কপিপেস্টো:
Click This Link
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
‘শীতের শেষ রাত্রি বসন্তের প্রথম দিন’ আলাউদ্দিন আল আজাদের একটি উপন্যাসের নাম। নামকরণের জন্যই বইটির প্রতি আকৃষ্ট হই। এতে শেষ এবং শুরুর সন্ধিক্ষণে বিষয় মনে ভেতর নাড়া দেয়। যেমন এখন চৈত্র ফুরিয়ে যাচ্ছে, আর এগিয়ে আসছে বৈশাখ। সর্বত্রই প্রস্তুতি চলছে নববর্ষের।
কানাডায় এখন শীত শেষ, শুরু হচ্ছে সামার। বরফে ঢেকে থাকা গা ঝরা দিয়ে জেগে উঠছে পার্ক-প্রান্তর প্রকৃতি। যেন দ্রুত সাদা ড্রেস বদলিয়ে পরে নিচ্ছে সবুজ ইউনিফর্ম। এতোদিনের নীরব থাকা মনমরা ধুসর গাছগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে, নতুন পাতার আনন্দে মেতে উঠছে বাতাসের সঙ্গে।
এমনি এক বসন্ত ছোয়া বিকেলে হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে ষ্টার বাকস্ এর কফি শেষ করে আমি আর কবি সিদ্ধার্থ হক মিসিসাগার পোর্ট এডিট লেকের পাড়ে গেলাম। অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে দেখতে পেলাম নাম না জানা একটি মিষ্টি পাখি। আকারে দোয়েলের মতো। কিন্তু কুচকুচে কালো। ডানার দু’পাশে গাঢ় কমলা আর উজ্জ্বল হলুদের গুচ্ছ পালক। ফুটে আছে ফুলের মতো যেন কোনো শিল্পী নিজ হাতে রং তুলি দিয়ে কাঁচা রঙ মেখে দিয়েছে, হয়ে উঠেছে চোখ ধাঁধানো অপূর্ব পেইন্টিং। সিদ্ধার্থ হক কৌতুলী কিশোরের মতো অথবা আমি পাখি বিশেষজ্ঞ সলিম আলি হয়ে উঠার আগেই ফ্রুৎ করে উড়াল দিয়ে হারিয়ে গেলো। এই পাখিটা যেনো প্রবাস জীবনে দুই বাঙালি কবির কাছে বসন্তের বার্তা পৌঁচ্ছে দিয়ে গেলো।
আমরাও যেনো ফিরে গেলাম গ্রাম বাংলায়। মনে পড়লো আমাদের কৈশোরের কথা। বাংলার প্রকৃতি কীভাবে জানিয়ে দিতো ঋতু আগমনের কথা। চৈত্র হলেই খাঁখা দুপুরে ফুটে থাকতো আগুন রঙের পলাশ-শিমুল। আর চাতক পাখির চিৎকার আর ঘুঘু পাখির ডাক। শুকিয়ে যাওয়া নদীতে ভেসে থাকা ডিঙ্গি। তারপর বৈশাখে আম্র মুকুলের ঘ্রাণ, কোকিলের কুহু কুঞ্জন, কচি পাতার নাচন, কাল বৈশাখীর ঝড় বৃষ্টির খেলা! আমরা দু’বন্ধুই নিজেদের অজান্তেই নষ্টালজিয়ায় হারিয়ে গেলাম।
মনে পড়লো চৈত্র সংক্রান্তীর কথা। হারিয়ে যাওয়া দিনটিকে নতুন সাজে সাজিয়ে নগর জীবনে যুক্তকরে রাজধানীতে উপস্থাপন করছিলেন এক আবৃত্তি দম্পতি। চৈত্রের শেষ দিন আর বৈশাখের প্রথম দিনের সন্ধিক্ষণে ইন্দিরা বোড়ে আরিফÑ প্রজ্ঞার বাড়িতে সন্ধ্যা-সকাল বসতো চৈত্র সংক্রান্তীর জমজমাট আড্ডাসর। যা মুখরিত হয়ে উঠতো প্রায় সকল সাংস্কৃতিক কর্মীদের আনন্দঘন পদচারণায়।
আজ কাজী আরিফ চুপচাপ! প্রজ্ঞা লাবনী নিরব!! চৈত্র সংক্রান্তীর উৎসবও শেষ!!!
হ্যাঁ, মনে পড়লো, রমনার বটমুলে ফেলে আসা আমাদের প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ। যা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সর্বজনীন উৎসব! যা ছায়ানট শিল্পীগোষ্ঠী সেই ষাট দশক থেকে অদ্যাবদি নানান প্রতিকূলতার মধ্যে জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাঙালি জাতিকে দিয়েছে এক অফুরন্ত সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ষাট দশকে প্রতিপক্ষরা নতুনভাবে আবির্ভূত হয়ে ভিন্নভাবে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ মেরে নসাৎ করতে চেয়েছে উৎসবকে। কিন্তু পারে নি। পারবেও না কোনোদিন! বরং বৃদ্ধি পাবে, মাত্রা পাবে, যুক্ত হবে নতুন কিছু। যেমন যুক্ত হয়েছে চারুকলার বর্ণাঢ়্য শোভা যাত্রা কিংবা পান্তা ইলিশের সংযোজন!
কিন্তু এখন আর সেই সব নেই! পাল্টে গেছে প্রকৃতি, পরিবেশ, সময় ও সংস্কৃতি। ‘আমাদের গ্রাম’ নামে একটি কবিতা লিখছি, তার শেষ পঙক্তি দুটি থেকে আমার এই বক্তব্যের অর্থ পাঠক খুঁজে পাবেন। ‘আমাদের গ্রামে বসন্ত শেষে বৈশাখ আসে না/ আমরা বৈশাখীকে বিবাহ দিয়েছিÑ রমনা পার্কের কাছে।’
রমনা বটমূলের সাথে পান্তা-ইলিশের সমন্বয় হয় ১৯৮৩ সাল থেকে। এর সুচনার ইতিহাস প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ গত বছর সেপ্টেম্বর-এ মারা গেলে মনে পড়লো সেই ঘটনা। তখন ‘রমনা বটমূলের পান্তা ইলিশের উদ্যোক্তা বোরহান ভাইকে কেউ কী মনে রাখবে?’ শীর্ষক একটি লেখা লিখলাম ৩০ সেপ্টেম্বর ’০৯-এ দৈনিক আমাদের সময়ে। দু’দিন পর অর্থাৎ অক্টোবর ০৯-এ সেই লেখার চমৎকার প্রতিবাদ করলেন সাংবাদিক শহিদুল হক খান। লিখলেনÑ ‘রমনা বটমূলের পান্তা ইলিশের ইতিহাস প্রকাশে দুলালের বিভ্রান্তি।’ মানে তিনিই আসল উদ্যোক্তা হিসেবে দাবি করলেন। আমি আবার ’০৯ অক্টোবরে লিখলামÑ ‘আমি পান্তা ইলিশের ইতিহাস রচয়িতা নই, বোরহান ভাইয়ের শ্রদ্ধান্তে সঠিক তথ্যদাতা।’ অন্যভাবে বললে বলতে হয় মি. খান ‘অন বিহাব অফ বোরহান ভাই।’ ৫ সেগুন বাগিচা বর্তমান মুক্তিযুদ্ধা জাদুঘর ছিলো দৈনিক দেশ এবং সাপ্তাহিক বিপ্লবের কার্যালয়। বিপ্লবের কবি সিকদার আমিনুল হক, সহকারী সম্পাদক ফারুক মাহমুদ, দেশের সাহিত্য সম্পাদক হেলাল হাফিজ, সাংবাদিক মাহবুব হাসান, শহিদুল হক খান, মুন্সী আবদুল মান্নান, রোজী ফেরদৌস প্রমুখ সম্পৃক্ত ছিলেন এ পত্রিকা দু’টির সাথে। সে কারণেই সেখানে বসতো লেখক আড্ডা। আমি ছিলাম একজন নিয়মিত আড্ডারু।
১৯৮৩ সাল। চৈত্রের শেষ। চারিদিকে বৈশাখের আয়োজন চলছে। আমরা আড্ডা দিতে পান্ত-ইলিশের কথা তুলি। বোরহান ভাই রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশ চালুর প্রস্তাব দিলেন, আমি সমর্থন দিলোম। ফারুক মাহমুদ পুরো আয়োজনের ব্যবস্থা করলেন। সম্ভবত ৫ টাকা করে চাঁদা ধরলেন। বাজার করা আর রান্না বান্নার দায়িত্ব দিলেন বিপ্লব পত্রিকার পিয়নকে। রাতে ভাত রেধে পান্তা তৈরি করে, কাঁচামরিচ-শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, ইলিশ ভাঁজা নিয়ে পর দিন ‘এসো হে বৈশাখে’র আগেই ভোরে আমরা হাজির হলাম বটমূলের রমনা রেষ্টুরেন্টের সামনে। মুহুর্তের মধ্যে শেষ হলো পান্তা-ইলিশ। এভাবে যাত্রা শুরু হলো পান্তা ইলিশের।
অপর দিকে (সম্ভবতঃ একই বছর বা পরের বছর) শহিদুল হক খানও এই প্রক্রিয়ার সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ‘তিনি দাবি করেছেন, নিজ হাতে পান্তার পোষ্টার লিখেছেন, তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ ভাত রেধেছেন, ইলিশ মাছ ভেঁজেছেন, কাঁচামরিচ পেঁয়াজ কেটেছেন, মাটির সানকি সংগ্রহ করেছেন (আমাদের সময়, ০৯ অক্টোবর ২০০৯)। এবং তার এ নিয়ে বিটিভিতে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন! তবে রমনা বটমূলের পান্তা ইলিশের উদ্যোক্তার কৃতিত্ব এককভাবে কেউ নন। যাদের নাম উল্লেখ্য করলাম, তারা সকলেই নানভাবে কমবেশি যুক্ত ছিলেন।
নববর্ষ উপলক্ষ্যে তাঁদের সবাইকে বৈশাখী শুভেচ্ছা। প্রতিটি বাঙালিকে পান্তা-ইলিশের আমন্ত্রণ!
--------------------------------
আমার কিছু কথা:
এই লেখকের কথা সত্যি হলে, পান্তা-ইলিশের সংস্কৃতি খুব বেশি দিন আগের না। কিছু মানুষের পিকনিক হতে সৃষ্টি হওয়া এই সংস্কৃতি আজ ডিজুস পুলাপাইনগো হাতে। জয়হো পান্তা-ইলিশ।
-------------------------------
একখান কোবতে পড়েন, গত কাইলকা লেখা:
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১১ রাত ১১:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




