somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গন্তব্যহীন…

১৪ ই মে, ২০১৪ রাত ১১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনিন্দ্য অনুভবে

গোধূলি লগনে বিশাল আকাশ আর প্রান্তরের ঘাস, কাশফুল দেখে তাদের মনে হয়েছিল তারা একসাথে পথ হাঁটবে বহুদূর; আমৃত্যু। তাই সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে তারা দৃপ্ত পায়ে সামনে হেঁটে গেল।বুকে তুলে নিলো আংরার আগুন, শঙ্খচূড় বিষদাঁতের হুল, ফুলের গভীরে ছুঁয়ে আসা হাওয়া, ঝিঙেফুলী রোদের ঝিলিক।ঘোর বরষার বৃষ্টি ভেজা জাম-ডালের নুয়ে পড়ার দুঃখে তারা যেমন দুঃখিত হয় আবার সুনীল আকাশের হেসে উঠায় তারাও হেসে উঠে

কিন্তু একটা সময়ে সভয়ে তারা দেখতে পেলো নিভে আসছে তাদের অঙ্গীকারের আলো। এত কাছাকাছি থেকেও তারা একে অপরকে চিনতে পারছেনা।তারা এখন ভুলেই গেছে ক’দিন আগেও তারা তর্কযুদ্ধে একে অপরকে হারাতো নিজেদের সূর্যাস্তের বিনিময়ে একে অন্যের জন্য সোনালি ভোর কিনে আনবে বলে।

দু’জনেরই দেখা হয় খাবার টেবিলে দিনশেষে; মৌনতায়। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া একটা মন নিয়ে স্ত্রী খাবার তুলে দেয় তার স্বামীকে।স্বামীটিও নিপুন নিস্তব্ধতায় কাঁটা গেলার মতো করে গিলে ফেলে গ্রাস; ঝটপট খেয়ে উঠে পড়ে। খাওয়া শেষে স্ত্রী পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় তার দিকে সূক্ষ্ম সাবধানতায় যাতে টেবিলে পানি ছলকে না পড়ে। রোজ রোজ ক্লান্তিকর একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে মাপা ফ্রেমে।

অথচ তারা দুজনেই জানে তাদের দুজনের বুকের ভিতরে একই শব্দ বাজে; কান পাতলেই যা শোনা যাবে। কিন্তু তারা কেউই কারো বুকে কান পাতবেনা কিংবা পাতেনা। নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে একবার তুলে নিলে ফেরাটা তখন যে অসম্ভব হয়ে পড়ে আসলে তারা তা বুঝতে পারেনি।

এভাবে দিন যায়। পরতে পরতে তাদের অর্গানের রীডে পড়তে থাকে ধূলো। বাড়িময় ঘুরতে থাকে আলস্যের ঘোর, আকাঙ্ক্ষারা ফটকের বাইরেই থাকে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কুকুরের মতো ঝিমুতে ঝিমুতে। নিয়মমাফিক তাদের বাড়িতে দিনের পর রাত আসে, রাতের পর আসে দিন। কিন্তু তাদের পাঁজরের ফাঁপা হাড়ে অদ্ভুত এক বিষাদের বাতাস জায়গা দখল করে রাখে। সেই ম্লান বিষাদ, অমোঘ দুঃখের পথে তারা এভাবেই একটু একটু করে এগিয়ে যায়। কারন তাদের নিয়তিটাই এমন যে প্রেত অন্ধকারেই তাদের সারা জীবন হাঁটতে হবে।

আজকাল নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে অনিন্দ্যর এমনই লাগে। এ কারণেই হয়তোওর এতো ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কিন্তু নিজের এই বোধ, দহন কোনটাই ও অস্বীকার করতে পারছে না। যত দিন যাচ্ছে এ ধারণাই ওর মাঝে জেঁকে বসছে যেন।

প্রচণ্ডঅস্থিরতায় ক্রমাগত পায়চারী মনের অলিন্দে অলিন্দে, বিগত সুদীর্ঘ বাইশ বছরের হিসেব নিকেশ শেষে প্রাপ্তি নিয়ে ভাবতে গেলে কেন যেন ফলাফল শুন্যের কোঠায় গিয়ে শেষ হচ্ছে। কিন্তু এমনটা কেন হচ্ছে সেটাই ও ভেবে পাচ্ছে না। প্রায়দিনই ওর মনের মাঝে এ ধারণা গেঁথে বসছে ও নিশ্চয়ই কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে।অবশ্য এ ভাবনাটা ও অফিসে বসেই ভাবার সময় পায় বেশি। ইতিবাচক কিছুর প্রত্যাশানিয়ে যখন ও বাড়ির দিকে ফিরে যায়, ওর বুকটা দুরুদুরু কাঁপতে থাকে সর্বক্ষণ।স্টিয়ারিং উপরে রাখা হাত দুটির দিকে তাকালেও ও দেখে সে দুটিও কাঁপছে ভীষণ ভাবে। সবকিছুই তখন কেমন যেন অচেনা লাগতে থাকে, এমনকি নিজের চেনাজানা এই শরীরটাকেও।

ভীষণভাবে অগোছালো অনিন্দ্য কখন, কীভাবে একটু একটু করে শায়লার সংস্পর্শে নিজেকে ঘরকুনো, বৃত্তবন্দী করে নিয়েছিলো সেটা স্মৃতি হাতড়ে বের করা এখন কষ্টসাধ্য এক ব্যাপার। আচ্ছা ও নিজেকে শায়লার হাতে ছেড়ে দিয়েছিলো নাকি শায়লা একটু একটু করে ওকে শায়লার করে নিয়েছিলো যেখানে অনিন্দ্যর আলাদা অস্তিত্বই ছিল না? নাহ্‌ ও ভাবতে পারে না বেশিক্ষণ এসব ভাবনা। বরং ঘুরেফিরে এই ভাবনাটাই কাজ করে ও যেন সবকিছুর মাঝে থেকেও কোথাও নেই। এই ঘর, এই অফিস, এই বাড়ি থেকে অফিস আসার বা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার কিংবা ওদের একমাত্র সবুজ ভূখণ্ডের মতো বেড়ে ওঠা যে ছোট দ্বীপ, ওদের প্রিয় রাজকন্যা তিতলী ওর বায়না, ওর স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে বসে রাজ্যের সব কথা, ওর হাসি সব কিছুই অনিন্দ্যের কাছে অচেনা মনে হয়। কিন্তু এমন মনে হচ্ছে কি শুধুমাত্র শায়লার কাছে থেকেও দূরে ছিটকে পড়ছে বলে? আচ্ছা শায়লারও কি এমন অনুভবই হয়? কী বোকার মতো ভাবছে অনিন্দ্য, ও নিজের মনেই হেসে ফেলে। ও আর শায়লা কেউ তো আলাদা নয়। দুজন মিলেই একটি সত্ত্বা। নিশ্চয়ই ওরও এমন হয়, ওরও কেমন অসহায় অসহায় বোধ হয় ওদের বর্তমান মানসিক সংকট নিয়ে তা না হলে শায়লা কেন অফিস থেকে ফেরার পর একগাদা কাপড় নিয়ে বসবে সেলাই মেশিনে। শায়লার এই অভ্যাসটা অনেক পুরনো। যখনই ওর রাগ, অভিমান, কষ্ট হয় ও সেলাই মেশিন নিয়ে বসে। একবার সাহস করে শায়লাকে জিজ্ঞেসও করেছিলো –

অবেলায় কাপড় সেলাতে বসলে কেন? মন খারাপ? ও শায়লার কাছে দাঁড়িয়ে ওর মাথাটা নিজের বুকের কাছে চেপে ধরেছিল আলতো ভাবে। শায়লা ওকে দূরে সরিয়ে দেয়নি ঠিকই কিন্তু খুব ঠাণ্ডা স্বরে বলেছিলো –

নাহ্‌! মন খারাপ বা অভিমানের সময় কই ! ভাবছি। ভেবে ভেবে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছি।

শায়লার এরকম স্বর অনিন্দ্যের খুব চেনা। অজান্তেই শায়লার কাছ থেকে ও চলে আসে কিছুক্ষণ আগেও যেখানে শায়লার মাথাটা ওর বুকের কাছে চেপে ধরা ছিলো। ইদানীং ওর দিকে তাকাতে, কথা বলতে অনিন্দ্যের খুব ভয় হয়। আরো দুবছর আগে ও হঠাৎ করেই বলেছিলো ও আর সংসার করতে ইচ্ছুক না। এর সুনির্দিষ্ট কারণ অনেক ভেবেও ও পায়নি। কিন্তু ওদের সন্তান তিতলী কথার ভেবে দুজনে এখনো এক ছাদের নিচে রয়ে গেছে ধুঁকতে ধুঁকতে। কেন যেন ওর ভেতরে একটা ভয় ঢুকে গেছে একদিন ঘরে ফিরে দেখবে শায়লা একেবারে চলে গেছে। একটা হীমশীতল ভয় ওর বুকের উপর চেপে রয়েছে আজ দুবছর ধরে। ওদের দুজনেরই বাইরের সব কাজ, প্রফেশনাল জীবন, সংসারের প্রয়োজনীয় আলোচনা, কথা সবই একটা মাপা ফ্রেমে দুজনেই চালিয়ে নিচ্ছে কিন্তু অনিন্দ্যের মনে হয় ওর জীবনের সমস্ত শিক্ষা, অর্জন, সম্মান, আত্মবিশ্বাস হঠাৎ করেই যেন হাওয়ায় মিশিয়ে গেছে। সবচেয়ে অস্বস্তির ব্যাপার শায়লার সামনে এলেই ওর চোখ ভিজে ওঠে, কান্না পায়। শায়লা সবসময়ই ওকে বলতো, কান্না হলো পুরুষদের জন্য দুর্বলতার লক্ষণ! কি জানি হয়তো অনিন্দ্য দুর্বলই! তবুও চায় শায়লাকে নিয়ে জীবনটা আগের মতো করে নিতে।

শায়লার বরাবরই অভিযোগ ছিলো অনিন্দ্য ভীষণ ক্যারিয়ারস্টিক, আবেগহীন! হাহ্‌ আবেগ! ওর নিজেরও তাই মনে হতো ও আবেগহীন। কিন্তু গত দুবছরে ওর এই ধারণা বদলে গেছে। না হলে নিজের সংসার, শায়লা সবকিছুর জন্য ওর এতো খারাপ লাগবে কেন? এমন না শায়লার জীবনে নতুন কেউ এসেছে! কিন্তু ওর সেই একই কথা –

আমি একা একাই আমার জীবনটা কাটাতে চাই!

অনিন্দ্য জানে শায়লা ছোটবেলা থেকেই এক ধরনের মেন্টাল ট্রমার মাঝ দিয়ে বড় হয়েছে যা ও বয়ে বেড়াচ্ছে এখনো। কিন্তু এটা শুনলেও ও রেগে যায়। ওর প্রতি অনিন্দ্যের কেয়ারিংনেস ভাবটা যতটা সম্ভব ও এড়িয়ে যেতে চায়। ওর চোখে কেমন এক ভাসাভাসা দৃষ্টি, শূন্যতার ওপাড়েও যে শূন্যতা থাকে তাই যেন ও ধরতে চায়! মাঝে মাঝে কতোটা নির্দয়ভাবেই না ও বলে-

তুমি তো আর রোবট নও, রক্তমাংসের মানুষ। আমার জন্য কেন এভাবে একা একা থাকবে। ইচ্ছে হলে তুমি কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারো।

অনিন্দ্যেরও যে ইচ্ছে- আকাঙ্ক্ষা হয় না বা নেই তা নয়। কিন্তু সে তো শুধু শায়লাকে ঘিরে! ওর ভীষণ কষ্ট হয় বিছানায় ওরা দুজন তিতলীকে মাঝে রেখে ঘুমায়! কী নিরুত্তাপহীন এক সম্পর্ক! ওর গায়ের সাথে কখনো কখনও অনিন্দ্যের হাত লেগে যায়। ভয়ে ওর বুকটা কেঁপে ওঠে। কী জানি শায়লা আবার কখন ভেবে বসে ও ইচ্ছে করে শরীরের স্পর্শ পেতে চায় কিনা। একটা যৌনহীন সম্পর্ক নিয়ে ওর সাথে আমৃত্যু কাটাতে অনিন্দ্যের সমস্যা নেই কিন্তু এ কেমন বেঁচে থাকা দুজনের!

শায়লার এমন বিক্ষিপ্ত আচরণের সাথে সম্প্রতি অনিন্দ্যের নতুন আরেক বোধের জন্ম হয়েছে যার কোনও সুনির্দিষ্ট নাম নেই! এর নাম ও কী দিবে? হাহাকার, অনুশোচনা, কষ্ট কষ্ট সুখ কিংবা সাতটা গোলাপ কিংবা কী নামে ডাকবে তাকে? তার নাম নামীরা। ইদানীং ঘুমের ওষুধ খাওয়া বাদ দিয়েছে অনিন্দ্য। হয়তো এই বাদ দেয়ার পেছনে নামীরার কিছুটা প্রভাব ছিলো কিংবা আলস্য, ঘোরমাখা অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ও প্রাণপণে চেষ্টা করছিলো বলেই ঘুমের ওষুধ গুলো ও সরিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু কী আশ্চর্য গতকাল রাতে কয়েকবার ঘুম ভেঙেছে ওর আর যতবারই ঘুম ভেঙেছে ততবারই নামীরার কথা ওর মনে পড়েছে অথচ তখন শায়লা ওর পাশে শুয়ে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অথবা তন্দ্রার সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুম ভেঙে ওর কানে বাজে নামীরার সদ্য ঘুম ভাঙা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ যা ওকে আন্দোলিত করলেও ভীষণ শক্তভাবে ও নামীরার কাছে রোজ সকালে সে অনুভব গোপন রাখে। অফিস গিয়ে হয়তো দশ থেকে পনেরো মিনিট এই নারীটির সাথে কথা হয় যা হয়তো নামীরা বা অনিন্দ্যের জন্য সারাদিন রাত্রির রসদ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এই যে নামীরার জন্য এক টুকরো অনুভূতি, ঘুম ভেঙেই ওর কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া এরই বা ও কী নাম দিবে ও? তাই অনিন্দ্যের জীবনে নামীরা নামটির কোনো ভূমিকা আছে কিনা এ নিয়ে ও খুব একটা নিশ্চিত হতে পারে না।মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোনো নামহীন সম্পর্ক বয়ে বেড়াতে হবে এই অচেনা, রহস্যেঘেরা নারীটির সাথে!

নিস্তব্ধতায় নামহীন কেউ বা আমি নামীরা!

ছোটবেলায় একবার আমার চাচা কি নিয়ে যেন রাগ করে বলেছিলো ‘তুই জীবনে সুখী হবি না’। এরপর থেকে যখনই আমার কিছু নিয়ে গভীর দুঃখ হতো আমার মনে পড়তো আমার চাচার বলা এই কথাটা। জীবনের অনেকটা টানাপোড়েন পেরিয়ে এসে আমার সত্যিই এখন এসব ভাবনা আসে না আসলে আমি সুখী কিনা! জীবনে চলতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে তাই এই ছুটে চলা কিন্তু বেঁচে থাকাটা অন্য কারো জন্য যতটা বেশি দরকার তারচেয়েও বেশি দরকার নিজেকে ভালোবাসি বলে এই বেঁচে থাকতে চাওয়া।

অনিন্দ্যের সাথে আমার পরিচয় বছরখানেকের একটু বেশি হবে বোধহয়। আমরা নিতান্তই বন্ধু মানে বন্ধু ছিলাম। ওর পরিবারেও অনিন্দ্যের বন্ধু হিসেবে আমার নামটি অপরিচিত নয়। কিন্তু বেশ কয়েকমাস ধরে সেখানে একটা ছন্দপতন ধরা পড়েছে। অনিন্দ্যকে অনেক জিজ্ঞেস করেও জানা হয়নি সে কারণ।অবশ্য পরে জেনেছি অনিন্দ্য নিজেই জানে না এর কারণ! সেই একই কথা বারবার বলে-তোমার সাথে যেদিন দেখা হবে সেদিন সব বলবো! কিন্তু জীবন জীবিকার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে হয়ে ওর সাথে দেখা করাটাই হয়ে উঠছে না আমার!কিন্তু কেন যেন মনে হলো ওর কিছুদিনের আচরণে ওর আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ঠিক আগের অবস্থানে নেই কিংবা ওর দিক থেকে একটা প্রচ্ছন্ন হাতছানি! ওর সাথে এর আগেও আমার দেখা হয়েছিলো কিন্তু গত ৮ তারিখে ওর সাথে দেখা হওয়াটা আমাদের দুজনের জন্যই নতুন একটা মাত্রা পেয়েছিল কিছুদিনের ফোনালাপে, অনলাইনে। এখন আমরা একে অপরকে আপনি থেকে তুমি বলি, ফোনে কয়েকবার একে অপরের খোঁজ খবর নেই। একটা নতুন ভালো লাগার ছন্দে বলা যায় আমি আলোড়িত তাও আবার অনেক অনেক বছর পর! সাব্বিরের কাছ থেকে চলে আসার পর আমার ছন্দহীন জীবনে বলা যায় অনিন্দ্য এক নতুন ছন্দ নিয়ে এসেছে এমনই মনে হচ্ছিলো ঘুরে ফিরে। অনেকদিন পর আমাকে কেউ ফুল উপহার দিলো, টাটকা গোলাপ! হুম অনিন্দ্যের সাথে যেদিন আমার দেখা হয়েছিলো ও আমাকে সাতটা গোলাপ দিয়েছিলো যা আমার জন্য ছিল রীতিমত এক চমক! ওর দিকে তাকাতে ভীষণ লজ্জা লাগছিলো, জানি না ওরও একই অনুভূতি ছিলো কিনা! হয়তো আমার মতোই অনুভূতি হয়তো মৃত কোনো অনুভূতি। ও নিজেকে এরকমই ভাবে।
সেদিন স্যান্ডউইচ চিবুতে চিবুতে আমি অনিন্দ্য আর শায়লার জীবনের সাম্প্রতিক সময়ের গল্প বা বিষণ্ণতার কথা শুনছিলাম। কয়েকবার খেয়াল করলাম অনিন্দ্যের চোখ ভিজে উঠছে আবার সামলেও নিচ্ছে। সব কিছু জানাবার পর আমাদের দুইজনের পথ চলাটা কেমন হবে সেটা অনিন্দ্য পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেয়। আমিও বুঝে নেই ওর চাওয়া-পাওয়ার জগতটা শুধুই শায়লা আর তিতলীকে ঘিরে। ওকে আশ্বস্তও করি এই বলে ওর ছকে বাঁধা জীবন থেকে ওকে বৃন্তচ্যুত করবো না কোনোভাবেই! আর এটাও বুঝে যাই আসলে আমার জীবনের যাত্রাপথে বা আমার গন্তব্যে আমি শুধু একাই!

অনিন্দ্যের আগমন আমাকে খুশি করেছিলো কিন্তু আমাকে একটা নামহীন সম্পর্কের মাঝে রেখে কিংবা ওর সমস্ত আশ্রয়স্থল বা ভরসার জায়গার যে বেদনা শুধুমাত্র সেগুলো শেয়ার করার জন্য আমি মনে হয় ভালো একজন শ্রোতা, ভালো একজন সহযোদ্ধা এর বেশি কিছু আমি ওর হইনি বা হতে পারবো না, সেটা সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম। তবুও জেনে বুঝে কেন যে এই সম্পর্কের একটা ক্ষীণ সুতো আমি ধরে রেখেছি আমার মাঝে, নিভৃতে, অনিন্দ্যের বোধের বাইরে। হয়তো ওর বর্তমানের ভেঙে পড়া সম্পর্কটা নিয়ে ওর যে যন্ত্রণা সেখানে আমি আমার বিগত দিনের ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম, যে পথে ছিলাম আমি সম্পূর্ণই একা এবং এই একাকীত্ব বর্তমানেও বহমান। তবে আমি আমার ব্যথাগুলোকে চাইলেই উপেক্ষা করতে পারি। সেভাবেই আছি। আমি জেনে গেছি চলার পথটা সঙ্গী না থাকলে আরো লম্বা হয়ে যায়!

আমার এখানে সূর্য উঁকি দেয় না কোনো আলোর সংবাদ নিয়ে। ছায়াময় উদাসীনতায় রোদ যেন কোথায় হারিয়ে যায়। সময় খেলা করে নূপুরহীন পায়ে। আমি তাকিয়ে রই। ঘুমে ঢলে পড়তে পড়তে আমি কখনো জেগে উঠি বা ঘুমাই। কখনো দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপে আটকে থাকি অনন্তহীন! এ চলা, এ সম্মুখযুদ্ধ সবই একটা প্রশ্নে এসে মিলিয়ে যায় – পথটা আর কতখানি লম্বা! আমার নিজের কথা যেন এখন সব নিজের সাথেই।প্রেমহীন রাতে। নিস্তব্ধতার রাতে। ভালোবাসাহীন বিছানায় একাকীত্বের গন্ধে জড়িয়ে। তবুও হয়তো আনমনে বলি – কিছু বলো, আমি কিছু শুনতে চাই। তাকে বলতে চাই নামহীন আমি প্রাণপণে কান পেতে থাকি কিছু শুনবার আশায়, এই আঁধারে। বাইরে ঝিলিমিলি রাতের রঙিন ফোয়ারা হাতছানি দিয়ে যায় আমাকে অবিরত!

আলোর পাণে নির্ণিমেষ অপেক্ষা

আজকাল অনিন্দ্যের মাঝে আরেকজন অনিন্দ্য ঢুকে গিয়েছে ওর এমন মনে হয়। ঠাণ্ডা এক অস্তিত্ব নিয়ে সারাক্ষণ ওকে জানান দিয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে, তোমার জন্য দুঃখ হয় অনিন্দ্য! রাতের বেলা এই অশরীরী অনুভব ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। রাতে যখন শায়লা, তিতলী ঘুমিয়ে পড়ে ঘরের আলো আঁধারির দোলাচলে, পর্দার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সেই আরেকটা অস্তিত্ব ধীরে ধীরে অনিন্দ্যকে গ্রাস করে নেয়। ও তখন মৃত্যুর গন্ধ পেতে থাকে। এ গন্ধের নাম নেই এক সীমাহীন ক্লান্তি আর আতংক ছাড়া। নিজেকে ভীষণ একলা মনে হতে থাকে। ওর সেই আরেকটা আমি অনবরত কানের সামনে ওকে বলতে থাকে –

তোমার নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। আমি আমার সব অন্ধকার দিয়ে তোমাকে শুষে নিয়েছি। তোমার শব্দ, তোমার অনুভব, তোমার সবুজ ভূখণ্ড, তোমার স্বপ্ন, তোমার ঘর, তোমার হৃদয়, সব – তোমার সবকিছু। তুমি এখন থেকে সূর্যের দেখা পাবে না, রাতের পূর্ণিমা পাবে না, উদ্দাম ঢেউয়ের শব্দ শুনবে না। তুমি মানুষ হয়েও পরিপূর্ণ মানুষে আর থাকবে না। হয়ে যাবে নামহীন একজন মানুষ, কোনো দুঃস্বপ্নের আধার, স্বপ্ন দেখা বা স্বপ্ন বয়ে বেড়ানো এক ভারবাহী মানুষ। আজ থেকে আমিই অনিন্দ্য!

অনিন্দ্যর ভীষণ ভয় লাগতে থাকে এই অন্ধকারে। বোবায় ধরা মানুষের মতো বিছানায় নড়াচড়াহীন হয়ে অক্ষম আক্রোশে ও ফুঁসতে থাকে। চোখ থেকে দুর্বল পুরুষের মতো নোনা জলের ধারা বইতে থাকে। ও ভাবতে থাকে একজন মানুষকে কী কোনোভাবে ধরে রাখা রাখা সম্ভব? নিজের জমানো সব শব্দ, আকুতি দিয়ে কাউকে একটা ফ্রেমে রেখে দেয়া সম্ভব? ও কী পারবে ওর বুকের ভেতরের নরম জায়গাটায় শায়লাকে আটকে রাখতে যখন ও স্পষ্ট করেই জানে ওকে আর কখনোই ফিরে পাওয়া যাবে না কিংবা এর চেয়ে বড় যন্ত্রণা আর কী হতে পারে নিজের ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলা বা এই যন্ত্রণাময় যন্ত্রণা বয়ে চলাকে বহমান রাখা!

ঠিক এখানটায় এসে অনিন্দ্যের সব চিন্তা থেমে যায়। ঠিক এখানটায় এসেই ওর সব ভাষাগুলো হারিয়ে যায়। ঠিক এখানটায় এসেই ওর গুছিয়ে রাখা সব গোলাপের পাপড়ি গুলো দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে ঝরা পাতা হয়ে যায়। ঠিক এখানটায় এসে ওর সমস্ত গল্পগুলো শেষ হয়ে যায়। একটা নীল ঘুড়ি বাঁধন ছেড়ে আকাশে উড়তে উড়তে কোথাও গিয়ে হারিয়ে যায় কিংবা পাতাঝরা গাছের ডালে আটকে রয় বাঁধনমুক্ত হবার অপেক্ষায় কিংবা আবার উড়বার অপেক্ষায়। এখান থেকেই গল্পটা আবার শুরু হয় অনিন্দ্যের।

সমাপ্ত

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৪ সকাল ১১:৪৭
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×