somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চন্দ্রাহত

০৭ ই জুন, ২০১৪ রাত ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার স্ত্রীর কিছু কিছু ব্যাপার আমার পছন্দের ছিল না। এর মাঝে একটা ব্যাপার ছিল তীব্র অপছন্দের। সে মাঝে মাঝে কারণ ছাড়াই দীর্ঘ সময় ধরে ক্লান্তিহীন ভাবে কাঁদতে পারতো। যদিও সে বলতো ' এমনি কাঁদছি, কোনো কারণ নেই' বলে লম্বা শব্দে নাক টেনে কান্নার একটি পরিসমাপ্তি টানার চেষ্টা করলেও আমার পরিণত মন কিন্তু ঠিকই তার কান্নার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতো। তার কান্নার পেছনে অনেক কারণই থাকতে পারে। আর নারীরা অধিকাংশ কাজই উদ্দেশ্যহীন বাহবে করে, কারণ ছাড়াই কোনো ঘটনা ঘটায় বোকার মতো। হয়তো কথাটা ঢালাওভাবে একতরফা বলে ফেললাম। আসল কথা হচ্ছে আমার স্ত্রী যখন কাঁদে তার খাড়া নাকের অগ্রভাগটা যেন হঠাৎ করেই মোটা লাগতে থাকে আর সামনের দিকটা লাল হয়ে থাকে। তখন তাকে দেখতে খুবই বাজে লাগে। আর আমি তাকে সবসময় তার স্নিগ্ধ রূপে দেখেই অভ্যস্ত ছিলাম। এমনকি তার নাকের সৌন্দর্যে তাকে আমি এটাও বলতাম মাঝে মাঝে -

' রুশা, তুমি কি জানো তোমার সাথে সাথে তোমার নাকটাও হাসে, নাকটাও কথা বলে!'

তার কান্নার ব্যাপারটা শুধু তার কান্নার মাঝেই বা চোখ থেকে পানি ঝরানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলে না হয় আমি এ বিষয়ে এত দীর্ঘ প্রসঙ্গের অবতারণা করতাম না। তার চোখের পানি নাকি বৃষ্টির ফোঁটার মতো বড় বড় যা তার ছোটবেলার গৃহশিক্ষক বলেছিলো আর এ কথা আমি অনেকবার রুশার মুখ থেকে শুনে থাকলেও তখনো এ দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য অর্জন করে উঠতে পারিনি। লোকমুখে শুনতাম, নাটকস-সিনেমাতেও বলতে শুনেছি - নারীদের কান্না নাকি পৃথিবীর মধুরতম দৃশ্যের মাঝে একটি। কিন্তু রুশার কান্না আমার শুধু অপছন্দেরই ছিলো না, আতংকেরও ছিলো। সে কাঁদতে কাঁদতে যেভাবে তার হাতের তালুতে জোরে জোরে ঘষে চোখ মুছতো, আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকতাম এই না চোখের মনিদুটো তার অবস্থান পরিবর্তন করতে হাতের তালুতে না মার্বেলের মতো গড়িয়ে পড়ে। তখন এক রুদ্ধশ্বাস আতংকের পরিবেশ তৈরি হতো আমার ভেতরে।

বস্তুত আমি রুশাকে খুব বেশি ভালোবাসতাম, ভালোবাসিও। তাই তার অন্যান্য স্বাধীনতার সাথে কান্নার স্বাধীনতাটাও ছিলো অবাধ এবং অসীম। সে সময়টায় আমার নিজেকে ভীষণ শৃঙ্খলিত মনে হতো। তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখা ছাড়া আমার আসলে তখন কিছুই করার থাকতো না। কারণ সে এমন তীব্রভাবে আমাকে তার ফোলা ফোলা চোখের ভাষায় স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতো যে সে এখন কার কথা, অনুরোধ শোনার জন্যই প্রস্তুত না তার কান্না থামাতে এবং নীরবে এও বুঝিয়ে দিতো যেন আমি তাকে বাঁধা না দেই। আমি হয়তো চাইলেই আমার বর্বর পুরুষসত্তাকে জাগিয়ে তুলতে পারতাম কিংবা তাকে বারান্দায় চলে যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দিতে পারতাম কিংবা সশব্দে শোবার ঘরের দরজাটাও বন্ধ করে দিতে পারতাম। ততদিনে আমি তার প্রেমিক থেকে স্বামী হবার অধিকারটাও অর্জন করে ছিলাম। কিন্তু তার সব ব্যাপারেই আমার এতোটা ছাড় ছিলো যে প্রেমিক বা স্বামীর মাঝে আমি তেমন কো নো তফাৎ খুঁজে পাইনি। তাই আমি তার সামনে শুধুমাত্র সে সময়টায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতাম যতক্ষণ না তার কান্না বন্ধ হয় এবং সে প্রক্রিয়াটা ছিলো দীর্ঘ। তবে সে যে খুব ঘন ঘন বা প্রতিমাসেই এ ধরণের কাজ করতো তা কিন্তু নয়।

আমি আসলে দীর্ঘ এক যুগে রুশার সব ধরণের আচরণের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম, অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই প্রথম দিককার মতো তার কোনো আচরণে নিজের উপর আর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতাম না। সত্যি বলতে কি আমি তার মতো করে মানবমন বুঝতে চেষ্টা করতাম, রুশাকেও বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু ধীরে ধীরে সঙ্গোপনে হয়তো আমার দৃঢ়তায় ক্ষয় ধরেছিলো। অন্যকে প্রভাবিত করার মতো যথেষ্ট মানসিক দৃঢ়তা তার মাঝে থাকলেও সে শুধু সেতা তাদের উপরেই প্রয়োগ করতে যাদের সে ভালোবাসতো, পছন্দ করতো। শুধু যেদিন যেদিন সে কাঁদতো সে হয়ে উঠতো পৃথিবীর অবুঝতম বালিকার মতো। এক পর্যায়ে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতো তার মৃত পিতামাতার উপর কেন তারা রুশাকে পৃথিবীতে এনেছিলো, কেন বুঝতে শিখিয়েছিলো জীবন কি, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো জীবনের গভীরতম সুখ এবং দুঃখের সাথে। সে সাথে সাথে এটাও ভাবতো পৃথিবীতে যদি রুশা না থাকতো বা না আসতো তাহলে কার কতখানি ক্ষতি বা লাভ হতো ইত্যাদির সব সম্ভাব্য এবং সম্ভাবনাহীন কারণে হতাশায় ডুবতে ডুবতে অন্ধকারাচ্ছন্ন, আলো- হাওয়াহীন কুঠুরিতে নিজেকে নিমজ্জিত করতে চাইতো। কখনোবা নিজের শরীরের সহ্যক্ষমতা পরীক্ষা করতে নিজের উপরে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষানিরীক্ষাও সে চালাতো। জীবিকার প্রয়োজনে আমার পক্ষে সারাক্ষণ তাকে দেখাশুনা করা সম্ভব ছিলো না বলে বাসায় একজন সার্বক্ষনিক গভার্নেসের ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো। সে যে চিৎকার চেঁচামেচি করতো বা কারো ক্ষতি করতো তা নয় কিন্তু আমি চাইতাম সে সুখী হোক, সে আনন্দে থাকুক, কষ্ট না পাক এবং ভীত না হোক।

তার সুখী হবার ধরণটা ছিলো যেমন ভিন্ন রকমের তেমনি তার ছিলো বৈচিত্র্যপূর্ণ একেকটা ফোবিয়া। দুই একটা উদাহরণ দিলে সেটা স্পষ্ট হবে। এখানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখি, আমরা বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়াই একসাথে আট বছর ছিলাম এক ফ্ল্যাটে। তারপর দুজনেই এ সিদ্ধান্তে পোঁছাই একে অপরকে বড় ধরণের কোনো সমস্যার সম্মুখীন করা ছাড়াই আমরা একসাথে সামনের দিনগুলোতেও একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে থাকতে পারবো এবং আমরা নিশ্চিত ছিলাম আমাদের সম্পর্কটা তিক্ততার মধ্য দিয়ে শেষ হবে না। সে সময়টায় রুশা একটা অফিসে কাজ করতো এবং তার ভয়াবহ ' বস ফোবিয়ার' সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। সে তার বসকে কোনো কারণ ছাড়াই ভয় পেতো এবং একই সময়ে তীব্রভাবে তাকে ঘৃণাও করতো। যদিও রুশা বলেছিলো লোকটা ছিলো হিংসুটে প্রকৃতির, খিটখিটে মেজাজের, সর্বোপরি কাজ সংক্রান্ত প্রতিটা জিনিসই সে গোপন করতে চাইতো তার কাছে যা তাকে দিনকে দিন হতাশায় ফেলে দিচ্ছিলো। আচ্ছা তুমিই বলো অফিসে কাজ ছাড়া তুমি ঘুরে বেড়ালে বা বসে থাকলে অন্যদের মনে কি তোমাকে তোমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না? - রুশা আমাকে জিজ্ঞেস করতো তার কথার মাঝে।

"লোকটা পরম নিষ্ঠার সাথে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে তার নাকের ফুটোতে খোঁচাখুঁচি করতো, নাকের ভেতর থেকে ময়লা এনে টেবিলের তলায় হাত রেখে মুছে ফেলতো টুপ করে আর তার কনিষ্ঠ আঙুলটা দুর্ঘটনাক্রমে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাঁকিয়ে যাওয়াতে বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে সবসময় ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটাকে মোচড়াতো - রুশা তার বসকে নিয়ে এমনটাই জানিয়েছিলো। ' আমি চরমভাবে চাইতাম লোকটা আর অফিসে না আসুক। সে এলেই আমার কাজগুলো ভুল হয়ে যায়, আমার শিথিল পেশীগুলো ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে আসে, আমার ঘন ঘন পিপাসা পায়। তুমি বিশ্বাস করো স্যাম, আমি অফিস যেতে যেতে রোজ এটাই ভাবতাম, আজ সে সকাল আটটার বদলে দশটায় আসুক কিংবা আজ যেন তার গাড়ির ইঞ্জিনটাই বসে যায় কিংবা সে যেন হাসপাতালে তার অসুস্থ আত্মীয়কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনও হতে পারে আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামবে কিংবা ধূলি ঝড় শুরু হবে, তার চলার পথে বড় বড় গাছের গুড়ি পড়ে যেন পথটা রোধ করে দাঁড়ায় অথবা ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে দিগম্বর হতে হয়, সর্বস্ব খোয়া যায় যাতে লজ্জায় সে অন্তত আজকের মতো অফিসমুখো না হয়। আমি রোজ এমনটাই ভাবতাম আমার বসকে নিয়ে, বুঝলে স্যাম? কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে লোকটা যথাসময়ে হাজির হতো।

তার পদচারনায় অফিসের চেয়ারটেবিলের সাথে সাথে আমিও কাঁপতাম। আমি ভীত হতাম এই না তার কারণে কোনো কাজে ভুল করে ফেলি, বিরক্ত হতাম তার কারণে একই কাজের পুনরাবৃত্তি যোগ হতো আমার কাজের তালিকায় শুধুমাত্র তার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এবং ঘৃণা করতাম তার ভুলটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে সেটা অস্বীকার করাকে, আমার ভাবমূর্তি চেয়ারম্যানের কাছে খারাপ করাকে। এইভাবে প্রতিদিন বৈচিত্র্যহীন মানুষটার সময় মেনে চলে অফিসে আসাকে আমি অপছন্দ করতাম, সে অফিসে আসবে না এই সম্ভাবনাকে উজ্জীবিত করে কার্ড পাঞ্চ করে আমার উপস্থিতিকে গতিশীল রাখতাম এবং বস অফিসে পৌঁছাবার আগেই আমি আমার সকালের কফিটা পান করে নিতাম যাতে দুপুর পর্যন্ত মস্তিষ্ককে সচল রএবং সতেজ রাখতে পারি। যতবারই কোনো কাজে আমি তার টেবিলের সামনে যেতাম তার বিরক্তি মাখানো এবং সবজান্তা ভাব ধরে রাখা চেহারাটা দেখলে কাল্পনিক কাঁটাযুক্ত কোনো গাছের ডাল দিয়ে তার সারা শরীরে আমি পেটাতাম এবং রোজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হবার আগে তাকে আমি খুন করে আসতাম। কোনো কোনো দিন আমাকে তার গাড়িতে করে ফিরতে হলে আমার কপালের দু'পাশের রগ দপদপ করে লাফাতো কারণ আমার ঘরে ফেরার আনন্দটা, সন্ধ্যেটা সে নষ্ট করে দিতো তার জ্ঞানী জ্ঞানী কথার ভারে, আমি আরো নিস্তেজ এবং হতাশায় ডুবে যেতাম। আমি এই লোকটার কাছে মুক্তি চাচ্ছিলাম কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। এই চাকরীটা ছাড়তে হলে আমাকে আরেকটা ভালো বেতনের চাকরী যোগাড় করতে হবে যা চাইলেই সবসময় পাওয়া যায় না। ”


রুশা এসব বলে কাঁদতে কাঁদতে আমার কাঁধে লুটিয়ে পড়তো। এক পর্যায়ে কান্না থামলে সে আমাকে জিজ্ঞেস করতো -' কি হতো আমি তাকে খুন করলে ? কি কি হতে পারতো তাকে যদি আমি সত্যিই খুন করতাম ?' তখন তার সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিতে আমরা দুজনে মিলে কাল্পনিক অনেক ধরণের খুনের পরিকল্পনা করতাম। রুশা খুশি হতো। তার পরবর্তী কিছুদিন অগ্রীম খুনের আনন্দেই কেটে যেতো। সে দিনরাত্রি তার আশেপাশে তার বসকেই দেখতে পেতো, তার গলার আওয়াজ পেতো এমনকি টয়লেটে গেলে পর্যন্ত তার মনে হতো বাইরে থেকে বস দরজা নক করছে তাকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে কাজ করার জন্য। রুশার ভিজুয়ালাইজেশন পাওয়ার এত বেশি ছিলো যে সে সত্যিই মনে করতো তার বসকে সে খুন করেছিলো। কিন্তু রোজ সকালে যখন দেখতো মরে যাবার পরেও বস কেমন করে অফিসে আসছে, তাকে বিভিন্ন কাজের আদেশ দিচ্ছে এমনকি মাঝে মাঝে তার স্ত্রীর রান্না করা টুনা মাছের সাথে স্প্যাগেটি আর সালাদ খেতে শেয়ার করছে রুশাকে, সে সময়ে রুশার নীরবতা, কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম এবং চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু উচ্চারন করার ভঙ্গিমাতেই প্রকাশ পেতো তার আতংকিত রূপ। সে তখন চোখ খুলতে চাইতো না, নিজের কান চেপে ধরে জীবিত বসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চাইতো, সে চাইতো বসের মুখ নিঃসৃত কোনো শব্দও যেন তার কানে আর না ঢোকে। ধীরে ধীরে রুশা অসুস্থ বোধ করতে থাকে, যখন তখন অফিস কামাই করা শুরু করে। অনিয়মিত উপস্থিতি আর অমনোযোগিতার কারণ দেখিয়ে এক সময় তার বস মিস্টার কিম অনির্দিষ্টকালের কালের জন্য তাকে ছুটিতে পাঠায়। কিন্তু রুশা আমাকে যখন তার আতংকিত অবস্থা আর তার মানসিক অবস্থা ব্যাখ্যা করেছিলো, আমি সে সময় রুশাকে বাঁধা না দিয়ে বলতে দিয়েছিলাম, তাকে কাঁদতে দিয়েছিলাম যতক্ষণ না পর্যন্ত তার শরীরের কাঁপুনি থামে।

এরপর অনেকটা বছর অতিবাহিত হলেও রুশার বসসংক্রান্ত ফোবিয়া কাটেনি। এ ব্যাপারে তার সাথে আমার কথা বা আলোচনা না হলেও তাকে নতুন করে অন্য কোথাও চাকুরীর ব্যাপারে আগ্রহী হতেও দেখিনি। এমন যে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিলো যে সংসার চালাতে গেলে দুজনেরই আয় করতে হবে। কিন্তু তাকে আমি বহির্মুখী করার মানসে চাইতাম সে কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকুক, বাইরে বের হোক, অন্তত বিকেল বেলায় পার্কে হাঁটুক, প্রীমাভেরা ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হোক, ব্রীজের কাছ ঘেঁষে যে ছোট পার্কটা তৈরি হয়েছে সেখানে খেলাধুলায় ব্যস্ত বাচ্চাদের দেখলে যাতে তার ভালো লাগে, নতুন কিছুর প্রতি তার আগ্রহ এবং মনোযোগ ধাবিত হয় সেদিকেই আমি সচেষ্ট ছিলাম। অথচ রুশা ঘরের বাইরে যেতে খুবই কম পছন্দ করতো, অন্ধকার, আলো- আঁধারি স্থানই তার পছন্দ ছিলো এবং কোলাহলপূর্ণ জায়গা, উচ্চ শব্দ এড়িয়ে চলতো। যদিও আমি খুব কম সময়ই পেতাম তাকে নিয়ে বাইরে বের হবার কিংবা সানমারিনোর রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে লোকালয় ছাড়িয়ে মেঘের কাছাকাছি পৌঁছাবার, জায়গাটা অনেক উঁচুতে অবস্থিত ছিলো। নিরিবিলি ঐ জায়গাটায় সবুজ ঘাসের ওপর ছোট একটা ছাউনি ছিলো আর পাথরের তৈরি একটা বেঞ্চ। এমনিতে রাস্তায় হাঁটার সময় আমি খেয়াল করেছি ছোট ছোট বাচ্চাদের ওদের বাবা-মায়ের হাত ধরে বা কাঁধে চড়ে যেতে দেখলে রুশা খুব আগ্রহ ভরে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমি ধরেই নিয়েছিলাম হয়তো তার মাঝে মাতৃত্ব বোধ জেগে উঠছে কিংবা খুব শীঘ্রই সেও ‘মা’ হতে চাইবে। মোট কথা আমি তার নীরবতার মানে সবসময় বুঝে উঠতে পারতাম না। সে তার স্বাধীন সত্ত্বার জন্য যেমন একদিকে খুশী ছিলো তেমনি সে কারো ‘মা’ হতে কেন চাচ্ছে না, তার ভেতরে কেন মাতৃসত্ত্বা জেগে উঠছে না বলেও সে কাঁদতো আবার একই সময়ে সে বলে উঠতো –

আমি তো সবারই মা, পৃথিবীর মা তাই না স্যাম?

প্রত্যুত্তরে তাকে আমার বলতেই হতো –


তুমি চাইলে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারো, কিছুটা ঘুমিয়ে নাও। ভালো লাগবে তোমার।

লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার কোলের কাছে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অভিপ্রায়ে রুশা বলতে থাকতো –

“ আমি মা হলে আমার সময়টা কাটবে সন্তানদের বড় হয়ে উঠবার প্রতীক্ষায়। একসময় তারা বড় হয়ে যাবে, তুমি চাকুরী থেকে অবসর নেবে, একদল বৃধ বন্ধুদের দল জুটিয়ে সান পাওলোর গীর্জার সামনের পার্কটায় সময় কাটাবে অর্থহীন সব বিষয়ে আলোচনা করে করে এমন ভাব ধরে যে জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়েই তোমরা কথা বলছো। একটা সময় আমাদের সন্তানেরা ধীরে ধীরে ঘরের চেয়ে বাইরেই সময় কাটাতে পছন্দ করবে, জীবিকার খোঁজে ইংল্যান্ড, অষ্ট্রিয়াতে যাবার জন্য ব্যস্ত হবে আর আমি তোমাদের জন্য টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত, নীরস হয়ে পড়বো ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া খাবারগুলোর মতো। তখন আসলে আমার জীবনের মানে বলতে কিছু থাকবে না আত্মহত্যার কথা ভেবে সময় কাটানো ছাড়া আবার হয়তো সাহসের অভাবে মাহেন্দ্রক্ষণে সুযোগ পেয়েও আমি জীবনকে খুব করে আঁকড়ে ধরতে চাইবো, ভালবাসবো, লোভী হয়ে উঠবো বেঁচে থাকার জন্য। আমি ধীরে ধীরে আরো বৃদ্ধ হবো, চামড়ায় ভাঁজ পড়বো, দৃষ্টিশক্তি আরো ক্ষীণ হবে, জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাবো। একটা অসফল, একাকীত্বের জীবন কাটিয়ে আমাকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকেই মেনে নিতে হবে আমার স্বামী সন্তান সর্বোপরি একটি পরিবার থাকার পরেও এবং আমি এর বাইরে যেতে পারবো না। হাহ্‌ এই কী জীবনের মানে ? ”

হঠাৎ করে রুশা তার বক্তব্যে ইতি টানলে আমি বুঝে উঠতে পারি না সে ঘুমিয়ে পড়লো কিনা নাকি তার কথা বলার আগ্রহ এই মুহূর্তে ফুরিয়ে গেলো কিনা। আমার জানামতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সে কখনো ঘুমোতে পারতো না। ঘুমের মাঝেই বেশ কয়েকবার জেগে উঠতো, বসে থাকতো, হাই তুলতো আবার ঘুমিয়ে পড়তো। বিশেষ করে টয়লেটে যাবার সময় আমাকেও তার সাথে সাথে দরজা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, এখনো হয়। রুশা টয়লেটের দরজা আটকাতে ভয় পেতো। টয়লেট নিয়েও তার রয়েছে ভয়াবহ ফোবিয়া। আমাদের দুজনের নামে আমরা যে ফ্ল্যাটটি কিনেছিলাম সে ফ্ল্যাটে তিনটে টয়লেট থাকলেও রুশার কারণে প্রতিটি টয়লেট থেকে আয়না খুলে ফেলতে হয়েছিলো। আর টয়লেটের জানালাগুলোতে ভারী, মোটা কাপড়ের পর্দা টাঙানো থাকতো। টয়লেটে ঢুকে সে বেশ কিছুক্ষণ কমোডের দিকে তাকিয়ে থাকতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, কী যেন বোঝার চেষ্টা করতো, চোখ বন্ধ করে কোনো অশরীরী অস্তিত্বের অনুভব আছে কিনা টের পেতো চাইতো এবং যখন নিশ্চিত হতো অশুভ কোনো কিছু আশেপাশে নেই তখনই সে তার প্রাকৃতিক কাজগুলো সারতো। তবে আমার উপস্থিতির জানান দিতে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েও আমাকে তার সাথে বিভিন্ন ব্যাপারে গল্পগুজব করতে হতো। একাকীত্ব যে কতো বড় একটা অভিশাপ সে আমি রুশাকে দেখে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। পরিবারের ভরসা করার মানুষগুলোকে ছোটবেলাতে হারিয়ে ফেলে বিভিন্ন পরিবেশে, বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে বড় হতে গিয়ে কেউ কেউ অজান্তেই তার নিজের ভেতরে ভয়ের আধার বানিয়ে ফেলে, কারো কারো মানসিক গঠনই বদলে যায় খুব তীব্র ভাবে যা আপাতদৃষ্টিতে দেখে বোঝার উপায় থাকে না সে মানুষটি আমাদের স্বাভাবিক চিন্তার চেয়ে একেবারে ভিন্ন, বৃত্তের বাইরের একটি মানুষ।

রুশার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ বা জিজ্ঞাসা আমার চোখেমুখে ফুটিয়ে তোলার আগেই সে জানিয়েছিলো-

“ আয়নার দিকে তাকাতেই আমার কেমন ভয় লাগে জানো তো? জানালার প্রতিবিম্বটা ঠিক আয়না বরাবরই পড়ে। হঠাৎ করে আলো নিভে গিয়ে যদি জায়গাটা অন্ধকার হয়ে যায় কিংবা কেন যেন মনে হয় বিকট কোনো চেহারার আকৃতি সে আয়নায় ভেসে উঠবে যার কোনো বর্ণনা হয় না, যার চোখ দেখলেই হৃদপিণ্ডের কম্পন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আদৌ চোখের জায়গায় চোখ ঠিকঠাক ভাবে আছে কিনা আমি সন্দীহান। হতে পারে তার ঠোঁটের কোণায় ঝুলে আছে সদ্য ভক্ষণ করা মানুষের কোনো দেহাংশ কিংবা এর চেয়েও ভয়াবহ কিছু দেখার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।”

কমোডে বসতেও তার ছিলো সীমাহীন ভয়। তার ধারণা ছিলো সেখানে বসলে তার অন্যমনস্কতার সুযোগে ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যেহেতু আমাদের সমস্ত অলস চিন্তাভাবনা বা ফলপ্রসূ চিন্তার উৎপত্তি কিছুটা সেখানে বসেই হয়। রুশা বলতো –

“ আমি প্রতিমুহূর্তেই সতর্ক থাকতাম সেই কালো, লম্বা নখযুক্ত, লোমশ হাতটি থেকে বাঁচার জন্য যে কিনা কোমোডের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে। তার শারীরিক নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নেই একটি মাত্র হাত ছাড়া, ঐ হাতটিই তার শরীর, ওখানেই তার চোখ এবং মস্তিষ্ক। আর এ হাত একবার কাউকে ছুঁয়ে দিলে কিংবা হাতটি যদি কারো পশ্চাৎদেশের মাংস খুবলে নিলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং একটা সময় সে মানুষটা মারাও যেতে পারে। সবচেয়ে আতংকের ব্যাপার হচ্ছে তুমি যখন জানবে যে তুমি মারা যাচ্ছো। তোমার রক্তকণিকার মাঝে ওঠা ঢেউয়ে তুমি টের পাবে কী করে, কতোটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেখানে মৃত্যু হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাদের পদচারনা তোমাকে আতংকিত করবে কিন্তু তুমি নিরুপায় হয়ে তাদের অস্তিত্ব অনুভব করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না এবং তখন তুমি প্রাণপণে বেঁচে থাকতে চাইবে যে তুমি কিনা হয়তো কিছুদিন আগেও তুচ্ছ কোনো বিষয় নিয়ে নিজের মৃত্যুকামনা করতে।”

রুশা এসব বলতে বলতে ঘেমে উঠতো, চোখের মনিগুলো কিছুটা বিস্ফোরিত হয়ে উঠতো। কমোডের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা না দেখা সেই লোমশ নখওয়ালা কালো হাত এবং আয়নায় অশরীরী কোনো ভয়াল মুখবিম্ব বা এমন কিছু দেখার আশংকায় টয়লেটে ঢুকলেও দরজা খোলা রাখতো তার নিরাপত্তার স্বার্থে আবার একই সাথে বলা যায় সে হতাশও হতো সেই অজানা, অচেনা ভুবনের নামহীন কোনো কিছুকে দেখতে না পেয়ে। সে আমাকে বলতো –

“ স্যাম, আসলে আমি ক্লান্তও বোধ করি যখন আমার ধারণা অসত্য প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমার ভয় পাওয়াটা, জান্তব কিছুর মুখোমুখি হবার জন্য আমার যে মানসিক প্রস্তুতি বা লড়াইটা তা তো আর মিথ্যে নয়। ইতোমধ্যেই আমার শরীরের ক্যালরিও যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষয় হচ্ছে অপেক্ষা, আতংক, লড়াই এবং নিশ্চিন্ত বোধ করতে চাইবার অপেক্ষায়।”

তার বিভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হতে হতে আমার কাছে একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিলো সে যা বলছে এগুলোর প্রতিটাই একজন মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতি, এর কিছু আমরা প্রকাশ করি আর কিছু প্রকাশ করি না।
তার প্রতি যদিও কখনোবা অন্যরকম চোখে তাকাতাম সে আমাকে বলতো –

“ আমার সুস্থতা নিয়ে তোমার হয়তো সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু আমি বলতে চাই আমরা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আসলে কোন ধরণের সুস্থতার উপর বেশি প্রাধান্য দিবো? যাকে আমি চিনি বর্ণহীন হিসেবে, সে পানিকে তুমি বলবে সাদা। কিন্তু তুমিও জানো সাদার নিজস্বতা নেই, অন্যের রঙে সে রঞ্জিত। সে বর্ণহীন বা সাদাকে আমি বেগুনি বললে তুমি বলবে আমি সুস্থ নই, তাই তো ? কিন্তু আমি যদি বলি তোমার কাছে বা তোমাদের কাছে যা সাদা সেটাই আমার কাছে বেগুনি এবং আমার মনে হতে পারে তোমরা আসলে রঙের নাম জানো না, সেটাকে কি বলবে ? আমি শারীরিকভাবে যথেষ্ট সুস্থ এবং স্বাভাবিক। আমার নিয়ম করে ক্ষুধা পায়, ঘুম আসে, যৌন চাহিদাও আছে এবং মানবীয় অন্যান্য সব অনুভূতিও হারিয়ে যায়নি। এখন বলো আমি কি পাগল ? বলো… বলো… বলো...”

রুশা স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অপেক্ষা করে উত্তরের জন্য। আমি নিশ্চিতভাবে জানি সে কী শুনতে চায়। আমি তার চোখের অতলে ডুব দিতে চাই। দেখতে চাই সে ভারসাম্যহীনতাকে যাকে সে ভয় পায়, বুঝতে চাই তার অন্তর্গত মানসিক দ্বন্দ্বকে, তার ক্ষোভ, তার অতৃপ্তি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে, তার ভালোলাগার রঙ, প্রকৃতিকে স্পর্শ করতে। আমি ধীরে ধীরে তাকে আমার মাঝে ধারণ করে বর্ণচোরা হয়ে যায়, রুশাতে একাকার হয়ে যেতে চাই। তবে আমাদের যৌন জীবনটা অন্য প্রেমিকপ্রেমিকা এবং দম্পতিদের মতো স্বাভাবিক নয় সবসময়। আমি রুশাতে কিংবা রুশা আমাতে উপগত হতো খুব কম সময়ই। সে আত্মশৃঙ্গারই বেশীরভাগ সময় পছন্দ করতো তবে সেটা আমার উপস্থিতিতে। সে সময় প্রবলবেগে তার দিকে আকৃষ্ট হতাম বা হতে চাইতাম তার দিকে কিন্তু রুশার মনে হতো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মাঝে প্রবেশ করলেই আগ্রহ, মনোযোগ সব ধ্বংস হয়। সে প্রমাণ করতে চাইতো স্পর্শ না করেও যৌনসুখ পাওয়া সম্ভব তার সঙ্গীর উপস্থিতিতে, তার গায়ের গন্ধে। যখন সে কামাবেগে আক্রান্ত হয়ে শীৎকার করতে করতে নিজে নিজেই ভেঙেচুড়ে পড়তো নিজের মাঝে সে সময়টাকে আমার মনে হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নিষ্পাপ নারীটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে কিছুক্ষণ আগেও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডাকে, আমার ঘর্মাক্ত শরীরের গন্ধ শোকে, নোনা স্বাদ নেয় তার ক্লান্তও জিহ্বা দিয়ে পুনরায় তাকে উজ্জীবিত করতে, আমার স্তনবৃন্ত মুখে পুরে আমাকেও কামাবেগে ভাসতে সাহায্য করে। রুশার সাথে যৌনসংসর্গের এই প্রক্রিয়া একই সাথে গভীর আনন্দের এবং অসহনীয় যন্ত্রণারও ছিলো। কিন্তু সত্যভাষণ হচ্ছে আমি রুশার এ ধরণের আচরণের সাথে অভ্যস্ত ছিলাম বলে সবকিছুই আমার কাছে ছিলো চরম উপভোগ্যকর চূড়ান্ত মুহূর্তে তার মাঝে ভেতর নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে না পেরেও।

রুশার মাঝে প্রচণ্ড ডাক্তার ভীতি ছিলো বলে সে ওমুখো হতে চাইতো না। ওর ধারণা সেখানে গেলে ও কখনো ফিরে আসবে না। ডাক্তার একগাদা ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিয়ে ওকে ঘুম পারিয়ে রাখবে এবং সে ঘুম ওর কখনো ভাঙবে না যেমন করে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলো ওর বাবা-মা।

রুশার মানসিক গঠন অন্য মানুষদের মতো ছিলো না। তার রাগ, ঘৃণা, প্রশান্তি, আকাংক্ষা বা যে কোনো কিছুর মাঝে নিজেকে সংযুক্ত করার ধরণ সবকিছুই ছিলো অন্যদের চেয়ে অনেকটা আলাদা, সুতীব্র এবং বৈচিত্র্যে অনন্য। তাকে ছাড়া আমার একদিনও চলতো না, চলেও না যদিও অন্যদের চোখে আমরা কোনো সাভবিক দাম্পত্য জীবন কাটাচ্ছিলাম না। কিন্তু অন্যেরা কী বুঝবে স্বাভাবিকতার মাত্রা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হবারই কথা। রুশা ভীষণ অদ্ভুত এক নারী, আমি তার কাছাকাছি থাকলেও সে আমার অভাব অনুভূত করতো প্রতিটাক্ষণ, বিষণ্ণ হতো, আমাকে ধরে রাখতে চাইতো। সে সবসময়ই মানসিক ভাবে ক্লান্তও অনুভব করতো, সারারাত জেগে থাকতো চোখ বন্ধ রেখেও – তন্দ্রায়, আবেশে, উন্মাদীয় ভাবনা, অবসন্নতা এবং আতংকে। তার এই রূপ কখনো কখনো আমাকে ভীত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুললেও তাকে নিয়ে আমি ছিলাম আশাবাদী, তাকে পুরোপুরি বুঝতে অসমর্থ হলেও সেই না বুঝতে পারার অস্বস্তিকর অনুভূতিটাই ছিলো আমার সুখের উপকরণ।

রুশা তার জীবনপদ্ধতিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে উঠতে পা পারলেও আমি বুঝি প্রতিটা মানুষেরই তার নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশা বা কষ্টের একটা নিজস্ব পরিধি থাকে, কষ্ট থাকে জীবনের অর্থহীনতাকে নিয়ে অধরাকে নিজের মুঠোয় আনতে না পারার ব্যর্থতাকে নিয়ে। আমি জানি আমার মতো রুশাও বোঝে এবং ভাবতে পারে নিয়তির কাছে কি করে সমর্পণ করতে হয়। বস্তুত আমরা সুখীও ছিলাম না আবার অসুখীও ছিলাম না কিন্তু দুজন দুজনকে ছাড়া ভাবতেও পারতাম না। এ ছিলো এক চন্দ্রাহত সময়, এক চন্দ্রাহতময় জীবন – আনন্দের এবং অবলম্বনের।

সমাপ্ত
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×