হঁ্যা রে ভাই ভেতো বাঙালির দুর্নাম ঘুচানো দুই বাঙালি পুঙ্গবকে গতকাল লন্ডনে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা ব্রিটেনে হামলার জন্য রাসায়নিক বোমা তৈরি করছিল। আবদুল কাহার আর আব্দুল জালাল নামে দুই ভাই, পূর্ব লন্ডনের বাঙালি পাড়াতেই তাদের ঘর থেকে পুলিশ দীর্ঘৰণ প্রচেষ্টা চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে, একজনকে গুলি করে আহত অবস্থায়, অন্যজনকে অৰত অবস্থায়। গত বছর সাত জুলাই লন্ডনে যে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল তখনই পাকিসত্দানী ভাইদের সঙ্গে বাঙালির নামও উচ্চারিত হয়েছিল কিন্তু গতকাল তা সত্যে পরিণত করে দিলো এই বাঙালি পুঙ্গবদ্বয়। আমি জানি না, আমাদের বস্নগবন্ধুদের সেইসব ইসলাম-প্রেমিকরা কোথায়? তারা কেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন এখন? দিন না কিছু বয়ান? আপনাদের এসব বয়ানই তো হবে ব্রিটিশ কিংবা ইউরোপিয় পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা বিভাগের জন্য অমূল্য সম্পদ। নাকি এই ভয়ে কুকুরের মতো লেজটা দু'পায়ের মাঝে রেখে আপনারা লুকিয়েছেন অন্ধকারে?
পঞ্চাশের দশক থেকে ব্রিটেনে বাঙালির যে অভিবাসন শুরম্ন হয়েছিল তা সত্তরের দশকে এসে ব্যাপকতা লাভ করে এবং পুরো আশির দশক পর্যনত্দ এর বিকাশ ছিল। ফলে ইতোমধ্যেই ব্রিটেনে বাঙালির তৃতীয় প্রজন্ম চলে এসেছে। এ পর্যনত্দ বিষয়টি ফেইরিটেল কিংবা রূপকথার মতো সুখপ্রদ ছিল। কিন্তু এর পরেই বিষয়টি কেমন যেন বদলাতে থাকে।
নানাবিধ গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, অভিবাসী কিংবা ইমিগ্র্যান্টদের জন্য ব্রিটেনের মতো উপযুক্ত ও অধিকার-প্রাপ্ত দেশ আর নেই। বিশেষ করে ব্রিটেনের সমাজ, রাষ্ট্র ও অন্যান্য ৰেত্রে ইমিগ্র্যান্টদের অবদান ও অবস্থান ধর্তব্যে এনেই এ কথা বলা হয়ে থাকে। এখানে সাদা চোখে একজন ইমিগ্র্যান্ট আর একজন শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশের মধ্যে পার্থক্য ধরার সাধ্য কারো নেই। তবে হঁ্যা, প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ কিংবা গণতন্ত্রের ছিদ্র দিয়ে ঢোকা বৈষম্য বেহুলার বাসরে সাপ ঢোকার মতোই এখানেও রয়েছে। কিন্তু তারপরও এখানে ধমর্ীয় স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-র মতো মৌলিক বিষয়গুলিতে ইমিগ্র্যান্টদের অবস্থান মূল ব্রিটিশদের চেয়ে কোনও অংশেই কম নয়। রাষ্ট্রীয় খরচে এখানে মসজিদ নির্মাণ ও তা রৰাবেৰণই শুধু নয়, সেখানে সার্বৰণিক ইমাম ও অন্যান্য কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদিও অনেক ৰেত্রেই সরকারী তহবিল থেকে জোগানো হয়ে থাকে ধমর্ীয় স্বাধীনতার নামে। কিন্তু কার্যত্র দেখা গেলো ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক এক উদারতার ভুল প্রয়োগ করতে শুরম্ন করলো ইমিগ্র্যান্টরা বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসীরা। এর শুরম্ন আশির দশকে হলেও নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এসেই এই অপপ্রয়োগ উগ্রতায় রূপ নিতে শুরম্ন করলো।
এর মূল কারণ হিসেবে কিছু সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক ইসলামের পরমতসহিষ্ণুতার অভাব ও অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে অনীহা কিংবা এরকম আরও অনেক কিছুর সঙ্গে অভিবাসী বিশেষ করে আরব ও পাকিসত্দানী বংশোদভ্থতদের ধর্মান্ধতাকেই দায়ী মনে করতেন। সেই সঙ্গে বাঙালি অভিবাসী সম্পর্কে যে প্রশংসার বাক্যটি এতোদিন উচ্চারিত হয়েছে তাহলো, বাঙালি চরিত্র অসামপ্রদায়িক এবং মধ্যপন্থী; সমাজের বিভিন্ন সত্দরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ৰমতাও এই অভিবাসী-গোষ্ঠীর ব্যাপক। কিন্তু এই সত্য চিড় ধরতে শুরম্ন করে নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগেই। আফগানিসত্দানে মার্কিন আক্রমণের পর তা প্রকাশ্য রূপ নেয়, যখন উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি-পুঙ্গব ব্রিটেনে জন্ম নিয়ে, এই দেশের আলো-বাতাসে বড় হয়ে, এই রাষ্ট্রের দেওয়া সমসত্দ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে আফগানিসত্দানে গিয়ে এদেরই বিরম্নদ্ধে অস্ত্র ধরে এবং সেটা ধর্মের নামে, যে ধর্মের শিৰাও তাদের হয়েছে ব্রিটিশ সরকারেরই অর্থানুক্থল্যে। পশ্চিমা বিশ্বে একমাত্র ব্রিটেনই মাদ্রাসা শিৰাকে অনুমোদন দিয়েছে এবং মূলধারার শিৰার কিছু নিয়মকানুন মেনে নিয়ে এই ব্রিটেনেই উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক মাদ্রাসা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শুধুমাত্র নব্বইয়ের দশক ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটেনে উপমহাদেশ সহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলি থেকে ইমাম হিসেবে কাজ দিয়ে আনা হয়েছে প্রায় পনের হাজার মোলস্নাকে। প্রথম দিকে এদের সম্পর্কে তেমন খোঁজ খবর রাখা না হলেও পরের দিকে এদেরকে যথেষ্ট স্ক্রুটিনি করেই ব্রিটেনে আনা হয়। কিন্তু তাতেও ফলাফল যা হলো তা হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের সোস্যাল বেনিফিট গ্রহণ করেই এই দেশটাকে ব্রিটানিসত্দান বানানোর স্বপ্ন তারা দেখাতে শুরম্ন করে নতুন প্রজন্মের ব্রিটিশ-মুসলিমকে।
একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উচ্চারিত হয়, একজন মাদ্রাসা ছাত্রের জোব্বা-টুপি-দাড়ির পাশে আঙ্ব্রিজ থেকে কিংবা লন্ডনের অন্যান্য সরকারী স্কুলগুলো থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েদের মধ্যে চাকুরি কিংবা অন্যান্য প্রতিযোগিতায় কার স্থান প্রথম সারিতে আসবে? সু্যট কিংবা স্কাট-শার্ট পরিহিত একটি মেয়ে ও তার সঙ্গে আপাদমসত্দক বোরখায় মোড়া, হিজাব পরিহিতা একটি মেয়ে, দু'জনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰাপ্রাপ্ত, গেলো কোনও করপোরেট ব্যাংকের চাকুরির ইন্টারভিউতে_ এখন নিজেকে আপনি চাকুরিদাতা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেখুন, কাকে আপনি সম্ভাব্য প্রাথর্ী হিসেবে মনোনয়ন দেবেন? এরকম বহু মৌলিক প্রশ্ন উচ্চারণ করা যেতে পারে কিন্তু এই বস্নগে যারা দীর্ঘদিন ধরে আছেন তারা লৰ্য করবেন যে, এসব প্রশ্নের উত্তরে বিদেশে বড় হওয়া ও লেখাপড়া শেখা বস্নাগারদের অনেকেই ধর্মকেই সবার আগে স্থান দিয়ে এঁড়ে তর্ক শুরম্ন করে দেন। এই এঁড়ে তার্কিকদের মুখ থেকে এখন কিছু শোনার অপেৰায় রইলাম।
দুঃখ হচ্ছে এই ভেবে যে, কাহার আর জালালদের মতো ফ্যানাটিক (যাদের কেউ কেউ এখন ইউরোপের অন্যান্য দেশেও অবস্থান করছে) -দের কারণে শানত্দিপ্রিয়, আইন-মানা ও উদার বাঙালি চরিত্রে যে ভূষোকালি মাখানো হলো তার দায়িত্ব কি আমাদের বস্নগবন্ধুরা নেবেন?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০