস্বরে আবৃত্তি শুরু করেন-
‘এল নন্দী, এল ভৃঙ্গী
করে শত শত ভূত-পিশাচ সঙ্গী
বাজল দুন্দুভি, বাজল শঙ্খ
দক্ষপক্ষে সেনা অসংখ্য।
শিবভক্ত বীরভদ্র ছাড়ল হুঙ্কার
তবু না চূর্ণ হলো দক্ষের অহংকার
দক্ষসেনা ছুড়ল অজস্র বাণ
শিবভক্তগণ করল তা খান খান।
শিবের অনুচরবর্গ যজ্ঞশালা করে লণ্ডভণ্ড
দক্ষ কাঁপে থর থর দেখে এমন কাণ্ড
বীরদর্পে বীরভদ্র ঢুকিয়ে হাড়িকাঠে
খড়গের কোপে দক্ষের মস্তক কাটে।’
আবৃত্তি শেষে অট্টহাস্য করে ওঠেন বৃদ্ধ, ‘হা হা হা….খড়গের কোপে দক্ষের মস্তক কাটে, হা হা হা…! খড়গের কোপে দক্ষের মস্তক কাটে, হা হা হা….!’
তারপর আচমকা হাসি থামিয়ে কুথানের মুখের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘কিরে, আছিস কেমন?’
কুথান বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেন, ‘ভালো, তুমি কেমন আছো?’
‘বাবা শিবের কৃপায় আমি সর্বদাই ভালো থাকি।’
বৃদ্ধ তার শীর্ণ হাত কুথানের মাথায় রেখে কী যেন বলতে থাকেন বিড়বিড় করে আর কল্পক বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখতে থাকেন, এমন বিস্ময়কর মানুষ তিনি কখনো দেখেননি! বৃদ্ধের উদম কৃষ্ণবর্ণ শরীর, পরনে বাঘের চামড়ার নেংটি, শীর্ণ পা-দুটি নগ্ন। ভাঙা চোয়াল, কালো দাঁত, কপালে ও বক্ষে ছাই মাখা, মুখভরা কাঁচা-পাকা লম্বা দাড়ি-গোঁফ, মাথার গাঢ় বাদামী বর্ণের দীর্ঘ জটা পিঠে ছড়ানো। গলা, বাহু ও হাতের কব্জিতে রুদ্রাক্ষমাল্য।
কুথানের মাথা থেকে হাত নামিয়ে নিলে কুথান নিজের কোমরের থলে থেকে একটা মুদ্রা বের করে বৃদ্ধের হাতে দেন। বৃদ্ধ হেসে তার হাতের শিঙায় মুখ লাগিয়ে পোঁ পোঁ শব্দে বাজাতে বাজাতে মানুষের ভিড়ে হাঁটতে থাকেন। কল্পক প্রশ্ন করেন কুথানকে, ‘এই অদ্ভুত ধরনের মানুষটি কে? পাগল নাকি?’
‘একটু পাগলাটেই বটে, তবে আমরা যাকে পাগল বলি তেমন নয়, মানুষটি শিবভক্ত, শিবের প্রেমে পাগল!’
‘আপনার পরিচিত?’
‘তা বলতে পারেন, বহুবার বহু জায়গায় দেখা হয়েছে।’
‘দেখলেন তো অনার্য পাগলাটে লোকেরাও নিজের জাতির গৌরবগাঁথা আবৃত্তি করে বেড়ায়, আর আপনি আর্য হয়েও সর্বদা অনার্যদের প্রশংসা করেন!’
‘যা প্রশংসা পাবার যোগ্য তার প্রশংসা করাই আমার ধর্ম!’
‘তা বলে নিজের জাতের অপমান আপনার গায়ে লাগবে না! ওর মুখনিশ্রিত শব্দগুলো আমার গায়ে বিঁধছিল!’
‘উনি তো মিথ্যে কিছু বলেনি, যা সত্য তাই-ই বলেছেন। শুনুন, সব কথাকে তীর ভাবতে নেই, কিছু বাতাসও ভাবতে পারেন, তাহলে সুখে থাকবেন।’
‘পাগলটা যেভাবে উপহাস করে বলছিল “খড়গের কোপে দক্ষের মস্তক কাটে”, এই উপহাসকে আপনি বাতাস ভাবতে পারলেও আমি পারি না। এ কথা শোনার পর আপনি ব্যতিত যে-কোনো আর্য’র গাত্রদাহ হবে নিশ্চিত।’
‘শুনুন, যারা বিজয়ী হয় তারা নিজেদের গৌরবগাঁথা আর পরাজিতদের কথা এভাবেই তাদের কাব্যে লিপিবদ্ধ করে, আমরাও তো পরাজিতদের নিয়ে এরকম কত গৌরবগাঁথা রচনা করে থাকি। এটা তো সত্যি যে শিব ভক্তদের কাছে প্রজাপতি দক্ষের দম্ভ চুর্ণ হয়েছিল তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।’
অনেক বৎসর আগের কথা, স্বায়ম্ভূব মনুর জামাতা দক্ষ তখন প্রজাপতি পদে অধিষ্ঠিত। দক্ষ এবং প্রসূতির কন্যা সতী ভালবেসে বিবাহ করেন অনার্য শিবকে। প্রজাপতি দক্ষ এই বিবাহ মেনে নেননি এজন্য যে তিনি মনে করেন এতে তার সম্মান নষ্ট হয়েছে, এমনিতেই আর্যরা অনার্যদের নিচু শ্রেণির লোক মনে করেন, তার উপর শিব রাত-বিরেতে শ্মশানঘাটে কিংবা নির্জন কোনো গুহায় পড়ে থাকতেন, অনার্য সমাজের দরিদ্র শ্রেণির লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন! শিব পদে যখন যে-কালে যিনি-ই অধিষ্টিত হয়েছেন, তিনি-ই ছিলেন নিরহংকার, তার জীবনাচারে কোনো জৌলুস ছিল না, জাতি-গোত্র বা ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ মানতেন না, সমাজের সর্বস্তরের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। এখন শ্বেত নামে যিনি শিব পদে অধিষ্ঠিত আছেন, তিনিও এর ব্যতিক্রম নন। সঙ্গত কারণেই আর্য সমাজের কাছে প্রজাপ্রতি দক্ষের মাথা হেঁট হয় কন্যা সতী অনার্য শিবকে বিবাহ করায়, তাই দক্ষ তার আত্মজা সতী এবং জামাতা শিব দুজনকেই ত্যাগ করেন। একদা প্রজাপতি দক্ষ বৃহস্পতি নামক এক যজ্ঞের আয়োজন করেন; সেই যজ্ঞে তিনি ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি, পিতৃগণ, দেবগণ, গন্ধর্বগণকে নিমন্ত্রণ করলেও নিজ কন্যা ও জামাতা শিবকে নিমন্ত্রণ করেননি। পিতার যজ্ঞের কথা সতী আগেই শুনেছিলেন আর যজ্ঞের দিন তিনি যখন দেখেন যে তাদের প্রতিবেশি গন্ধর্ব নারীরা শোভন বসন পরিধান করে কণ্ঠদেশে পদক ঝুলিয়ে, কর্ণে উজ্জ্বল কুন্তল এবং হাতে বাহারী কঙ্কণ পরে তাদের পতির সঙ্গে তারই পিতৃগৃহে যাচ্ছে যজ্ঞের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে; তখন তারও পিতৃগৃহের যজ্ঞোৎসবে যাবার তীব্র বাসনা জাগে মনে। তিনি শিবকে বলেন, ‘হে প্রিয়, ওই দেখ, তোমার শ্বশুর প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞ-মহোৎসবে যাচ্ছে সবাই, যজ্ঞ-মহোৎসবে যাবার জন্য আমার হৃদয় চঞ্চল হয়েছে, আমার ভগিনীগণ নিশ্চয় তাদের পতিদের সঙ্গে সেখানে এসেছেন, সেখানে গেলে আমি আমার ভগিনীগণ এবং স্নেহার্দ্রচিত্ত মাতাকে দেখতে পাবো। চলো না প্রিয়, আমরাও যাই।’
শিব তখন তার পোষা বিষদাঁত ভাঙা দুটি গোখরো সর্পকে দুগ্ধ আহার করাচ্ছিলেন, সতীর দিকে না তাকিয়েই তিনি বলেন, ‘প্রিয়তমা, তোমার পিতৃগৃহে এতবড় যজ্ঞ-মহোৎসব হচ্ছে, সেখানে তোমার আপনজনেরা আছেন, সেখানে যাবার জন্য তোমার চিত্ত চঞ্চল হবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিনা নিমন্ত্রণে অযাচিতভাবে সেখানে যাওয়া আমাদের অনুচিত।’
সতী বলেন, ‘বন্ধুজন, পতি, শ্বশুর ও পিতার গৃহে বিনা নিমন্ত্রণেও গমন করা যায়। তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও প্রিয়, আমার এই অভিলাষ পূর্ণ করো।’
শিব এবার সতীর মুখের দিকে তাকান আর এই অমনোযোগে দুগ্ধপাত্র মুখের কাছ থেকে সরে যাওয়ায় সর্প দুটি বুঝি বিরক্ত হয়ে মাথা দুলিয়ে তাকায় প্রভুর মুখের দিকে। শিব বলেন, ‘হে প্রিয়তমা, তুমি যা বলছো তা যুক্তিযুক্ত, অনাহূত হয়েও বন্ধুজন বা নিকটাত্মীয়ের গৃহে যাওয়া যায়, তবে সেই বন্ধুজন যদি প্রবল অভিমান ও ক্রোধবশতঃ বৃথা দোষ-দৃষ্টিসম্পন্ন না হয়। বিদ্যা, তপস্যা, ধন, দেহ, বয়স ও কুল- এই ছয়টি সজ্জ্বনগণের গুণ; কিন্তু অসাধুজনে ঐগুলোই দোষরূপে পরিণত হয়ে বিবেক নষ্ট করে। তখন তারা “আমি বিদ্বান”, “আমি তপস্বী”- ইত্যাদি অহংকারে অন্ধ হয়ে অন্য সম্মানীত জনকে অসম্মান করে। প্রিয়তমা তুমি নিশ্চয় ভুলে যাওনি যে মরীচির যজ্ঞসভায় তোমার পিতা আমাকে নানাবিধ কটুবাক্য বলে কিভাবে অসম্মান করেছিলেন। এরপর তোমার পিতৃগৃহে যাওয়া আমার অনুচিত, আমায় ক্ষমা করো প্রিয়তমা। আর তুমি যতই তার কন্যা হও, আমার কারণে, আমার স্ত্রী হিসেবে তুমিও সেখানে তোমার পিতার সমাদর পাবে না; কেননা তিনি আত্মগরিমায় অত্যাধিক অন্ধ। তবু তুমি যদি সেখানে যেতে চাও আমি বাধা দেব না, তবে পিতৃগৃহে গমন তোমার জন্য সুখকর না-ও হতে পারে।’
প্রিয়তম স্বামী শিবের ওপর সতীর রাগ হয় তার পিতাশ্রী সম্পর্কে ওর এমন ধারণা পোষণের কারণে, তার মনে হয় যে- পিতা প্রজাপতি দক্ষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন না যে নিজ কন্যা ও জামাতাকে সামনে পেলেও তিনি তাদেরকে স্নেহ করবেন না। অভিমানে চোখে জল আসে সতীর, তিনি ভাবতে থাকেন- হায় যে পুরুষের জন্য একদিন আপন গৃহ-স্বজন ত্যাগ করেছি, সেই পুরুষ আজ আমার অন্তরের আকুতির কোনো মূল্য দিলেন না! তিনি বারবার গৃহ-বাহির করতে থাকেন যদি শিবের মন গলে এই আশায়। কেঁদেও শিবকে নিজের অবস্থান থেকে টলাতে না পেরে ক্রোধে সতীর অঙ্গ জ্বলতে থাকে, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে তিনি শিবকে কটু বাক্য শুনিয়ে একাই পিতৃগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সতীকে একাই পিতৃগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে থেকে শিব তার অনুচরদেরকে নির্দেশ দেন সতীকে বৃষরাজে আরোহণ করিয়ে পিতৃগৃহে পৌঁছে দিতে যাতে পথিপধ্যে সতীর কোনো কষ্ট বা বিপদ না হয়। অনুচরগণ শিবের বাহন বৃষরাজকে নিয়ে সতীর পশ্চাৎ অনুসরণ করে এবং সতীকে বৃষরাজের পিঠে আরোহণ করিয়ে দক্ষালয়ে পৌঁছান।
সতী পিতৃগৃহে পৌঁছে দেখেন যজ্ঞ উপলক্ষে অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়েছে পিতৃগৃহ, সর্বত্র বিরাজ করছেন দেবগণ, ব্রহ্মর্ষিগণ, মুনিগণ, গন্ধর্বগণ। কোথাও পশুবধের কোলাহল, কোথাওবা বেদপাঠের উচ্চকিত সুরধ্বনি।
প্রজাপতি দক্ষ সতীকে দেখেও সমাদর করা তো দূরে থাকুক, ভদ্রতাবশত কুশল বিনিময়ও করেন না, বরং কন্যাকে দেখেও না দেখার ভান করে নিজকর্মে ব্যস্ত থাকেন। সতীর মাতা প্রসূতি এবং ভগিনীগণ অবশ্য তাকে সাদরে আলিঙ্গন করেন। কিন্তু পিতাশ্রী তার সঙ্গে কথা না বলায় তার হৃদয় তুষ্ট হয় না, বরং অপমানিত বোধ করে ক্রোধে অন্তর দগ্ধ হতে থাকে। সতী এও জানতে পারেন যে এতবড় যজ্ঞে শিবের কোনো ভাগ নেই। তার মনে হয় যে পতির কথাই ঠিক ছিল, পতির কথা শুনলে তাকে এমন অপমানিত হতে হতো না। কিন্তু অপমানের যে তখনও অনেক বাকি তা না বুঝে তিনি ক্রোধে যজ্ঞশালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পিতাশ্রীর মুখোমুখি হয়ে বলেন, ‘পিতাশ্রী, শিব মুক্তবৈর, তার সাথে কারো বিরোধ নেই, তিনি কারো ক্ষতি করেন না, বরং বিপদগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করেন পরোপকারী শিব, তার কাছে আর্য-অনার্য কিংবা ধনী-দরিদ্রের কোনো প্রভেদ নেই, সকলেই তার কাছে সমান, সেই শিবকে আপনি যজ্ঞে নিমন্ত্রণ না করে তার প্রতি প্রতিকূল আচরণ করছেন?’
চারজন ঋত্বিক মন্ত্র পাঠ করতে করতে যজ্ঞশালার অগ্নিকুণ্ডে ঘৃত এবং ছোট ছোট কাঠের টুকরো দিতে থাকলে অগ্নি আরো দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সতীর কথা কানে গেলেও তাদের মন্ত্রপাঠ অবিরাম চলতে থাকে। আগত দেবগণ, ব্রহ্মর্ষিগণ, মুনিগণের কেউ কেউ বসে আছেন আর কেউবা দাঁড়িয়ে যজ্ঞকর্ম অবলোকন করছেন, কেউবা প্রবল কৌতুহলে পিতাশ্রী ও আত্মজার কথা শুনছেন।
আত্মজার কথা শুনে প্রজাপতি দক্ষ শ্লেষ মাখানো হাসি দিয়ে বলেন, ‘চোরের পত্নীও কখনো পতি নিন্দা করে না, বরং প্রশংসা করে! আর তুমি এক ভস্মমাখা, মৃতের গলার মাল্য পরিধান করা শ্মশানচারী সর্পক্রীড়ক অনার্যের পত্নী, তুমি তো তোমার পতির প্রশংসা করবেই!’
দক্ষের কথা শুনে দেবগণ, ব্রহ্মর্ষিগণ, মুনিগণের অনেকেই কৌতুকবোধ করে হেসে ওঠেন, লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে সতীর মুখ। আপন পিতাশ্রীর কটুবাক্য বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে তার কর্ণে, হৃদয় দগ্ধ হয়। দক্ষ আবার বলেন, ‘শিবকে নিমন্ত্রণের কথা বলছো তুমি! তুমি চেয়ে দেখ, এখানে যারা আমার অতিথি হয়ে এসেছেন তারা সবাই সভ্য, সম্মানিত, ভদ্র পরিচ্ছদ পরিধান করে ভদ্রচিত আচরণ করেন। এদের মধ্যে আমি তোমার ওই ভস্মমাখা পতিকে, যে কিনা কণ্ঠে সর্প জড়িয়ে নিকৃষ্ট ভূত-পিশাচদের সঙ্গে শ্মশানে থাকে, যার স্নানবিহীন অঙ্গে দূর্গন্ধ, সেই অনার্যকে আমি কী করে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করি!’
দক্ষের ভাষায় ভদ্র-সম্মানিতজনদের অনেকেই আবার অট্টহাস্য করে ওঠেন। সতী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার পিতাশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন, পিতাশ্রীকে চিনতে তার যেন কষ্ট হয়- হায়, এ কী আমার পিতাশ্রী! তার ঔরসে জন্মে, তার আশ্রয়ে দীর্ঘদিন থেকেও আমি তাকে চিনতে পারিনি, কিন্তু শিব তাকে ঠিকই চিনেছেন! তার হৃদয়ের কদর্যতা শিব ঠিকই পাঠ করতে পেরেছেন! এজন্যই এখানে আসতে নিষেধ করেছিলেন শিব। শিবের কথা অমান্য করার জন্য তার তীব্র অনুশোচনা হয়।
সতী বলেন, ‘আপনি যাদেরকে নিকৃষ্ট ভূত-পিশাচ বলে অবজ্ঞা করছেন, তাদের অঙ্গবর্ণ হয়ত আপনার মতো গৌর নয়, এছাড়া আর কোনো প্রভেদ নেই, তারাও ঈশ্বরের সৃষ্ট রক্ত-মাংসের জীব। সাধুজন কখনো ঈশ্বরের সৃষ্ট জীবকে ঘৃণা করেন না।’
‘কুকুরও ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব, তাই বলে কুকুরকে তো সমাদর করে গৃহে প্রবেশ করতে দিতে পারি না। তেমনি ওই ভূত, পিশাচ, বানর আর ওদের ওই আরাধ্য শিবকেও আমি সমাদর করতে পারি না।’
‘নিজের জামাতার সম্বন্ধে এমন কটুবাক্য বলতে আপনার লজ্জা হয় না?’
‘না, না, লজ্জা হয় না; কারণ আমি ওই অনার্য শ্মশানচারীকে জামাতা বলে স্বীকারই করি না! তোমাকেও আমি ত্যাজ্য করেছি, আমি ভুলে গেছি যে সতী নামে আমার কোনো কন্যা ছিল! আজ এই শুভদিনে-শুভক্ষণে আমায় বিরক্ত কোরো না!’
নিজের প্রতি রাগ হয় সতীর, ধিক্কার জন্মে এমন পিতাশ্রীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করার জন্য। মনে হয়- এমন পিতাশ্রীর কন্যা হয়ে বেঁচে থাকা অপমানের, কষ্টের। বেঁচে থাকলে এই অপমান, এই কষ্ট তাকে সারা জীবন বইতে হবে।
সতীর কপোল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সতীর মাতা এবং ভগিনীগণও রোদন করতে থাকেন, কিন্তু দক্ষের ভয়ে ভীত হয়ে তারা সতীর কাছে এসে সান্ত্বনা বাক্য বলতে পারেন না।
সতী কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলেন, ‘হে ভদ্রজন, সভ্যজন, শুনে রাখুন আপনারা, ধিক্কার, আমি ধিক্কার জানাই নিজেকে, আত্মগরিমায় অন্ধ এমন পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করার জন্য। যে পিতা ঈশ্বরের সৃষ্ট জনকে ঘৃণা করেন, নিজের কন্যার ন্যায়সঙ্গত চাওয়াকে সম্মান করতে জানেন না, নিজের কন্যার সৎ কর্ম ও সত্যের পথে থাকা পতিকে অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে নিকৃষ্ট বাক্য বলেন; সেই পাপাত্মা পিতার দেহ হতে উৎপন্ন এই আমি আর শিবের মতো সাধুজনকে স্পর্শ করে তাকে কলুষিত করতে চাই না। আমার এই দেহ আমি সত্ত্বর পরিত্যাগ করব।’
কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সতী যজ্ঞের ঘৃতপাত্র হাতে নিয়ে নিজের মস্তকে ঢেলে সকলকে হতবাক করে দিয়ে তরিৎবেগে লাফিয়ে পড়েন যজ্ঞবেদীর জলন্ত অগ্নিতে, দাউ দাউ করে অগ্নি জ্বলে ওঠে সতীর দেহে। অকস্যাৎ ঋত্ত্বিকগণের মন্ত্রপাঠ থেমে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রজাপতি দক্ষ, আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকেন সতীর মাতা এবং ভগিনীগণ। অতিথিদের কেউ কেউ জলের সন্ধানে ছুটোছুটি করেন। কিন্তু যতক্ষণে জল এনে যজ্ঞাগ্নি এবং সতীর অঙ্গের অগ্নি নির্বাপন করা হয় ততক্ষণে সতীর প্রাণপাখি উড়ে গেছে!
সতীর সঙ্গে আসা শিবের অনুচরগণ তাদের গুরুপত্নীর মৃত্যুতে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যজ্ঞশালায় ভাঙচুর আরম্ভ করে দক্ষকে প্রহার করতে উদ্যত হতেই দক্ষের অনুসারীরা তাদের ওপর আক্রমণ করে। দক্ষের অনুসারীরা প্রহার করতে করতে শিবের অনুচরদেরকে যজ্ঞশালা থেকে বের করে দিলে তারা তীরের বেগে ছুটে যায় শিবকে সতীর মৃত্যু সংবাদ জানাতে। সতীর মৃত্যু সংবাদ শুনে শিবের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়! তিনি তার প্রধান অনুচর নন্দী, ভৃঙ্গী, বীরভদ্র এবং ভূত, পিশাচ, যক্ষ, রক্ষ, নাগ, বানর প্রভৃতি গোত্রের শত শত অনুচর সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন দক্ষালয়ের উদ্দেশ্যে।
শিবের এক হাতে ত্রিশূল আরেক হাতে ডমরু, গলায় সর্প, পরনে ব্যাঘ্রছাল, গলায়-বাহুতে-কব্জির ওপরে পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের মালা, মাথার গাঢ় বাদামী বর্ণের জটা চূড়ো ভেঙে এলিয়ে পড়েছে পিঠে; নগ্নপদে উদভ্রান্তের মতো পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই মাড়িয়ে ছুটে চলেন শিব, বিক্ষুব্ধ রক্তচক্ষু থেকে অবিরাম ঝরতে থাকে অশ্রু, পিছনে শত শত উত্তেজিত অনুচর। শিব উদাসীন, শিব উন্নাসিক, শিব পাগলাটে স্বভাবের, কিন্তু আজ যেন শিবের অন্য রূপ দেখতে পায় তার অনুচররা, শিবের এই রুদ্ররূপ তার দীর্ঘদিনের অনুচরদের কাছেও অচেনা মনে হয়!
দক্ষালয়ের কাছে পৌঁছতেই দক্ষের অনুসারীরা তীর-বল্লম নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, শিব পিছন ফিরে জলভেজা ক্ষুব্ধ চোখে তার অনুচরদের দিকে একবার মাত্র তাকান, শত-সহস্র অনুচর ঝাঁপিয়ে পড়ে দক্ষের অনুসারীদের উপরে। অনেকে তীর এবং বল্লমবিদ্ধ হয়, শরীর থেকে অবিরাম রক্ত ঝরতে থাকে, কিন্তু সে-দিকে যেন কারো লক্ষ্য নেই শিবভক্তদের, শরীরের তীর কিংবা বিদ্ধ বল্লম নিজ হাতে বের করে তা নিয়েই আক্রমণ করে দক্ষসেনাদের ওপর। শিবের চারিদিকে লড়াই চলতে থাকে, শিব ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন মূর্তির মতো! শিবের এই শোকার্ত-কুপিত শত সহস্র অনুচরদের বাধা দেওয়া অসম্ভব দেখে দক্ষের অনুসারীরা পালাতে শুরু করে। শিব তার অনুচরদের নিয়ে দক্ষের যজ্ঞশালায় প্রবেশ করে কদলীপত্রের শয্যায় শুইয়ে শুভ্র কাপড় দিয়ে আবৃত করে রাখা সতীর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর ধীরপদে কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে কাপড় সরাতেই আঁৎকে ওঠেন! এ কোন সতী! যে শরীরে সতী পরম যত্নে চন্দন-কুঙ্কুম লেপন করতেন, সেই শরীরের চামড়া ঝলসে গেছে; হাড়ের কাঁকুই দিয়ে অতি যত্নে যে কেশরাশি আঁচড়াতেন, তা পুড়ে গেছে; সতীকে আর সতী বলে চেনার উপায় নেই! শিব সতীর পোড়া শবদেহের দিকে তাকিয়ে সহ্য করতে না পেরে এমন বিকট শব্দে আর্তচিৎকার করে ওঠেন যেন যজ্ঞশালা কেঁপে ওঠে! অদূরের পর্বত থেকে তার আত্মচিৎকারের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। দেবগণ, ব্রহ্মর্ষিগণ, ঋত্ত্বিকগণসহ আগত সকল অতিথিবৃন্দ ভীষণ ভয় পেয়ে তাকান শিবের দিকে, কেউ কেউ পালাতে শুরু করেন! আর শিবের অনুচর নন্দী-ভৃঙ্গী তাদের গুরুমাতার বীভৎস মৃতদেহ দেখে কাঁদতে কাঁদতে নিজেদের মাথার জটা টানতে শুরু করেন। তারপরই নন্দী ক্ষুব্ধ চোখে তাকান মৃত্তিকার প্রাচীর দিয়ে তৈরি করা নিভে যাওয়া যজ্ঞবেদীর দিকে, দৌড়ে বেদীর কাছে গিয়ে মেখলা বা সীমাসূত্র ছিঁড়ে ফেলে পাগলের মতো একের পরে এক লাথি মেরে বেদীর প্রাচীর ভেঙে পোড়া কাঠ-ভস্ম ছড়িয়ে ফেলতে থাকেন। ভৃঙ্গী গিয়ে ঘৃতভরা হাঁড়িগুলো দু-হাতে উপরে তুলে আছড়ে ভাঙতে শুরু করেন। অন্য অনুচররা যেন এরই জন্য অপেক্ষা করছিল, তারা হাতের কাছে যে যা পায় তাই ভাঙে আর দেবগণকে প্রহার করতে থাকে, রীতিমতো মহা তাণ্ডব চালাতে থাকে তারা! যজ্ঞশালার সম্মুখস্থ মণ্ডপ, মণ্ডপের অগ্রবর্তী হবির্ধান ও তার উত্তর দিকের আগ্নীধ্রশালা, যজমানগৃহ, রন্ধন ও ভোজনশালা ভেঙে চুরমার করে তাতে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করে। ভৃঙ্গী একজন মধ্যবয়সী ঋত্ত্বিককে মাথার উপরে তুলে আছড়ে ফেলে যজ্ঞের ভস্মের মধ্যে, বেচারা ঋত্ত্বিক তীব্র ব্যথায় কাতরাতে থাকেন।
যজ্ঞ চলাকালীন স্রুব নামক যজ্ঞপাত্র হাতে নিয়ে হোম করছিলেন ভৃগু, শিবের অনুচরদের তাণ্ডব দেখে বেচারা একদিকে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকেন, বীরভদ্র কাছে গিয়ে বামহাতে তার ঘাড় ধরে আর ডানহাতের মুঠোয় তার শ্মশ্রু ধরে টেনে উৎপাটন করেন, কারণ অতীতে প্রজাপতিদের যজ্ঞসভায় ভৃগু তার এই শ্মশ্রু দেখিয়ে শিবকে উপহাস করেছিলেন! ভৃগু ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাতরাতে থাকেন।
গুরু শিবের যাতনাময় হৃদয়ের ওই আর্তচিৎকার বীরভদ্রকে যেন ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের ন্যায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে! তার দৃষ্টি পড়ে ভগ নামক এক দেবতার দিকে, তিনি ছুটে গিয়ে ভগকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে তার দুই চোখ উৎপাটন করেন, এই ভগ দক্ষের শিবনিন্দার সময় চোখের ইঙ্গিতে দক্ষকে আরো তাতিয়ে দেন। ব্যথায় ভূমিতে ছটফট করতে থাকা ভগের পাশে উপবেশিত বীরভদ্রের দৃষ্টি এবার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পূষাকে খুঁজে পায়। ভূমি থেকে উঠে হুঙ্কার ছেড়ে পুষার দিকে এগিয়ে গিয়ে রক্ত মাখা হাতে পূষার কেশের চূড়ো ধরে টেনে এনে যজ্ঞবেদীর ভস্মের মধ্যে ছুড়ে ফেলেন। তারপর পূষার পাশে হাঁটু মুড়ে উপবেশন করে দন্ত উৎপাটন করে ফেলেন এজন্য যে দক্ষের শিব নিন্দার সময় পূষা পরম কৌতুকবোধ করে বারংবার ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হাসেন।
ক্ষ্যাপা বীরভদ্র এবার ছুটে গিয়ে দক্ষকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে তার বক্ষে এক পা তুলে খড়গ হাতে দাঁড়ান, দক্ষ হাত জোর করে বীরভদ্রের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকেন। বীরভদ্র গর্জে ওঠেন, ‘আমার মাতাকে ফিরিয়ে দে, তবে তোকে ক্ষমা করব রে পাষণ্ড।’
এরপর বীরভদ্র দক্ষের বক্ষ থেকে পা নামিয়ে তার কেশ ধরে টানতে টানতে হাড়িকাঠের কাছে নিয়ে গিয়ে হাড়িকাঠে দক্ষের মাথা ঢুকিয়ে খিল লাগিয়ে দেন। দক্ষ হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন আর বীরভদ্র খড়গ দু-হাতে ধরে উপরে তুলে এক কোপে দক্ষের ধড় থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। শিবের অনুচররা শিবের নামে জয়ধ্বনি দিতে থাকে।
এদিকে শিব ঘোরগ্রস্তের মতো সতীর কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসেন, প্রিয়তমা পত্নীর পোড়া মুখমণ্ডলে দৃষ্টি রেখে হাত দিয়ে আদর বুলাতে থাকেন। তারপর সতীর পোড়া নগ্ন শবদেহ কোলে তুলে নিয়ে অনুচরদের তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে দক্ষালয় থেকে বেরিয়ে যান।
শিব সতীর শবদেহ নিয়ে যজ্ঞশালা থেকে বেরিয়ে গেলেও তার অনুচররা তাণ্ডব চালাতেই থাকে। শিবের অনুচরদের এই তাণ্ডবলীলা দেখে বাকি দেবগণ, ব্রহ্মর্ষিগণ, ঋত্ত্বিকগণ যে যে-দিকে পারেন পালাতে থাকেন, তবে অনেকেই পালাতে না পেরে শিবের অনুচরদের হাতে প্রহৃত হন।
তারপর শিবের অনুচররা যজ্ঞশালা থেকে বেরিয়ে শিবের নামে ধ্বনি দিতে দিতে পাহাড়ী পথে ছুটতে থাকে শিবলোকের দিকে, তারা শিবলোকে পৌঁছে দেখে শিবের অনুচর বাদকেরা বাদ্য বাজাচ্ছেন আর শিব সতীকে কোলে নিয়ে ঘোরগ্রস্তের ন্যায় নৃত্য করছেন- আশ্চর্য তার নৃত্যের ছন্দ, অপূর্ব তার মুদ্রা, ভয়ংকর সুন্দর তার মুখমণ্ডল ও চোখের অভিব্যক্তি!
লোকজনের ফাঁক-ফোঁকর গলে, ঠেলে-ঠুলে সামনের দিকে এগোতে এগোতে ঘোষকের ঘোষণা ভেসে আসে কুথান আর কল্পকে কানে, ঘোষক ঢেঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী ষাঁড়ের নাম এবং যেখান থেকে ষাঁড়টিকে আনা হয়েছে সেই বসতির নাম। একজোড়া ষাঁড়ের নাম ঘোষণার পরপরই আরেক জোড়ার নাম ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে প্রাঙ্গণের দুইদিকে দুই জোড়া ষাঁড়ের লড়াই হবে। কুথান আর কল্পক যতক্ষণে একেবারে সামনে গিয়ে বাঁশের বেষ্টনি ঘেঁষে দাঁড়ান, ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে লড়াই। প্রাঙ্গণের উত্তরদিকে চলছে একটি কৃষ্ণবর্ণ এবং একটি শ্বেতবর্ণের ষাঁড়ের লড়াই আর দক্ষিণদিকে একটি বাদামীবর্ণ ও একটি ধূসর বর্ণ ষাঁড়ের লড়াই। ষাঁড়গুলো গোঙরায় আর একে অন্যকে আক্রমণ করতে থাকে অনবরত, কেউ কাউকে ছাড় দিতে সম্মত নয়। কল্পক একবার উত্তরে তাকান তো আরেকবার দক্ষিণে, ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়ের লড়াই দেখে তিনি বেশ আমোদবোধ করেন।
বাদক দলের বাদ্য আর লোকের উল্লাসে মুখরিত চতুর্দিক। বাদামী বর্ণ আর ধূসর বর্ণের ষাঁড় দুটি শেষ পর্যন্ত পিছু হটে যায়, বিজয়ী ষাঁড় দুটির রাখাল আর প্রাঙ্গণের বাইরে অবস্থানরত তাদের সমর্থকেরা চিৎকার করে উল্লাস করতে থাকে। চারটি দলে ভাগ করা ষাঁড় একের পর এক লড়াইয়ে অংশ নেয়, কখনো কখনো শক্ত লড়াই হয় দুই প্রতিযোগী ষাঁড়ের মধ্যে, আবার কোনো কোনো ষাঁড় লড়াইয়ের প্রাঙ্গণে ঢুকে প্রতিদ্বন্দ্বী ষাঁড়কে দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়, বিজয়ী ষাঁড়কে পরের ধাপে আবার অন্য বিজয়ী ষাঁড়ের মুখোমুখি হয়। এমনিভাবে চূড়ান্ত লড়াইয়ে টিকে থাকে কেবল দুটি ষাঁড়। কুথান আর কল্পক আসবার পথে কালু নামক কৃষ্ণবর্ণের যে ষাঁড়টি দেখেছিল, সেই কালু চূড়ান্ত পর্বের লড়াইয়ে ওঠে, কালুর প্রতিদ্বন্দ্বী শ্বেতবর্ণের একটি ষাঁড়। চূড়ান্ত পর্বে লোকের উচ্ছ্বাস আরো বেশি, বাদ্যের তালে তালে অনেকে নৃত্য করতে শুরু করে। শুরু হয় কালু আর শ্বেতবর্ণের ষাঁড়টির লড়াই। কী কারণে কে জানে কল্পক শ্বেতবর্ণের ষাঁড়টির পক্ষ নেয়, আর কুথান নেয় কালুর পক্ষ। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে কালুর একটি শিং ভেঙে রক্ত বের হয়, রক্তে ভিজে যায় তার মাথা, গড়িয়ে নামে মুখের দিকে, মৃত্তিকাতেও পড়ে। কিন্তু তবু যেন কালু হার মানতে সম্মত নয়, মাথা দিয়ে অনবরত আক্রমণ করতে থাকে শ্বেতবর্ণ ষাঁড়টিকে। একবার শ্বেতবর্ণের ষাঁড়টি মাথা দিয়ে ঠেলে কালুকে পিছিয়ে দেয় তো আরেকবার কালু ঠেলে শ্বেতবর্ণের ষাঁড়টিকে পিছিয়ে দেয়। বাদ্যকাররা তুমুল উৎসাহে বাদ্য বাজায়, দর্শকরা উল্লাস করতে থাকে, কালু আর শ্বেতবর্ণের ষাঁড়ের মধ্যে জোর লড়াই চলতেই থাকে, দুটোর কোনোটাই হার মানতে সম্মত নয়!
(চলবে......)