somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ময়না পাখির গান

২৯ শে মার্চ, ২০২৩ সকাল ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ময়না পাখিটার একটা সুন্দর বাংলা নাম রাখতে চেয়েছিলেন আবিদা, কিন্তু তার বর ইমতিয়াজ দ্বিমত পোষণ করেন, ইমতিয়াজের বক্তব্য এই যে- ময়না পাখির আবার গালভরা একটা মনুষ্য নাম দেবার দরকার কী! পাখিটা যখন ময়নাসমাজে ছিল তখন নিশ্চয় ওদের ভাষায় একটা নাম রেখেছিল ওর বাবা-মা, কিন্তু সেটা তো আর আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, ওর নাম ময়নাই থাকুক। যদিও এই নামটাও মানুষেরই দেওয়া, ময়নাপাখিরা হয়ত জানেই না যে মানুষ ওদের নাম রেখেছে- ময়না!

সেই থেকে ময়না পাখিটার নাম- ময়না। খাঁচাবন্দী ময়নাকে বারান্দায় রাখা হয় সারাদিন, সন্ধ্যার পূর্বে বারান্দা থেকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে রাখা হয়। ময়না একটু বড়ো হয়ে প্রথম যে শব্দটা শেখে, তা হলো- শ্রেয়সী। শ্রেয়সী আবিদা আর ইমতিয়াজের একমাত্র কন্যা, ক্লাস নাইনে পড়ে।

এরপর ময়না আরো কিছু শব্দ এবং বাক্য শিখেছে। যেমন- বাবা, মা, স্বাগতম, ধন্যবাদ, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি খাবো, শ্রেয়সী ঘুম থেকে ওঠো, শ্রেয়সী গান গাইতে বসো, শ্রেয়সী পড়তে বসো ইত্যাদি। মানুষের সঙ্গদোষে ময়না একটা গালিও শিখেছে! ইমতিয়াজ একদিন তার অফিসের বসের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন, বসের ওপর তিনি চরম বিরক্ত ছিলেন, তাই কলটি কেটে মুখে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ধর বাল!’

সেদিন থেকে ময়নাও প্রায়ই এই শব্দ দুটি উচ্চারণ করে, কিন্তু এই শব্দ দুটির প্রয়োগ সে জানে না, কারো ওপর রাগ হলে কিংবা বিরক্ত হলে শব্দ দুটি ব্যবহার করা যায়, কিন্তু সে না বুঝে অকারণে শব্দ দুটি উচ্চারণ করে!

শ্রেয়সী গান শেখে, প্রতি শুক্রবার বিকালে শ্রেয়সীকে গান শেখাতে আসে ওর গানের শিক্ষক। সকাল হোক কিংবা বিকাল, মায়ের নির্দেশে রোজ একবার তাকে রেওয়াজ করতেই হয়। একদিন বিকাল বেলা শিক্ষক শ্রেয়সীকে শাহ আব্দুল করিমের একটা গান তুলে দেয়, শিক্ষক চলে যাবার পরও সে বেশ কিছুক্ষণ গানটি গায়। তারপর সন্ধ্যায় যখন সে বারান্দায় যায় ময়নাকে ঘরে আনার জন্য, তখন তাকে দেখে ময়না হঠাৎ গেয়ে ওঠে-
‘বসন্ত বাতাসে সইগো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে।’

শ্রেয়সী অবাক হয়ে যায় ময়নার মুখে গান শুনে! খাঁচাবন্দী ময়নাকে নিয়ে আনন্দে প্রায় চিৎকার করতে করতে ড্রয়িংরুমে যায় সে। আবিদা-ইমতিয়াজ দুজনেই তখন বাড়িতে ছিলেন, শ্রেয়সী বাবা-মাকে ময়নার গান গাওয়ার ব্যাপারটি বললে তারা অবিশ্বাসের চোখে তাকায়, তখন ময়নাকে আবার গান গাইতে বলে শ্রেয়সী, আর আবিদা-ইমতিয়াজকে অবাক করে দিয়ে আবারও গান গেয়ে ওঠে ময়না!

সেই শুরু, এরপর ময়না শ্রেয়সীর গাওয়া গান শুনে শুনে আরো কয়েকটি গানের স্থায়ী শিখে ফেলে আর দিন নেই রাত নেই, যখন-তখন গেয়ে ওঠে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এলে ময়নার গান গাওয়ার বাতিক আরো বেড়ে যায়, আত্মীয়-স্বজনের বাহবা্ও কুড়োয়! আর যখন বারান্দায় থাকে, মাঝে মাঝেই পথ চলতি মানুষ দেখে গান গেয়ে ওঠে। বাড়ির সামনে ছোট্ট এক চিলতে খোলা জায়গা, তার পরেই রাস্তা। পথচলতি মানুষ ময়নার মুখে গান শুনে অবাক হয়, দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দ্যাখে ময়নাকে, ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, ওকে গান গাইবার অনুরোধ করে, ময়নাও অধিকাংশ সময় মানুষের অনুরোধ রাখে। ময়নাকে নিয়ে আবিদা, ইমতিয়াজ আর শ্রেয়সীরও আহ্লাদ-আদিখ্যেতার শেষ নেই!

একদিন শুক্রবার দুপুরে লাঞ্চের পর বাড়ির সবাই ভাত ঘুম দেয়, ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে শ্রেয়সী বারান্দায় মুখ মুছতে গিয়ে দ্যাখে খাঁচার মধ্যে কাত হয়ে শুয়ে আছে ময়না, পা দুটো শূন্যে। শ্রেয়সী কাছে গিয়ে ময়নাকে ডাকে, ময়না কথা বলে না, নড়াচড়াও করে না। শ্রেয়সী কাছে গিয়ে খাঁচা খুলে ময়নার শরীরে হাত রেখে বুঝতে পারে যে- ময়না প্রাণহীন!


দুই


তিনমাস পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জেলগেট থেকে পায়ে হেঁটে একটা মুদি দোকানের সামনে দাঁড়ায় পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছরের আফাজ আলী, একটা সিগারেট কিনে ঠোঁটে পুরে সুতোয় ঝোলানো লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালে, তারপর বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রিক্সায় চেপে বসে একটু পর পর ধোঁয়া ছাড়তে থাকে। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা, মাথায় টুপি, মুখে সুন্নতি দাড়ি। জীবন থেকে তিনটা মাস নষ্ট হয়ে গেলেও তার মনে কোনো অনুশোচনা নেই, বরং এটা ভাবতেই তার ভালো লাগে যে তিনি একটা ঈমানী কাজ করতে পেরেছেন, একটা বজ্জাত ময়নাপাখিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছেন, আর এর জন্য শুধু জেল কেন, ফাঁসি হলেও তার কোনো দুঃখ হতো না! পাখিটা প্রায়ই গান গাইত, আসা-যাওয়ার পথে গান শুনে রাগ হতো তার! কিন্তু সেদিন আর রাগটা দমন করতে পারেননি। পারবেন কী করে, মসজিদে পানি ছিল না, বাসা থেকে ওজু করে জুম্মার নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন, তাকে দেখে বজ্জাত পাখিটা গেয়ে ওঠে- ‘নেশা লাগিল রে, বাঁকা দু-নয়নে নেশা লাগিল রে!’ গান শুনে তিনি রক্ত চোখে পাখিটির দিকে তাকান আর তখনই পা পিছলে পড়ে যান মাটিতে ছাগলের নাদির মধ্যে! ওজু নষ্ট হয় তার! তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বেতমিজ পাখিটিকে আল্লাহ’র দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার। সিরাজের দোকানে গিয়ে ইঁদূর মারা ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরে যান তিনি। পরনের পোশাক বদলে বদলে ভাত খান, তারপর ভাতের সঙ্গে ইঁদূর মারা ওষুধ মিশিয়ে বিষমাখা ভাত পলিথিনে ভরে বাসা থেকে বের হন। ইমতিয়াজের বাড়ির সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন, তারপর রাস্তাটা জনশূন্য হতেই বারান্দার গ্রিল ধরে উঠে ভাত হাতে নিয়ে খাঁচার ভেতরে থাকা ময়নার খাবারের পাত্রের মধ্যে ছুড়ে দেন। বজ্জাত ময়নাটা গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে ভাত। আর তিনি তাড়াতাড়ি সরে পড়েন ওখান থেকে।

পরদিন দুপুরে তার বাসায় পুলিশ আসায় তিনি ভড়কে যান, কানে বেজে ওঠে ময়নাপাখির গানের সুর! তবু তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু পুলিশ অবাক করে দিয়ে তার ময়নাপাখি হত্যার কথা জানিয়ে তাকে গ্রেফতার করে!

ওই বাড়িতে যে সিসি ক্যামেরা ছিল তা জানত না আফাজ আলী, পরে জানতে পারে যে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেই তাকে সনাক্ত করে ইমতিয়াজ ও তার পরিবার। সেদিনই তারা মামলা করে আর পরদিন সে হয় গ্রেফতার। বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইনের ৩৮ ধারা মোতাবেক আদালত তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়।

আফাজ আলীর নির্দেশ মতো তার বাসার সদর দরজার সামনে রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামায়, ভাড়া মিটিয়ে সদর দরজা ঠেলে ছোট্ট আঙিনাটুকু পেরিয়ে ঘরের দরজার কড়া নাড়েন আফাজ। কিছুক্ষণ পর দরজা খোলেন আফাজের স্ত্রী ফাতেমা, স্বামীকে দেখে অবাক হয়, আফাজ বলেন, ‘কেমন আছো তোমরা?’

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়েন ফাতেমা, তারপর একপাশে সরে দাঁড়িয়ে স্বামীকে ঘরে প্রবেশের পথ করে দেন। আর তখনই ঘরের ভেতর বসে খেলতে থাকা তাদের তিন বছরের ছেলে আহাদের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হন আফাজ। আহাদের হাতদুটি ময়নাপাখির ডানা হয়ে গেছে, মুখটিও হয়ে উঠেছে ময়না পাখির ঠোঁট! আর সে ময়নাপাখির স্বরেই গাইছে-
‘নেছা লাগিল রেএএএ
বাকা দু নঅঅনেএএ
নেছা লাগিল রেএএএ!’




ঢাকা
অক্টোবর, ২০২২।






সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২৩ রাত ৯:২৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঐতিহাসিক পোস্ট =p~

লিখেছেন জটিল ভাই, ৩১ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৩:১২


ব্লগে চলমান গ্রহণের সাক্ষী হতে এই পোস্ট করে রাখলাম যেনো ইতিহাসে ঠাঁই জুটে। আর কিছু পড়ার বাকি নাই। ...বাকিটুকু পড়ুন

জোকসতো হলো, এবার একটু গান শোনা যাক

লিখেছেন মিরোরডডল , ৩১ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৪:২৪

যেহেতু কমেন্ট পড়তে পারছিনা তাই প্রতিমন্তব্য করা হয়নি।
যারা সকালের পোষ্টে কমেন্ট ও লাইক দিয়েছে, তাদের সবাইকে থ্যাংকস।

প্রয়াত ব্লগার নূর মোহাম্মদ নুরু নেই, তাই আর কারো জন্মদিন নিয়ে পোষ্ট হয়না।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সোনাগাজীর বদদোয়া লেগেছে সামু ব্লগের উপরে - ওনার কমেন্ট বন্ধ করার কারণে কেউ কমেনট করতে পাড়ছে না :) ( ফান পোস্ট)

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ৩১ শে মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:০৯

সোনাগাজী সাহেবের বদদোয়া লাগসে। ওনার মন্তব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে আল্লাহতায়ালা নাখোশ হয়ে সবার মন্তব্য বন্ধ করে দিয়েছেন। :) ...বাকিটুকু পড়ুন

স্ত্রী হিসেবে বরিশালের মেয়েরা কেমন?

লিখেছেন রাজীব নুর, ৩১ শে মে, ২০২৩ রাত ৯:৫৯



আমি বরিশালের একটা মেয়েকেই চিনি।
অর্থ্যাত আমার স্ত্রীর বাড়ি বরিশাল। কিন্তু বরিশালের মেয়েরা অন্য জেলা থেকে আলাদা নয়। সমস্ত বাংলাদেশটাই ভালো মন্দ মিলিয়েই। মুন্সিগঞ্জের মেয়েরা কেমন? দিনাজপুরের মেয়েরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধ রেখে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে বন্ধ রাখাই ভালো : একটি কৌতুকের আধুনিক রূপ :P

লিখেছেন জটিল ভাই, ০১ লা জুন, ২০২৩ সকাল ৮:১০


(ছবি নেট হতে)
উৎসর্গ: যারা বদদোয়া, তাবিজ, কবচ, পানি পড়ার উপর ভর করে চলেন।
সনাতন
ফকির বাবার কাছে এসেছে এক নারী।
নারী: ফকির বাবা, একটা উপায় বইলা দেন।
ফকির: বল মা!
নারী: আপনি তো আমারে জিগাইলেন-ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×