পাশের বাসার বেলকনিতে ল্যাম্পপোস্টের আলোরা আছড়ে পড়ছে, যেখানে আমার দৃষ্টিটা আটকে আছে অনেকক্ষণ। সেখানে অস্ফূট আলো আঁধারের মাঝে কোন একজনের উপস্থিতি টের পেলাম। আমার বাসার বেলকনির রেলিং এর সাথে আামার মাথাটা আলতো করে লাগানো। শুনেছি সে বাসার ভদ্র মহিলা সরকারী চাকরী করেন। একটাই ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। অপরিপক্ক জন্ম হয়েছে তার। দু’পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারে না। আগে কখনো তাদের সাথে দেখা বা কথা হয়নি।
এই প্রথম দেখছি সে যুবকের মায়াময় মুখ। অসহায় দু’টি চোখ যেন বেদনায় ভরা নক্ষত্রের আকাশ। তার কোন অস্থিরতা নেই-দূর থেকে আসা অস্ফূট আলোয় তার মুখাবয়ব এক পাশে আলোকিত। আমার দিকে চোখ পড়তেই নিঃশব্দে দৃষ্টি ফেরালো নীচে, যেন আলো আঁধারের দোলায় নড়ে ওঠা কোন ছায়া। বেলকনির রেলিং এ তার দু’হাত রাখা। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে আমাকে উদ্দেশ্য করে সে বলল-
"আঙ্কেল, আমার নাম সাবাহ। আমি হাঁটতে পারি না। বাবা নেই। মা-ই আমার সবকিছু।"
ওর কথার কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। সরকারী চাকরীর সুবাদে কয়েকদিন হল পরিবারসহ এখানে উঠেছি। জিজ্ঞেস করলাম-
"তুমি কি সারাদিন বাসায় একা থাকো?"
"হ্যা, একা একা। মা অফিস করেন। আর আমি সারা জীবন একা একা। জানেন আমার মা যখন বকেন তখন আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কিছু ভাল লাগেনা।"
"তুমি কি লেখাপড়া করেছো?"
"মা টেনে হিচড়ে যতদিন স্কুলে নিতে পেরেছেন ততদিন পড়েছি। এস.এস.সি. পাশ করেছি। তারপর আর হলনা।"
"তুমি যে বললে কিছু ভাললাগে না, তাহলে তোমার দিন কাটে কি করে।"
"কিছু ভাললাগেনা-সেটাকেই মানিয়ে নিয়েছি। মায়ের অফিস, বাজার-সদায়, রান্নাবান্না, ঘরের কাজ এক কথায় ব্যস্ত জীবন। আমি নিঃসঙ্গ। বলতে পারেন নিঃসঙ্গতাই আমার সঙ্গী। তাছাড়া আমার চারপাশের সব জড় পদার্থগুলোই আমার আপন। আর সব চেয়ে আমার আপন মনে হয়- এই বিশাল নক্ষত্রের আকাশ। জানেন, আকাশের সাথে আমার সব সময় কথা হয়। যখন যা মনে হয় তাই বলা যায়-আমার কোন স্বপ্ন নেইতো। "
কথাগুলো শেষ না হতেই ভেতর থেকে তার মা’র কন্ঠস্বর ভেসে আসলো-
"সাবাহ, খেতে এসো। অনেক রাত হয়েছে। "
"আসছি মা।"
হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলো সাবাহ।
অতঃপর সাবাহর মাকে দেখেছি সকালে অথবা বিকেলে অফিস অথবা বাসায় ফেরার তাড়ায়। কখনো কোন খোলা বাজারে মানুষের ব্যস্ততার ভিড়ে অথবা মুদি দোকানে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে মুখোমুখি হলে শুধু কুশল বিনিময় হয়-এটুকুই। তাকে দেখে সবসময় মনে হয় জরুরী কোন একটা বিশেষ কাজের জন্য তাড়াহুড়ো করছেন। চারপাশের কোন কিছু গায়ে মাখার সময় নেই। কিছু কিছু মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটাই জীবন। হয়ত তিনিও তাদের দলের একজন।
ইদানীং সাবাহর সাথে আলাপচারিতায় তাকে শান্ত মনে হয়েছে। মনে হয়েছে-পৃথিবীর কোন যন্ত্রনা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। একদিনের আলাপ-
"আচ্ছা সাবাহ, তুমি সারাক্ষনই বেলকনিতে বসে থাকো? কিন্তু এখানেই বা কেন?"
"বেলকনিতে থাকি আকাশের তারাদের জন্য। ওদেরকে আমার ভাললাগে। কিছু কিছু তারার মাঝে অলৌকিক ক্ষমতা থাকে, যা পৃথিবীর কারো কাছে নেই।"
সাবাহর মুখে কথাগুলো শোনার সাথে সাথে কেমন যেন অযথাই আগ্রহ বেড়ে গেল। ক্ষনিকের জন্য হলেও মনে হলো পৃথিবীতে অলৌকিক আনেক কিছুই ঘটছে বা হচ্ছে। তারাদের অলৌকিক ক্ষমতা-কথাটা কল্পকাহিনীর মত হলেও সাবাহর কাছ থেকে তা জানার কৌতুহল আটকে রাখতে পারলাম না। ওকে এবার জিজ্ঞেস করলাম-
"বলো কি সাবাহ। তারাদের কি ক্ষমতা যা পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।"
"সৃষ্টিকর্তা কিছু তারা বানিয়েছেন যার শক্তি বা ক্ষমতা সরাসরি পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তু বা জীবকে প্রভাবিত করে। যে শক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই অথচ সেগুলো ব্যবহার করে আমাদের বাস্তবতাকে কল্পনার বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। "
ওর এসব কথা আমাকে আরও আকৃষ্ট করলো। বললাম-
"তোমার মাথায় এধরনের চিন্তা কোথা থেকে আসে।"
"এধরনের ভাবনা কেন আসে জানিনা। তবে আমার পরিচিত কয়েকটা তারা আছে যাদের আলোক রশ্মি দিয়ে আমার ভেতরের অনেক কষ্ট, যন্ত্রনা, কিছু রাগ সহজেই মুছে ফেলতে পারি। আবার কিছু তারা আনন্দ দিয়ে যায় যা একমাত্র আমিই অনুভব করতে পারি।"
এভাবে প্রতিদিন রাতের আঁধারে ওর সাথে গল্প চলে। ওর কথা ওর চিন্তা একটু ভিন্নধর্মী। তার বুঝে বলা আর না বুঝে বলা সব কথাই স্পষ্ট আর কিছু কথা রহস্যময় যা কয়েক দিনের জন্য মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ওর কথাগুলো মায়াময় আর আকর্ষণীয় যা ওর সাথে গল্প করতে আমাকে বাধ্য করে।
একদিন বেলকনিতে ঢুকতেই সাবাহর কন্ঠে ফিস ফিস করে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার দিকে একবার দৃষ্টি ফেলে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো। কিছুই বুঝলাম না। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম-
"সাবাহ, কি হয়েছে বলো। তুমিতো কান্না করার মতো ছেলে নও। "
আমার কথা শুনে কান্নার আওয়ার আরো বেড়ে গেলো, হাউমাউ করে কান্না।
"আঙ্কেল, আমার মা অফিস থেকে আসার পর সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, আর উঠছেন না।"
"বলো কি।"
"হ্যা। আমি অনেক ডাকাডাকি করেছি-কোন সারাশব্দ নেই। মাকে বলেছি আমি আর কোন দিন অবাধ্য হবোনা। রান্না বান্না না করলে আমি খাবো কি। তার পরেও কোন সারা শব্দ নেই। আমার মা মনে হয় মরে গেছে আঙ্কেল।"
কান্নার তীব্রতা আরো বাড়ছে। ওর কথাগুলো শুনে সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। সত্যিইতো সাবাহর এত কান্নাকাটির পরেও ভেতর থেকে কোন সারা শব্দ নেই।
আমরা সবাই ওদের বাসায় গিয়ে দেখতে পেলাম-সাবাহর মায়ের নিথর দেহ পড়ে আছে মেঝে। মুখ থেকে লালা বেড়োনোর চিহ্ন, চারপাশে অসংখ্য পিপড়ের আানাগোনা। আমাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে তিনি বেচে নেই। সাবাহকে বলা হলো-তোমার মা আর নেই।
অতঃপর সাবাহকে দেখা গেলো- তার দু'টো চোখ আকাশের নক্ষত্রের মত অনড়, পাথরের মত ভাষাহীন, বড় অসহায়।
=== ০০০ ===
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১৪