somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতিসংঘে মাতৃভূমির বিমান বাহিনী

২৯ শে নভেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উইং কমান্ডার মুনমি খান মজলসি, পি এস সি
(Armed Forces Journal 2009)

১। গণপ্রজাতণ্ত্রী কঙ্গোর বিক্ষুব্ধসংকুল প্রভিন্স ইতুরির আরও সংঘাতময় একটি অষ্ণল বুনিয়া। স্বর্ণ, হীরক, কোলটিন এবং ইউরেনিয়ামসহ নানাবিধ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির ব্যস্ততম বিমান বন্দরের কণ্ট্রোল টাওয়ারে যখন বিভিন্ন দেশের নানারকম বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো নিয়ন্ত্রনে ব্যস্ত, ঠিক তখনই মনে হলো পেছনে যেন কেউ এসে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। রানওয়ে ফাইনাল এপ্রোচে থাকা ফরাসী সি-১৩০ পরিবহন বিমান; অথবা কিনসাসা, এ্যান্টেবে এবং কিসাঙ্গানী থেকে রসদ নিয়ে উড্ডয়ন করা ব্রিটিশ, ব্রজিলীয় বা চিলি-র পরিবহন বিমানসমূহ; উগান্ডার সীমান্ত সংলগ্ন শহর কেসেসে থেকে ছেড়ে আসা বৃহৎ এম আই-২৬ হেলিকপ্টার; রানওয়েতে কিগালীর উদ্দেশ্যে উড্ডয়নের জন্য অপেক্ষমান ফরাসী সি-১৩০ পরিবহন বিমান; ফরাসী নিয়ন্ত্রিত ইন্টারিম ইমার্জেন্সি মাল্টিন্যাশনাল ফোর্স (ইএএমএফ)-র গ্রাউন্ড অপারশনে সহায়তার জন্য গেজেল হেলিকপ্টারগুলো; অথবা বিভিন্ন গন্তব্য থেকে ছেড়ে আসা বা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে উড্ডয়নের জন্য অপেক্ষারত মাঝারি ও ছোট পরিবহন বিমানসমূহ নিয়ন্ত্রনে ব্যস্ততার মাঝেও যখন পেছন ফিরে ফরাসী বিমান বাহিনীর একজন ফোর স্টার জেনারেলকে আবিষ্কার করলাম, তখন আমার অবাক হবারও অবকাশ ছিল না। কারণ তখনই অপরিসর মোবাইল কন্ট্রোল টাওয়ারের রিসিভারে ভেসে এসেছিল ফরাসী বিমান বাহিনীর অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান মিরেজ-২০০০ এর পাইলটের রাসভারি কণ্ঠ। উচু আকাশে এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং (এইডব্লিও) এবং এয়ার টু এয়ার রিফুয়েলার-র অবস্থান নিশ্চিত করায় যখন আমি মগ্ন তখন তারই মাঝে দরজার বাইরে দাড়ানো বন্ধু ফরাসি কন্ট্রোলার মিশেল তাঁর পরিচয় জানাল। ফরাসী বিমান বাহিনীর সহকারী প্রধান অল্পক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেই তাঁর আস্থা রাখলেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের উপর। গণপ্রজাতান্ত্রিক কঙ্গে বিবাদমান হেমা ও লেন্দু জনগোষ্ঠির মধ্যে সশস্র সংঘর্ষ এবং এর ব্যপকতা রোধকল্পে ২০০৩ সালের ৩০ মে জাতিসংঘ বুনিয়ায় ০১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইএএমএফ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বিমানবন্দর, রিফুইজি ক্যাম্প, সাধারন জনগণ এবং জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অংশগ্রহণরত সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত কবা মূলত এই অস্থয়ী বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব ছিল। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে ০১ সেপ্টেম্বর ২০০৩ থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষি বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘ শুরুতে ৫,৫৩৭ জনবলের শান্তিরক্ষি বাহিনী মোতায়ন করে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, উরূগুয়ে, মরক্কো, ঘানা, নেপাল, সাউথ আফ্রিকা ইত্যাদি সহ আরও কয়েকটি দেশের শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘ সনদের ৭ম ধারা অনুযায়ি গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর সংঘাতপিড়ীত জনগণের সহায়তায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এয়ারফিল্ড সার্ভিসেস ইউনিট এবং ৫ টি এম আই-১৭ হেলিকপ্টারসহ একটি এভিয়েশন ইউনিট প্রথমবারের মত কঙ্গোর শান্তিমিশনে অংশগ্রহণ করে।

২। এ্যামিরেটস্-র স্নিগ্ধ আতিথিয়তা আর মধ্যপ্রচ্যের আকর্ষণ দুবাইয়ের আলোক ঝলমল পথ অতিক্রম করে যতই উগান্ডার এ্যান্টেবে এগিয়ে আসছিল ততই আরও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলাম। ১৯৭৬ সালের ৩ রা জুলাই রাতে বা ৪ ঠা জুলাই সকালে ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনী এ্যান্টেবে বিমান বন্দরে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাওয়া এয়ার ফ্রান্স-এর এয়ারবাস-৩০০ উদ্ধারের প্রায় অসম্ভব একটি অভিযান সাফল্যের সাথে পরিচালনা করে। রূপালী পর্দায় দেখা ইসরাইল বিমান বাহিনীর সি-১৩০ পরিবহন বিমানগুলোর অতর্কিতে উগান্ডার আকাশসীমায় প্রবেশ এবং ৫০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে এ্যানটেবে বিমান বন্দর থেকে জিম্মিদের উদ্ধার অভিযানের সকল দৃশ্যই স্মৃতির মনিকোঠায় ভেসে উঠছিল। শিহরিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে বুঝিবা উগান্ডার স্বৈরশাষক ইদি আমিন আচমকা এসে উপস্থিত হবে তার ভয়ংকর রূপ নিয়ে।

৩। সৌদি আরবের নির্বাসন থেকে ইদি আমিন আবির্ভূত না হলেও সাউথ আফ্রিকার কর্ণেল পিটার আমাদের বিমান বন্দরে স্বাগতম জানালেন। গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট মোতায়েনের আগে এ্যাডভান্স পার্টি হিসেবে ৬ জন অফিসার ও ১২ জন জোয়ানের একটি ছোট দল নিয়ে আমরা ২০০৩ সালের ১০ ই জুলাই উগান্ডার এ্যানটেবে বিমান বন্দরে পৌছি। এ্যানটেবে-কে কঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যাবহারের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ন ও বিমান বাহিনীর এয়ারফিল্ড সার্ভিসেস উইনিট-ই সর্বপ্রথম কঙ্গোর বিক্ষুব্ধ অঞ্চলে মোতায়েনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীর উপর দায়িত্ব পড়ে বুনিয়ার বিমান বন্দরসহ শহরের কেন্দ্র ও তার আশেপাশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। অতঃপর বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কন্টিনজেন্ট-কে নির্দেশ দেয়া হয় ফ্রান্স-র নেতৃত্বে ইএএমএফ কাছ থেকে বুনিয়া বিমান বন্দরের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেয়া। বুনিয়া বিমান বন্দরকে কঙ্গে প্রবেশের এন্ট্রি পয়েন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল সর্বপ্রথম প্রায়রিটি। কারণ বুনিয়া বিমান বন্দর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল অন্যান্য দেশের বাহিনী পর্যায়ক্রমে ইতুরী প্রভিন্সে মোতায়েন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। মাতৃভ’মির বাংলাদেশ সশস্র বাহিনীর প্রতি জাতিসংঘের এই প্রগাঢ় আস্থায় আমাদের মাথা উঁচু হয়ে ওঠে বৈকি।

৪। "হারি আপ গাইস, পিপলস্ আর ওয়েটিং ফর ইউ"। বিমান বন্দরে কোনরকম ইমিগ্রেশন ফরমালিটিস্ ছাড়াই আমরা দ্রƒত গন্তব্যে ধাবিত হলাম। পথে ক'বছর আগে তুরষ্ক সফরের অভ্যর্থনার মধুর স্মৃতী ভেসে উঠেছিল বোধহয়। তবে উগান্ডার আলোকউজ্জল অত্যাধুনিক বিমান বন্দরের পুরাতন টার্মিনাল ভবনের অনতিদূরে পবিত্যাক্ত অংশে আমাদের অভ্যর্থনা মধুর না হলেও রোমাষ্ণকর ছিল নিশ্চিত। উঁচু এলিফেন্ট ঘাসে ঢাকা অন্ধকার দুটি ব্যাবহৃত শেডের কাছে আমাদের নামিয়ে সাউথ আফ্রিকান কর্ণেল বিদায় নিলেন।

- গুড নাইট ইউ গাইস্, এনজয় ইওর স্টেয়িং।
- হোয়ার আর ইউ গোইং? হোয়ার উইল উই স্টে?
- ইটস্ ইওর প্লেস ডিয়ার। দিস ইজ থাউজেন্ড টাইমস্ বেটার দেন বুনিয়া। ইউ আর সাপোস্ড টু বি সেল্ফ সাসটেইন্ড।

প্রাথমিক ধাক্কা ও হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে মুহুর্তেই কন্টিনজেন্ট কমান্ডার লেঃ কর্ণেল শমসেরের নেতৃত্বে সবাই মিলে আবাসন নির্মাণে ব্রত হলাম। রাতের মধ্যেই লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গল কেটে ও পরিত্যক্ত শেডটি পরিস্কার করে বসবাস উপজোগী করে তোলা হল। কিছুক্ষণ পর সন্নিকটেই উইথড্রয়ালের অপেক্ষায় তাবু টানিয়ে থাকা ফরাসী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদবীর জনৈক অফিসার একটি মোবাইল এ্যাভুলুশন ইউনিট রেখে গেলেন। তার কাছ থেকে অফিসারদের জন্য ৬ টি মশারীসহ সিøপিং কডও পাওয়া গেল। স্ত্রী, মা বা বোনের দেয়া শুকনো চিড়া আর গুড় দিয়েই রাতের আহার সেরে আমরা আমাদের শান্তি মিশন শুরু করেছিলাম। তৃতীয় দিন রাতে যখন প্রথম বারের মত চুলায় আগুন জালান হলো, তখন চাল ডালে একাকার খিচুরি দিয়েই হয়েছিল আফ্রিকার মাটিতে আমাদের প্রথম ভোঁজ বা উৎসব।

৫। আপাতত এ্যানটেবেই হল আমাদের কর্মস্থল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর ভারী যানবাহন, যন্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ সহ সম্পূর্ণ লজিস্টিক দেশ থেকে এ এন-১২৪ পরিবহন বিমানে করে প্রথমেই এখানে এসে পৌঁছবে। তারপর জাতিসংঘের লিজ নেয়া সি-১৩০ পরিবহন বিমান ও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এম আই-২৬ হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হবে বুনিয়ায়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত এই পরিকল্পনার কিছুই আমাদের জানা ছিল না। এ্যানটেবেতে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠল এখানে জাতিসংঘ কর্মপ্রণালির সাথে পরিচিত হওয়া এবং শান্তিরক্ষী মোতায়েনে আমাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা। তারই সূত্র ধরে প্রথমেই আমরা এ্যানটেবে বিমান বন্দরের বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং সার্ভিসেস এজেন্সিগুলোর কর্ণধারদের সাথে পরিচিতি গড়ে তুলি। এ্যানটেবে বিমান বন্দরের সমস্ত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিসেস মূলত দুইটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে লিজ দিয়ে দিয়েছে বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় সাভিসের মান শুধু নিশ্চিতই হয়নি, হয়ে উঠেছে অত্যাধুনিক। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় কিভাবে শুধুমাত্র বিমান বন্দর সার্ভিসের বিনিময়ে উগান্ডর ভঙ্গুর অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। জাতিসংঘ ইন্টারিম ব্যবস্থা হিসেবে এ্যানটেবেতে আপাতত একটি মুভমেন্ট কন্ট্রোল অফিস ও একটি লজিস্টিক সেল খুলেছে, পরবর্তীতে যা অনেক বৃহৎ পরিসরে স¤প্রসারণ করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সমুদয় লজিস্টিকসহ কন্টেইনার ও ভারী যানবাহনগুলো সুপরিসর এএন-১২৪ পরিবহন বিমানে ঢাকা থেকে এনে এ্যানটেবেতে জড় করা হয়্। এখান থেকে কন্টেনারগুলো বুনিয়া নিয়ে যাওয়া হয় সি-১৩০ পরিবহন বিমানে করে। আর ভারী যানবাহন যেমন সাজোয়া যান (এপিসি), ফুয়েল ভাউজার ও অগ্নি নির্বাপন যানবাহন ইত্যাদি বড় বড় লরিতে করে প্রথমে উগান্ডার সীমান্ত শহর কেসেসে-তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে এম আই-২৬ হেলিকপ্টারে করে দুর্গম সীমান্ত পারি দিয়ে নেয়া হয় কঙ্গোর বুনিয়ায়। আমাদের কাজ ছিল বাংলাদেশ থেকে আগত
কন্টেইনার ও যানবাহনের আনলোডিং তদারকি ও হিসেব রাখা; কন্টিনজেন্টের প্রয়োজন অনুসারে বুনিয়ার জন্য পাঠানো ফ্রেইটের প্রায়রিটি নির্ধারণ এবং বিমান ও লরীতে যথাযথ লোডিং তদারকি করা। প্রথমেই আবিষ্কৃত হল যে বিমান বাহিনীর কন্টেইনারগুলো ফর্ক লিফ্টার দিয়ে উঠানো যাচ্ছে না। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিসেস এজেন্সিগুলোর কর্ণধারদের সাথে পরিচিতিই এ পর্যায়ে আমাদের বড় ধরণের সমস্যা থেকে উদ্ধার করল। তারা কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদের সবগুলো কন্টেইনার ইলেক্ট্রিক কাটার দিয়ে ছিদ্র করে ফর্ক লিফ্টার দিয়ে তোলার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা শুধুমাত্র একটি অপ্রস্তুত অবস্থা থেকেই রক্ষা পেলাম না, সাশ্রয় হয়েছিল কয়েক হাজার ডলার এবং বাংলাদেশের অত্যাবশ্যকীয় রসদ ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিল তার গন্তব্যস্থলে।

৬। ফরাসী নিয়ন্ত্রিত ইএএমএফ কঙ্গে তাদের আধিপত্যের বিপরিতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কখনই সহজভাবে নিতে পারেনি। তাইতো তারা কঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তৃতীয় বিশ্বের বাহিনীগুলোর দক্ষতা সম্বন্ধে সন্দিহান প্রকাশ করেছিল এবং এয়ারফিল্ড সার্ভিসেস ইউনিটগুলোকে অন্তত তিন মাস তাদের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে হবে বলে অভিমত ব্যাক্ত করেছিল। তাদের এই বৈমাত্রেয় আচরণের জন্য বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অগ্রবর্তী দল বুনিয়ায় পৌঁছে গেলেও এয়ারফিল্ড এরিয়ায় প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছিল না। অবশেষে কিনসাসা ও এ্যানটেবেতে অবস্থান করা দু’জন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের বুনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হোল বিমান বন্দরে ফুটহোল স্থাপনের অভিপ্রায়ে। বুনিয়ার চিফ অব এয়ার অপস ও কঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশন-র প্রতিনিধি ফকল্যান্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উইং কমান্ডার ক্রিস ও’ ব্রায়ান (অবঃ) প্রথমেই বাংলাদেশের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার দু’জনকে যাচাই করে নিতে চাইলেন। এই ট্রানজিশন পিরিয়ডে বুনিয়া বিমান বন্দর থেকে একইসাথে জাতিসংঘের এবং অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক বিমান চলাচলের নীতিমালা তখনও নির্ধরিত করা হয়নি। ক্রিস ও’ ব্রায়ান নীতিমালা প্রণয়নে আমাদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করলেন। উইং কমান্ডার খ্রীষ্টোফারের নেতৃত্বে দুইদিনের অক্যান্ত পরিশ্রমে তৈরী হোল বুনিয়া এয়ারফিল্ডের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজিওর (এস ও পি)। ক্রিস ও’ ব্রায়ান আমাদের তৈরী এস ও পি নিয়ে পরের দিনই রওয়ানা হয়ে গেলেন নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে। পরের সপ্তাহে ক্রিস কিনসাসায় পৌঁছেই আমাদের মোবাইলে অভিবাদন জানাতে মোটেই কার্পণ্য করেননি। ফলশ্রুতিতে তার পর থেকেই আমাদের স্থান হয়েছিল চিফ অব এয়ার অপস্-র কক্ষের অভ্যন্তরেই আধুনিক সুবিধা সম্বলিত অফিস কক্ষে। যে এয়ারফিল্ডে প্রবেশের অনুমতি ছিল না সেই এয়ারফিল্ডের অপারেশনস্ ও প্ল্যানিং-এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হল বিমান বাহিনীর প্রফেশনালদের সামর্থের প্রতিদানসরূপ।

৭। একদিন পরেই ক্রিস আমাদের কন্ট্রোল টাওয়ারে নিয়ে যাবার অভিপ্রায় ব্যাক্ত করলেন আর তখনই অ™ভুতভাবে দ’জনই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যাক্ত করলাম যে সেদিনই আমরা টাওয়ারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করব। কন্ট্রোল টাওয়ারে পরিচয় হল সমসাময়িক সবগুলো যুদ্ধে (গাল্ফ ওয়ার, কসোভো কনফিক্ট ও আফগান ক্রাইসিস) অংশ নেয়া ক্যাপ্টেন জিমের সাথে। ক্যাপ্টেন জিমের সুদক্ষ নেতৃত্বে ওরা মাত্র চারজন কন্ট্রোলার দিয়ে বুনিয়া ও এ্যান্টেবের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল পরিচালনা করে থাকে। জিমের সাথে কথপোকথনের অবকাশেই জেনে নিলাম রানওয়ের ডিরেক্শন, এয়ারফিল্ডের অবস্থান, উত্তর-দক্ষিন দিক নির্ণয় এবং এয়ারফিল্ডের সাধারণ নিয়ম কানুন। পাশ্ববর্তী কন্ট্রোলার যখন কোন এক এরাইভিং ফাইটকে নির্দেশনা দিতে ক্ষণিক ইতস্তত করছিল ঠিক তখনই উইং কমান্ডার খ্রীস্টোফারের নির্দেষে হাতে তুলে নিলাম ’আর টি’ বা মাইক। দেশে ও বিদেশের সমস্ত প্রশিক্ষণ আর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সঞ্চয় নিংড়ে উচ্চারণ করলাম "এ টি সি কিয়ারেন্স"। ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকান পাইলটদের এবং ফ্রেঞ্চ কন্ট্রোলারদের পাশাপাশি জাতিসংঘের এয়ার অপস্-র উধ্বতন কর্মকর্তারাও আস্থা রাখলেন বাংলাদেশী প্রফেশনালদের দক্ষতার উপর।

৮। সেদিন থেকেই জাতিসংঘের কাছে বুনিয়া এয়ারফিল্ডের হস্তান্তরের অনেক আগেই আমরা ফরাসীদের পাশাপাশি বুনিয়া বিমান বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিলাম। বাংলাদেশী বিমান বাহিনীর মান আন্তর্যাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছিল যখন ফরাসীদের সাথে জাতিসংঘের বিমান ও হেলিকপ্টার পাইলটগণ, কঙ্গোর বিভিন্ন বেসরকারি পরিবহণ বিমান চালকেরা, বিভিন্ন এনজিও-দের বিমানসমূহ এবং সর্বোপরি কঙ্গো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি প্রফেশনালদের উপর তাদের আস্থা ব্যাক্ত করেছিলেন। জটিল ট্রাফিক সিচুয়েশনে এক্সপাডাইটেড ল্যান্ডিং-ও পরক্ষণেই সাউথ আফ্রিকান পাইলটের টাওয়ারে ছুটে আসা, বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সঠিক নির্দেশনায় ল্যান্ড করতে পারার আনন্দে যাত্রীদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ক্যাপ্টেন ইউসিস আকাশপথে তার সেসনার ইনজিন ও ককপিট মৌমাছির আক্রমণে পড়লে উদ্ধার পেতে বাংলাদেশী কন্ট্রোলারদের কাছেই আকুল আবেদন করা, অথবা উজবেক ক্যাপ্টেন টোক্টক যখন অকপটে ব্যাক্ত করেছিলেন যে বাংলাদেশী কন্ট্রোলাররাই তার অটোপাইলট- তখন মাতৃভ’মির বিমান বাহিনীর সদস্যদের সামর্থের প্রদর্শণে দেশের সš§ানও বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় বৈকি। তার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় যখন চিলির দুজন শান্তিরক্ষী তাদের মেজর পদে পদন্নতিতে র‌্যাংক পড়িয়ে দেবার জন্য মরক্কোব্যাট, পাকব্যাট, নেপালব্যাট, বা সমহাদেশীয় উড়–ব্যাট নয়, বরঞ্চ আবেদন করেন ব্যানএয়ার কমান্ডারের কাছেই। অদূরে দর্শকসারিতে উপবিষ্ঠ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন জাতির শান্তিরক্ষীদের কন্ঠে জাতিসংঘে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাফল্যের প্রশংসায় গর্বিত হয়ে ওঠে সকল দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:১৫
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×