somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অধিকারের নামে রাস্তায় সভা বসেছে

২১ শে অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অধিকার নামের রাস্তায় সভা বসেছে

ভোর ছ’টা।
অফিসগামী নারী-পুরুষের জীবনে এ সময়টা সূর্যোদয়ের মতো নয়—বরং যুদ্ধের ঘোষণার মতো। কারও হাতে কাপ ভরা গরম চা, কারও হাতে ইস্ত্রি করা শার্ট, কারও আবার ঘড়ির দিকে এক ঝলক আতঙ্কিত দৃষ্টি। আজও দেরি করা চলবে না, আজও বসের মুখে “লেট হয়ে গেলো?”—এই শব্দটা শুনতে হবে না, এই আশা নিয়েই শুরু হয় তাদের সকাল।

বাইরে তখন শহরটা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে—কিন্তু এই জেগে ওঠা কোনো কবিতার মতো নয়।
এটা হর্ণ, ধুলো, ভ্যাপসা গরম আর রাস্তায় রাস্তায় থেমে থাকা ক্লান্ত মানুষের কোলাহল।
এই মানুষগুলোই এই দেশের সত্যিকারের ‘জনগণ’।
যাদের ঘামেই গড়ে ওঠে অফিস, কারখানা, বাজার, শহর—সবকিছু।
কিন্তু এই জনগণের জন্যই যেন সবচেয়ে কম জায়গা এই দেশটাতেই।

অফিস শুরু আটটায়, কারও নয়টায়।
তাই তৈরি হতে হয় সকাল ছয়টা থেকেই।
কারও কাছে সকালের মানে শিশির নয়, বরং অ্যালার্মের শব্দ।
কারও কাছে সূর্যোদয় মানে চোখের নিচের কালচে দাগ ঢেকে ফাউন্ডেশন লাগানো।
এই মানুষগুলো রোজ যুদ্ধ করে—কাউকে না মেরে, বরং নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

বিকেল পাঁচটা, কারও ছয়টা।
কাজ শেষ হয়, কিন্তু ক্লান্তি শেষ হয় না।
কাজের পরেও আছে বাজার, আছে বাসা ফেরার লড়াই, আছে রাস্তায় ধৈর্যের পরীক্ষা।
তবুও তারা হাসে, কারণ জানে—এটাই জীবন, এটাই তাদের কর্তব্য।

কিন্তু হঠাৎই কোনো একদিন সেই পরিচিত রাস্তায় “সভা বসেছে”।
রাস্তায় বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, টেন্ট বসানো হয়েছে, মাইক লাগানো হয়েছে,
আর কিছু পেশাদার মুখ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে—
“আমরা জনগণের অধিকার চাই!”

অদ্ভুত এক দৃশ্য—যেখানে জনগণের অধিকার আদায়ের নামে জনগণই রাস্তায় আটকে থাকে।
অফিস ফেরত নারী-পুরুষের মুখে বিরক্তি, বাসের জানালায় ঠাসাঠাসি মানুষ, রিকশাওয়ালা গাল দিচ্ছে, কেউ ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করছে—কিন্তু মাইকের আওয়াজ তবুও থামে না।
তারা বলে, “আমরা জনগণের কণ্ঠস্বর।”
কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরের চাপে সাধারণ মানুষের নিজের কণ্ঠই হারিয়ে যায়।

রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক গার্মেন্টস কর্মী হয়তো তখন ভাবে—
“এই সভায় যদি একবার বলে, শ্রমিকদের জন্য একটা সাশ্রয়ী বাস সার্ভিস দরকার।”
কিন্তু না, সে কথা কেউ বলে না।
তাদের আলোচনার বিষয়—চেয়ার, পদ, ক্ষমতা আর প্রতিশোধ।
মানুষ? তারা কেবল পটভূমি।

এই সভার পর যা থাকে তা হলো—ভাঙা চেয়ার, ছেঁড়া ব্যানার, মাইকের তার, আর ধুলোয় ঢাকা কিছু নষ্ট ফুল।
আর থাকে হাজারো মানুষ—যারা দেরি করে ঘরে ফিরছে, ক্লান্ত পায়ে টলছে,
মাথার মধ্যে মাইকের আওয়াজ এখনো ঘুরছে—“অধিকার, অধিকার, অধিকার…”
তাদের চোখে অধিকার শব্দটা এখন রাগ, ব্যঙ্গ আর অসহায়ের এক প্রতীক।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতাকামী জনগণের স্লোগান ছিল
“আমরা বাঁচতে চাই, আমরা অধিকার চাই।”
৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে সেই উচ্চারণের পর।
কিন্তু আজও সাধারণ মানুষ সেই একই দাবি জানায়—
তফাৎ শুধু এতটুকু, তখন মানুষ রক্ত দিয়েছিল,
এখন দেয় ধৈর্য, সময় আর নিঃশ্বাস।

রাজনীতির নামে এখন চলছে অপরাজনীতি—
যেখানে সভা হয়, কিন্তু আলোচনা হয় না;
যেখানে স্লোগান ওঠে, কিন্তু সমাধান নামে না।
জনগণের নামে শপথ নেয়া মানুষগুলো জনগণের কষ্টকেই আজ ট্রাফিক সিগনালে দাঁড় করিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এই দেশে নাগরিক হওয়ার অর্থ—যানজটে আটকে থাকা।
এই দেশে করদাতা হওয়ার অর্থ—অবমাননা সহ্য করা।
আর এই দেশে সাধারণ হয়ে জন্মানো মানে—
একটি রাষ্ট্রীয় পাপ, যার শাস্তি প্রতিদিনের জীবনে দিতে হয়।

হ্যাঁ, হয়তো এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে,
কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন এখনো বন্দি—
রাজনীতির নামে ক্ষমতার লড়াইয়ে,
অধিকার নামের রাস্তার ধারে বসা সভায়,
আর সেই সভার মাইকে চিৎকার করা কিছু ভাড়াটে গলার কর্কশ শব্দে।

একটা প্রশ্ন থেকেই যায়—
আমরা কি সত্যিই স্বাধীন? নাকি এখনো সেই অধিকারহীন মানুষের সারিতেই দাঁড়িয়ে আছি—যেখানে পথের ধুলোই আমাদের নিয়তি?
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×