ভোর বেলার কুয়াশা ভেজানো ঠান্ডা,নিঃশ্বাসের সাথে শরীরের মধ্যে ঢুকে গ্যালো। বুঝতে পারলাম- আজকের দিনটা খুব একটা স্বস্তিতে যাবেনা, সারাদিন ছিপছিপে একটা সর্দি বয়ে বেড়াতে হবে। শীতের দিনের এই রকম ভুক্তভোগী হয়ে চলাটা,শান্তশিষ্ট মনটার সাথে মল্লাযুদ্ধ করেই যাবে, যখন যার অবস্থা ভালো থাকবে তখন তার মর্জিতে চলবে মন। স্যাতস্যাতে সর্দি জিতলে মন খিটমিটে থাকবে, কোনো কিছুই ভালো লাগবে না.. রাগটা তখন প্রশ্রয় পেয়ে খেপিয়ে রাখবে মনকে ..শান্ত মনের আজ খুব পরিশ্রমের দিন।
বনমালীর অধিদপ্তর থেকে যখন বেরোলাম ঠিক বিকেল পাচটায়, ততক্ষণে ডর্জন তিনেক টিস্যু আর আমার দুটো রুমাল নিজ সত্ত হারিয়েছে শান্তমনের পক্ষ নিয়ে, কিন্তু মোটেও জিততে পারেনি,তবে এখনো সর্দি পুরো জয়ী হয়নি, তারও কম ক্ষতি হয়নি, তাই তার জোর বেশ কম …বোঝা যাচ্ছে। এমনতর অসুখে আমি ডাক্তারের কাছে যাই না। নিজের শরীরের ভেতর এমন যুদ্ধ হচ্ছে, হোক না। এন্টিবায়োটিক এসে খুব বেশি হলে একটু সাহায্য করতো কোনো এক পক্ষকে, নির্ঘাত সেই শক্তিশালী পক্ষ বিনা যুদ্ধেই জিতে যেত। কিন্তু বোঝা যেত না একা একা বিপদ সামলে ওঠার ক্ষমতা কার বেশি!!
একটা পার্কের বুকচিরে শর্টকাট বানিয়ে যেতে হয় বাড়ির দিকে, ওখানেই পিছন থেকে ডাক শুনলাম –
– তাজি,এই তাজি
মহিলা কন্ঠ বলে মনে হলো, ঠিক অবিবাহিত পুরুষের পিলে চমকানো অস্টাদশীকন্ঠ নয়। আবার ডাক এলো-
– তাজিই তো, এই তাজি
ফিরে তাকালাম, কনিকা, কলেজের সময়ের বন্ধু।
শান্তমন একটু শক্তি পেলো কোথায় যেনো, মনে হয় চমকে ওঠাটাই হবে।
– কিরে কেমন আছিস?
– ভালো,তুমি কেমন আছ?
– ভালো, এই দিকটায় থাকিস?
– হ্যা, সামনেই
– কোথায়? সাথে যোগ করলো ও
– বিয়ে করেছিস? আগের প্রশ্নটার উত্তরের অপেক্ষা করলো না ও।
পুরনো হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর অনেক দিন পরের দেখায় দ্বিতীয় প্রশ্ন এই একটাই। প্রশ্রয় পেলো যেনো আদ্র সর্দি।
মাঝারি হাঁচি দিতে দিতে বললাম –
– ক .. রি …নি
– হাচিতো আগের মতই আছে, বোমা ফাটানো, করছিস কি?
– বনমালীর কেরানী, তুমিও তো আগের মতই…..
চোখ চলে গ্যালো কনিকার একটু পেছনে বামের দিকে,
– ভাবী
– হ্যা
– তোমার পুত্রকে সামাল দাও,আমি আর পারলাম না।
বলতে বলতে আমার দিকে তাকালো তার চোখ- মায়াবী আর একটু তাচ্ছিল্য মেশানো দৃষ্টি। শান্তমনের পক্ষে কেযেনো বীর হয়ে উঠলো হঠাত। যুদ্ধ সমান তালে চলতে লাগলো।
– আমার ননদিনী কাবেরী, বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিতে নিতে বললো – আর এইটা আমার জান,মাহীন।
কেউ একজন “হ্যালো” বললো, ছোট বাচ্চাটা বেশ চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
– বাসায় ফিরছিলি? চল বসি তাজি, কত দিন পরে দেখা।
অস্টাদশীর কাছে আমার পরিচয় প্রশ্নবোধক রেখে, কাছাকাছি বেঞ্চের দিকে হাটা শুরু করলো কনিকা। এতক্ষণ কোনো সহজ সুযোগ তেমন পায়নি কুত্সীত সর্দি, এইবার পেয়ে শান্তমনকে তরল পানিতে পরিণত করে গড়িয়ে দিলো নাক দিয়ে।
ট্যিসু বেরিয়ে এল হাতে, তরলটাকে সামাল দিতে। কনিকার পাশেই বসে পড়লাম, অন্যপাশে মোহিনী কাবেরী।
– কাবি, ও হলো তানজি, তোমাকে বলেছি না ওর কথা…কলেজে আমার এক রোল পরে,ধুমধাম পিলে চমকানো কাশি দিত।
– ওহ উনিই সেই পেন্সিল! পুরো ১০ সেকেন্ড থমকে গ্যালো যুদ্ধ, আমার পরিচয়ের শেষবেলায় পেন্সিল না বল্লে হত না কি? আবার শুরু হলো যুদ্ধ – সেয়ানের সাথে সেয়ানে।
– হ্যা, হাসলো কনিকা- খুব শুকনো বলে ওকে পেসিল বলেই ডাকতাম।
নাহ, মানা যায় না, পুরো দুনিয়া জুড়ে শীত ঝড় শুরু হোলো যেনো! মনে হয় ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে!
– শুনেছি আপনি খুব সুন্দর কবিতা লিখতেন, ভাবী একটা কবিতা আবৃতি করেছিলেন নবীন বরণে, আমাকে উনি শুনিয়েছেন।
—-
পৃথিবীর সব কিছুকেই আমার জীবন্ত মনে হয়। রাস্তায় চলা রিক্সা কিম্বা পকেটে রাখা মুঠোফোন। বেচারা, জোর করে বলা এই জড় জীবনগুলি, ক্রমাগত সেবা করে যায় বিনা শর্তে, তাই অনেক সাবধানে চলি, এতটুকু আচড় যেনো না লাগে এদের কোনো অংগে। আমার মুঠোফোন দেখলেই তা বোঝা যায়, সাড়ে তিন বছর আগে কেনা, এটাকে আবার আমার কিপ্টেমি ভাববেন না। গত হওয়া আটত্রিশ বছরে শুধুই খরচ করে চলেছি…তবে ডাক্তার থেকে দুরে থাকা কিম্বা নিজের শরীরের দিকে একটু কম যত্ন নেয়া, দু চারটা চুল সাদা করেছে বৈকি!
সেদিন আমার মুঠোফোনের নাম্বার নিয়ে আমার এলাকায় নতুন পড়শী হয়ে আসা, আমার কলেজ বন্ধু, এক রোল আগে থাকা কনিকা ও তার পুরো ফ্যামিলির সাথে, একসাথে থাকা মায়াবী অষ্টাদশী কাবেরী বিদায় নিয়েছিলো। শান্তমনের কাছে বিদ্রোহী সর্দিকাশি হেরে গিয়েছিলো। ভালো ও মন্দের যুদ্ধে কিন্তু ভালোর জয় সব সময়ই হয়।
বেশ কদিন পর, বোধকরি ছুটির দিন, সকালে পুরনো মোবাইলে দুর্বল হয়ে যাওয়া রিংটোন বেশ সবল হয়ে বেজে উঠলো।
– তাজি বলছেন?
– হ্যা
– রাগ করলেন নাতো?
– ক্যানো?
– নাহ, শুধু তাজি বললাম যে। কন্ঠে একটু বিষন্নতা, নাকি ভুল শুনছি!
– ঠিক আছে, বলতে পারো।
কাবেরী- একটু চঞ্চল মেয়ে, এমন মেয়েরা এই বয়সটায় খুব বেশি বিষন্ন হবার কথা না। মেয়েদের দর্শন নিয়ে খুব বেশি ধারণা নেই আমার, এই বয়সী একটা মেয়ে আয়না বেশি দ্যাখে, নিজেকে দেখে, রূপবতী মেয়েরা একটু বেশিই দ্যাখে, কাবেরী কি আয়না দ্যাখে? দেখে দেখে নিজেকে কি বলে?
– কিছু ভাবছেন ?
– না, তেমন কিছু না। গলায় জোর এনে বললাম। কি জানি, কাবেরী মনের ভাব ধরে ফ্যালে কিনা!
– আপনি কি কাউকে পছন্দ করেন?
– না.. .নাতো। ভাবনা গুলিয়ে গ্যালো, এত সরাসরি প্রশ্নে আমার ভড়কে যাওয়া,ধরা খাওয়া মনকে মিথ্যা বলতে ইতস্তত করালো।
– ওহ, আমি ভেবেছিলাম আপনার কেউ আছে। এতটা বয়স হলো, কেউ না কেউ ..
– নাহ,কেউ নেই।
কাবেরী আয়নাতে নিজেকে দেখে একটা প্রশ্ন করতে পারে নিজেকে –
– আরো একজন
– হ্যা নবম, নিজেই উত্তর দেবে আবার –
কাবেরীর মতো সুন্দরী, মায়াবী অষ্টাদশী একটা মেয়েকে আটজন প্রেমের প্রস্তাব দিতেই পারে! আমার মতো দু চারটে চুল সাদা,বত্রিশ বয়সী একজন মানুষ ওকে ভালবাসি,জানতে পারলে….
আয়নার সামনে রূপবতী মেয়েটি একা একা হাসবে বৈকি!
নাহ, আমি ওকে কিছুই বলিনি। দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছিলো, নিজের কাজ, নিজের শরীরের পুরাতন নতুন যুদ্ধ দেখা, কাবেরীর দু একটা ফোন, রিংটোন প্রায় শেষ হবার সময় ধরতাম।
সেদিনও তেমনি, প্রায় শেষ মুহুর্তে ধরে ফেলা কাবেরীর ফোন –
– তাজি
– হ্যা
– ভালো আছেন? এতটুকু বিষন্নতা নেই কন্ঠে, সেই প্রথম দেখার কন্ঠ – কিছুটা বিরক্ত, কোথায় যেনো একটা অসময়ে আঘাত হলো.. মাথায়? রক্তক্ষরণ কি শুরু হলো? কার সাথে যুদ্ধ লাগলো মাথার? প্রতিপক্ষ কোথায়?
ঘাম বিন্দু ফুটে উঠলো কপালে, কানের প্রতি কোষে গরম ভাবটা টের পেলাম!
– কি হলো, চুপ করে আছেন যে ?
– হ্যা…হ্যা, ভালো আছি।
– তাজি, আপনি কি বোঝেন আমি আপনাকে ভালোবাসি?
চুপ করে থাকলাম, কে প্রতিপক্ষ? তার জোর কেমন? মাথায় এই রক্তক্ষরণ আরো ঘামিয়ে দিলো আমাকে, গাল বেয়ে বুকপকেটের দিকে রওনা দিলো বিন্দু বিন্দু তরল ধারা।
– আমি আপনাকে ভালবাসি। কাবেরীর কন্ঠ মায়াবী আর অনেক তরল, ঘাম বুকপকেটে এসে ঠিক বুকে, থেমে দাড়ালো হৃদয়ের উপরে।
– উত্তরটা দিননা প্লিজ
কি উত্তর দেবো কাবেরীর আহবানে? আটত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া বহুপরিচিত শরীরের একটা নতুন যুদ্ধক্ষেত্র, যে যুদ্ধের অন্যপক্ষে কে আছে, সেটার উত্তর খুজতে ব্যস্ত মন, তার ভেতর থেকে কে যেনো, একদম অপরিচিত একজন বলে উঠলো কিছু, ভালোবাসার সচেতন পক্ষের শক্তি জানান দিলো শক্তিমত্তা।
– ভাবছেন? ঠিক আছে ভাবুন, ভেবেই বলুন, আহারে বেচারা ! কাবেরী বলে থেমে গ্যালো।
প্রতিপক্ষ কে, জেনে গ্যালো শরীর, প্রবল হুইসেল দিয়ে দামামা বাজিয়ে দিলো দুইপক্ষ .
মুঠোফোনটা কানে ঠেকিয়েই আছি….
কি উত্তর দেবো আমি?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:২০