মসজিদে আছি বলেই হয়তো আমাদের কারোরই খাওয়া-দাওয়ায় কোনও কষ্ট নেই। শুনেছি আজকাল যারা মাঠে-ৰেতে থাকে তাদের খুব অসুবিধে, ফসলে আজকাল যে হারে বিষ দেয়, বেশিরভাগই ঠ্যাং উল্টে চিতপটাং। আমার সনত্দানদের তাই আমি মাঠে যেতে নিষেধ করি, কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মেরও কাহিনী, মানুষই শোনে না, তা ওরাতো ইঁদুর!
আমার দিনটি শুরম্ন হয় খুব ভোরেই, যদিও ইঁদুর ধর্মানুযায়ী সারারাত ঘুমহীন আমার সকালে ঘুমুবার কথা। কিন্তু খুব ভোরে যে ব্যক্তি মসজিদে আসে সে দীর্ঘৰণ মসজিদের সামনে পায়চারী করে, এক হাত দিয়ে লুঙ্গিটা নীচ থেকে তুলে অনেকৰণ হাঁটে সে। সেই শব্দেই জেগে যাই। তারপর তো মেলা পদশব্দ। কখনও সুর করে, কখনও বিড়বিড় করে বিজাতীয় ভাষায় কবিতার মতো কি যেনো পড়া হয়। এই দেশে জন্ম, এই দেশের খেয়েপরে বেঁচে থাকা, মানুষের মুখের ভাষাটা তাই পরিচিত, কিন্তু মসজিদে কেন অন্য ভাষা চলে কে জানে? ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা যখন এই ভাষা মুখসত্দ করে তখন ওদের চোখে-মুখে না-বোঝার অসহায়তা দেখে কষ্ট লাগে। আমার সনত্দানদের কেউ যদি দুষ্টুমি করে তবে ওদের আমি বলি, তোমরা দুষ্টুমি করলে যাদু দিয়ে তোমাদের মানুষ বানিয়ে ফেলবো, তারপর ওই ওদের মতো তোমাদেরও. . . . . !
সকালের পরে অনেকৰণ মসজিদ নিশ্চুপ, তখনই যা একটু চোখবোজার সময় পাই আমরা। তারপর আবার শুরম্ন হয়, তবে গ্রামের মসজিদ তো, মানুষজন ৰেতে-খামারে কাজ করে, তারা খুব একটা আসে না মসজিদে। তারাও আমাদেরই মতোন, পেটের চিনত্দায় তাদের দিন যায়, রাত কাটে না, দুপুরে তাদের পিঠে নুন ফুটে বের হয়। ভাগ্যিস তাদের মতো আমাদের শরীর ঢাকার চিনত্দা করতে হয় না। আমরা খাই-দাই-হাগি, সবই এই মসজিদে।
প্রতিদিন সকালে আমরা অপেৰায় থাকি কে মসজিদে বাতাসা কিংবা মুড়ির মোয়া বা অন্য কিছু দিয়ে যাবে সে জন্য, শুধু আমরা না বুঝতে পারি, আরও কেউ কেউ মসজিদে কখন কি আসবে সেই অপেৰায় থাকে। আমাদের মতো সেও মসজিদের ওপরই ভরসা করে বেঁচে থাকে। তবে আমাদের সঙ্গে তার পার্থক্য হলো, সে সবার সামনে দাঁড়িয়ে ওই বিজাতীয় ভাষায় কি যেনো বলে। সপ্তাহের যেদিন অনেক লোক জমা হয়, সেদিন অনেক খাবারও আসে। সবাই যখন নিশ্চুপ থাকে, শুধু একজনের মুখের কথা শুনে সে যা বলে সবাই তা করে যায় তখন আমরা চুপিসারে জিনিসপত্র সরাতে থাকি, কখনও পায়েস, কখনও ফল, কখনও বা অন্যকিছু। তাও কি আর পারি? মানুষের চোখ, মাটিতে কপাল ঠেকালেও চোখ থাকে খাবারের দিকে। ওদিকে মাটিতে ঠেকাতে ঠেকাতে কপালে গোল কালো দাগ পড়ে গেছে!
গ্রামের মসজিদ বলেই সুনসান সারাদিন, আমরা মহানন্দে ঘোরাফেরা করি চারদিকে। শুধু রাত হলেই রাজ্যের ভয় এসে জড়ো হয় আমাদের মনে। কারণ তখন ইয়া বড় বড় সাপ বের হয় কোত্থেকে যেনো। মানুষেরা বলে শুনি, মসজিদে নাকি কোনও কিছুর ভয় নাই, কে বলে, এই মসজিদের ভিটাতেই থাকে গোখরা, দাঁড়াস, শংখচূড়, আরও কতো রকম সাপ! সবাই আমাদের খেতে আসে। কিন্তু সকালবেলা একটা মানুষের হাত সাপের মতো মেয়ে শিশুর বুকে ছোবল মারে, সকালে এখানে আসা অনেক মেয়েরই মুখ তখন ব্যাথায় নীল হয়ে যায়। সেই হাত-সাপ ওদের গিলে খায় না বলে ওরা প্রতিদিন মরে, প্রতিদিন বেঁচে থাকে। আহা আমরা ইঁদুররা একবার মরি!
মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন ওঠে, মানুষেরা মসজিদে আসে কেন? ওদের বলতে শুনি, এখানে এলে, মাটিতে মাথা ঠেকালে, বিড়বিড় করে বিজাতীয় ভাষা আওড়ালে নাকি মৃতু্যর পরে অপার শানত্দি আসবে। ওদের এই সমবেত পাগলামি দেখে আমরা ইঁদুরেরা হাসি, হেসে লুটোপুটি খাই, ওদের এই এ্যাত্ত বড় মাথা, কিন্তু আমাদের এক রত্তি মাথার চেয়েও ওদের বুদ্ধি কম মনে হয়। মৃতু্যর পর আমরা ঠ্যাং উল্টে পড়ে থাকি আর ওদেরকে মাটির নীচে রেখে যাওয়া হয়, আমাদের মতো আরও অনেকের ভোজের জন্য। ওদের হাড়গোড় আমরা মাটিতেই মিলিয়ে যেতে দেখি, আমাদের চোখের সামনে।
এই মসজিদের পাশেই একটি কবরস্থান, প্রতিটি কবরের খোঁজ আমার জানা, কার হাড্ডির কতোটুকু অবশিষ্ট আছে, কার নেই, নতুন ক'টি কবর হলো, সব। মৃতু্যর পর যদি ইঁদুরেরই খাবার হবি তো সেজ্দা গুতিয়ে মাথায় কালোদাগ ফেলার কী কারণ!
ওরা খুব ভয় পায়, মৃতু্যর পরে কী হবে? কিছুই হবে না ইঁদুর কিংবা সাপখোপের খাবার হবি, তারপর মাটিতে মিশে যাবি, আর কি? এই মসজিদে প্রতিদিন ওদের ভয় দেখানো হয়, যে ভয় দেখায় সে ভয় দেখিয়ে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়, আমরা বুঝি, সে খাটতে চায় না, সে লাঙলের গুটি ধরতে জানে না, সে জানে শুধু কথা বলতে, কথা বলে সে বেঁচে থাকে। এদিক দিয়ে কিন্তু আমরা ওই মানুষটার চেয়ে ভালো, আমরা সারাদিন দেঁৗড়ে ফিরি খাবারের জন্য, কষ্ট করে খাবার আনি, আমরা কারো ৰতি করি না, স্বভাবমতো আমাদের কাজ করি, অনুশোচনাহীন। অনুশোচনা থাকলেই পাপ-চিনত্দা আসে, পাপ-চিনত্দাই ভয় ঢুকিয়ে দেয় মনে, আর সেই ভয়ে যে মানুষেরা কতো কিছু করে! আমরা ভাবি, ভাবি আর হাসি, ভাবি আর হাসি, হাসতে হাসতে আমরা লেদিয়ে ভরে ফেলি এই মসজিদ।
খুব ইচ্ছে করে, একদিন মুখে মুখে পেস্নগ-বীজ নিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে আসি, ওদের বোকামির যোগ্য পুরষ্কার সেটাই _ কে জানে হয়তো ওরা ভয় পেয়ে তখন আমার মতো ছোট্ট ইঁদুরকেও খোদা ভেবে.. হাহ. . . হা. . . হা. . . হা
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০