somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অ:তপর থাকে শুধু অন্ধকার (ছোট গল্প)

২১ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক সময় তার নাম ছিল নজরুল ইসলাম। নীচু বংশের হত দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ বলে হয়ত কোন কালে-ভাদ্রে অলক্ষ্যেই তার নামের কিছু অংশ হারিয়ে গেছে। এখন সকলের কাছে নজু মিয়া নামে পরিচিত। এই অভাবের সংসারে এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার সুন্দরী কন্যা রাহেলা। সুন্দরী বলেই খুব অল্প বয়সে রাহেলার একটা বিয়ে হয়েছিল। রাহেলার রূপ বেশী দিন ভাল লাগেনি শ্বশুড় বাড়ির লোকদের কাছে উপরন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই সংসারে ঝগড়াঝাটি আর মারামারির কারণে বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তার বিবাহিতা জীবনের সমাপ্তি ঘটলো। অগত্যা পিত্রালয়ে ঠাঁই হল তার। এত দিন স্বামী, শ্বশুড়, শাশুড়ি, ননদের অত্যাচারের কারণে একটা ফৌজদারী মামলা আর কাবিনের টাকা আদায়ের জন্য একটা দেওয়ানী মামলা দায়ের করেছে সে। শ্বশুড় বাড়ির আসামীপক্ষ সবাই জামিনে বেড়িয়ে মামলা মোকাবেলা করে যাচ্ছে। আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরে হতাশায় নিমগ্ন রাহেলা। তার উপর অবিচারের বিচার কোন দিন পাবে বলে মনে হয় না। অন্য দিকে আসামীপক্ষও দু’টো মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছে। তাই দু’পক্ষই স্থানীয়ভাবে ব্যাপারটি মীমাংসার জন্য গ্রাম্য মাতবরের দ্বারস্থ হ’ল।
অতি উৎসাহী হয়ে মাতবর সাব নজু মিয়ার বাড়িতে হাজির হয়। অনেক দূর থেকে নাম ধরে ডাকতে ডাকতে নজু মিয়ার ঘরে প্রবেশ করে। নজু মিয়ার ভাঙা ঘর-কোথায় কিভাবে মাতবর সাবকে বসতে দিবে দিশা পায়না। ছোট মেয়ে ময়নাকে দোকানে পাঠায় বিস্কুট আনার জন্য। তারপর মাতবর সাবের সামনে চা-বিস্কুট আসে। নজু মিয়া পাশে বসা। মাতবর সাব খচ্ খচ্ করে বিস্কুট চিবায় আর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে-
"নজু মিয়া, এতদিন মেয়ের মামলাতো চালাইলা। শ্বশুড় বাড়ির লোক মেয়েটাকে যে নির্যাতন চালাইলো-তোমার কি মনে হয় তোমার জীবনে এই বিচার দেখে যেতে পারবা!"
"জে হুজুর ঠিকই কইছেন। তারিখে তারিখে কোর্টে হাজিরা দিতেই ম্যালা টাকা খরচ-কাজের কাজ কিচ্ছুই দেহি না।"
"এইবার বুঝতে পারছো-আগে যদি আমার কাছে আসতা সুন্দরভাবে ব্যাপারটা মীমাংসা করে দিতে পারতাম। আরে আজ হোক কাল হোক কাবিনের টাকাতো তাদের দিতেই হবে, নাকি! সালিশ ডেকে ওদের জুতাপেটাও করতাম আবার কাবিনের টাকাও আদায় করে দিতাম। তোমাকে আর কি বলবো, তুমি তো বেশী বুঝো।"
মাতবর সাবের কথাগুলো শুনে নজু মিয়ার পরান জুড়িয়ে যায়-সব হিসেব নিকেশ পাল্টে যায়। মাতবর সাবের কাছে এই রকম সহযোগিতা পাবে সে কল্পনাও করেনি কোন দিন। নজু মিয়া এবার মাতবর সাবের পা জড়িয়ে ধরে বলে-
"হুজুর, আমি মূর্খ মানুষ কিছুই বুঝি নাই। দয়া কইরা আমগোরে একটা ফয়সালা কইরা দেন।"
মাতবর সাব নজু মিয়ার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে-
"শোন নজু মিয়া, মামলা চালাইতে তোমার যে টাকা খরচ হয়েছে তাদের খরচ হয়েছে তার চেয়ে বেশী। দেখি সালিশে তোমার মেয়ের কাবিনের টাকা কত উঠিয়ে দিতে পারি। তারাও কিন্তু এমনিতে ছেড়ে দেয়ার পাত্র না।"
"হুজুর এইডা আপনের দয়া। আপনে যেইডা কইবেন হেইডাই হইবো।"
মাতবর সাব যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলে-
"এতক্ষণে একটা খাঁটি কথা বললা। আর শোন এমনিতেই তুমি মেয়েটা নিয়ে কষ্টে আছো-মেয়ের কাবিনের টাকা যত বেশী পারি উঠিয়ে দেব। তবে আমার দিকেও কিন্তু তাকাতে হবে। আমি নিজের খেয়ে তোমার পক্ষে কথা বলতে যাব কেন? যে টাকা উঠবে তার অর্ধেকটা আমাকে দিবা। দেখো চিন্তা করে। এছাড়া এক টাকাও পাও কিনা সন্দেহ আছে।"
কথাগুলো বলতে বলতে মাতবর সাব উঠে গেলেন। তার শেষের কথাগুলো নজু মিয়ার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিল। হয়ত দুর্বলের ভেতরের আগুন ভেতরেই জ্বলে যায়। তারপর একদিন সালিশ-দরবার হল। গ্রামের অনেক লোকের মাঝে মাতবর সাব ঘোষনা দিলেন-
"আগামী এক মাসের মধ্যে রাহেলার কাবিনের সব টাকা তার কাছে জমা দিবে আসামী পক্ষ। নজু মিয়া মামলা তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করলে রাহেলার সব টাকা তাকে দিয়ে দেয়া হবে।"
অতঃপর মামলা তুলে নেয়া হলো কিন্তু রাহেলার ভাগ্যে খুব সামান্য টাকাই জুটেছে। চাপা কষ্ট নিয়ে চলতে থাকে নজু মিয়ার সংসার। সে কষ্ট মন থেকে দূর হতে না হতেই আর এক বিপদের জালে আটকে যায় নজু মিয়া। পাশের বাড়ির সোহেল দিনের পর দিন নজু মিয়ার বাড়ি পড়ে থাকে, রাহেলার পিছনে ঘুর ঘুর করে। রাহেলা সোহেলকে নিষেধ করেছে বহুবার। উপায়ান্তর না দেখে রাহেলা ব্যাপারটা তার বাবাকে বলে। বাবা বড় দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যায়। বাবা খুব সুন্দরভাবে সোহেলকে বোঝালেন এবং তাকে আর এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিলেন।
সোহেল কারো চোখ রাঙানীকে ভয় পায়না। নজু মিয়ার নিষেধ শুনলোনা সে। অন্যদিকে দিনে রাতে রাহেলাদের বাড়িতে সোহেলের আনাগোনার কাহিনী গ্রামময় ছড়িয়ে পরে। এবার মাতবর সাব নিজেই সালিশ ডাকলেন রাহেলা এবং সোহেলের পরিবারকে নিয়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নজু মিয়া মাতবর সাবের বাড়ি গিয়ে ঘটনা খুলে বলে। মাতবর সাব খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে-
"দেখো নজু মিয়া, তোমার এ সব কথা আমি একা বিশ্বাস করলে তো হবেনা। সালিশে যা হবার তা হবে। সেখানে তুমি যদি তোমার কথাগুলো সত্য প্রমান করতে পারো তাহলে তোমার জন্যই মঙ্গল-মানুষ আর খারাপ কিছু বলাবলি করবেনা। তুমি যখন আমার পর্যন্ত আসলা আমি তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করবো। কিন্তু আমি নিজের খেয়ে তোমার পক্ষে কথা বলতে যাব কেন? সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করো কেন! এবার যাও।"
নজু মিয়া এবার ধীর পায়ে বেড়িয়ে আসে। মাতবর সাবের মনের কথা বুঝতে বাকি নেই তার। বাড়ি এসে অনেক কষ্টে ঋণ করে কিছু টাকা জোগাড় করে। সালিশের আগের দিন সন্ধ্যা বেলা মাতবর সাবের হাতের মুঠোয় টাকাগুলো গুজে দিয়ে অনুনয় বিনয় করে।
নজু মিয়ার পরিবারে দুঃশ্চিন্তায় কারো ঘুম নেই, খাওয়া নেই। নির্ধারিত দিন ও সময়ে নজু মিয়া পরিবারের সবাইকে নিয়ে সালিশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সবাই জড়সড় হয়ে হাঁটছে। সন্ধ্যের পরে অস্ফূট আলোয় নজু মিয়া চারিদিকে তাকায়-দেখে পিপড়ের সারির মত মানুষের ঢল।
অতঃপর দু’পক্ষের কথা আর আশপাশের দু’চার জন লোকের কথা শুনে মাতবর সাব ঘোষনা করলেন-
সোহেলের দশটি জুতা পেটা আর বিশ হাজার টাকা জরিমানা, রাহেলার দশটি জুতা পেটা, আর রাহেলার বাবা মানে নজু মিয়ার জরিমানা বাদে তার জন্য দশবার নাকে খৎ দিতে হবে।
সালিশে উপস্থিত দর্শকরা সবাই ঠিক আছে, ঠিক আছে বলে সম্মতি জনায়। প্রথমে সোহেল তারপর রাহেলাকে মাতবর সাব নিজেই দশটি করে জুতা পেটা করলেন। রাহেলা বড় ঘোমটার মধ্যে চেহারা ঢেকে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে, ঘোমটার ভেতর থেকে কোন টু টা শব্দ শোনা গেল না। সব শেষে নজু মিয়া নাকে খৎ দেয়। অনেক উৎসুক দর্শক গুনতে থাকে নজু মিয়ার নাকে খৎ দেয়ার দৃশ্য। সভা শেষে শুরু হলো চারিদিকে অসংখ্য মানুষের দিগ্বিদিক ছুটোছুটি, হৈচৈ, কোলাহল। কিন্তু নজু মিয়া সভা থেকে বেড়িয়ে রাতের আঁধারেই অলক্ষ্যে হারিয়ে যায়। সংসার, সমাজ, গ্রামের কোথাও কোন কালে নজু মিয়াকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

(সমাপ্ত)

নভেম্বর/২০১২
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×