(১)
মনিজগিরি, উত্তর ব্রহ্মে চাকমা শাসিত এক রাজ্যের রাজধানী। নিম্ন আরাকানে রাজা বিজয়গিরি একটি চাকমা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে রাজা সিরত্তমা চাক রাজ্যের পরিধি আরও বিস্তৃত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে চাকমা রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। পরিশেষে আরাকান রাজ্যের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১১১৮ সালে নিম্ন আরাকান হতে চাকমারা বিতারিত হয়। তারা ক্রমশঃ ব্রহ্মরাজ্যের উত্তরদিকে সরে পড়েন। রাজা মনিজগিরি চাকমাদের সংগঠিত করে উত্তর ব্রহ্মে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাম আনুসারে রাজধানীর নাম রাখেন মনিজগিরি।
(২)
চাকমা রাজ্যের প্রভাবশালী শাসক রাজা অরুনযুগ(মায়ানমারের ইতিহাসে রাজা ইয়ংজ নামে পরিচিত) ।-অরুনযুগ উত্তর ব্রহ্মে কয়েকটি রাজ্য দখল করেন।তিনি ছিলেন তদানিন্তন ব্রহ্মদেশীয় পরাক্রান্ত রাজাদের মধ্যে অন্যতম। ব্রহ্মদেশীয় রাজা মেঙ্গাদি রাজা অরুণযুগের বিরুদ্দে দুবার যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুবারই তাকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহন করতে হয়।
১৩৩৩ খ্রিঃ। রাজা মেঙ্গাদি রাজা অরুণযুগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লক্ষাধিক সৈন্য প্ররণ করেন। যুদ্ধে তিনি এক অভিনভ কুটকৌশল গ্রহন করেন ।চাকমা রাজার সাথে মিত্রতার অভিপ্রায়ে তিনি রাজার জন্য এক রূপবতী রমনী ও শতাধিক হাতি প্রেরন করেন। রূপবতী রমনীকে রাজা মেঙ্গাদির বোন হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। উপহার পৌছে দেয়ার অভিপ্রায়ে একজন শাসনকর্তা ও সহাস্রাধিক সৈন্য মনিজগিরিতে প্রবেশ করে। মূল সৈন্যদেরকে দূরে পাহাড়ে লুকিয়ে রাখা হয়। অরুনযুগ আনন্দের সাথে রাজা মেঙ্গাদির উপহার গ্রহণ করেন। রাতে রাজপুরিতে উৎসব শুরু হলে পুরিতে অবস্থানরত সহাস্রাধিক সৈন্য প্রথমে আক্রমন শুরু করেন। অতঃপর পাহাড় থেকে বের হয়ে আসেন লক্ষাধিক সৈন্য। অতি সহজে পরাজয় ঘটে রাজা অরুণযুগের। ছয় শতাব্দী পূর্বে চম্পক নগরের যুবরাজ বিজয়গিরী আরাকান অভিযানের মাধ্যমে ব্রহ্মদেশে চাকমা রাজশক্তির যে সূচনা ঘটান রাজা অরুণযুগের পরাজয়ের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে।
(৩)
ব্রহ্মদেশীয় রাজা মেঙ্গাদির অত্যন্ত সুযোগ্য মন্ত্রী কেরেগ্রি। তার নেতৃত্বে ব্রহ্মসৈন্যরা শক্তিশালী রাজা অরুনযুগকে পরাজিত করে। রাজার পরামর্শে যুদ্ধে তিনি অনৈতিক কুট কৌশল অবলম্বন করলেও তাতে তিনি অনুতপ্ত নন। সকলেই শুধু তার জয়টাকেই দেখবে। আর ইতিহাস! সে তো সবসময় বিজয়ীর পক্ষে।
কেরেগ্রি যুদ্ধে বন্দী রাজা অরুনযুগ, তিন রানী, তিন রাজপুত্র ও দুই রাজকন্যাকে রাজা মেঙ্গাদির নিকট প্রেরণ করেন। কয়েকদিন পর মন্ত্রী বিজিত রাজ্য হতে অসংখ্য হাতী, গয়াল, অপরিমিত স্বর্ণ ও রৌপ্য, রাজকীয় বহু মূল্যবান সম্পদ এবং বন্দী দশ হাজার সৈন্যসহ নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন।
মন্ত্রীর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা মেঙ্গাদী তাকে মূল্যবান উপহার প্রদান করেন এবং “মহা প্রাজ্ঞ” খেতাবে ভূষিত করেন। এছাড়াও মন্ত্রীর পুত্রের সাথে বন্দী চাকমা রাজার এক কন্যার বিবাহ দেন। চাকমা রাজার অপর কন্যাকে মেঙ্গাদী নিজেই বিবাহ করেন।
(৪)
রাজা মেঙ্গাদি বন্দী চাকমা রাজা, রজপুত্রগণদের প্রতি কঠোর হতে পারলেন না। সম্ভবত বিশ্বাসঘাতকতা ও অনৈতিক উপায়ে যুদ্ব জয় করায় নৈতিক দূর্বলতার কারনে চাকমা রাজা ও রজপুত্রগণদের প্রতি মেঙ্গাদি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি রাজা অরুনযুগকে আরাকানের “ক্যামুছা” নামক স্থানে “ক্যাক্যা” জাতির শাসনভার অর্পণ করেন। চাকমা রাজপুত্র সূর্য্যজিতকে “কিউদেজা” এবং রাজপুত্র চন্দ্রজিতকে “মিঞা” অঞলের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। রাজপুত্র শত্রুজিতকে “কংজা” নামক স্থানে জলকর তহসীলদার রূপে প্রেরণ করেন। বন্দী দশ হাজার সৈন্যকে আরাকান রাজ্যের “ইয়ংখ্যং” নামক স্থানে বাস করার অনুমতি প্রদান করেন।
রাজা মেঙ্গাদি চাকমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও রাজা মেঙ্গাদির্ মত্যুর পর পরবর্তী রাজারা চাকমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। চাকমাদের ওপর চলে নিপীড়ন ও নির্যাতন। ধিরে ধিরে চাকমারা অসহায়, রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে পরে।
তথ্যসূত্রঃ
১।- চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত – বিরাজ মোহন দেওয়ান।
২।- চাকমা রাজ বংশের ইতিহাস – রাজা ভূবন মোহন রায়।
৩।-চাকমা জাতি – সতীশ চন্দ্র ঘোষ।
১ম পর্ব
৩ য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:৪৫