“মৃত্যুপ্রান্তরে জীবনের নিস্ফল দাপাদাপি এবং জীবিতদের বেঁচে থাকার উদগ্র বাসনা!” নামে আমার একটি পোস্টে দেশের চলমান রাজনীতি, এলিট ফোর্স র্যাবকে দিয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের বেছে বেছে হত্যা করা, তথাকথিত বাম নামধারী দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা তুলে ধরা হয়েছিল। ওই পোস্টে অনেকেই মনতব্য আকারে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরেছিলেন। তার ভেতর থেকে দুটি মন্তব্য নিয়ে বিশদে আলোচনা করাই এই পোস্টের উদ্দেশ্য।
শাহেরীন আরাফাত প্রশ্ন তুলেছিলেন; “ দ্বান্দিকতার প্রকৃত অর্থ আমাদের দেশের নামধারী কমিউনিস্ট/সোস্যালিস্ট নেতাদের ক'জন বোঝে, তা নিয়ে আমি সন্দিহান... আর এদের আসল লক্ষ্য সম্পর্কে এরা নিজেরাও কনফিউজড... দলগুলোতে কেন্দ্রীকতা বলতে বোঝায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকতা, কারণ নিজেরা দিকভ্রান্ত হওয়ায় তারা ভাল করেই জানেন যে, যদি আজ ক্ষমতা কুক্ষিগত না হয়, তবে কাল এই কেন্দ্রেও তিনি থাকবেন না... হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা এসব দল নিয়ে কেন কথা বলব? বলব এই কারণে যে, দলগুলো আমাদের মোটা দাগে কিছু ভাঙ্গা টেপ চালিয়ে বছরের পর বছর মশকরা করে যাচ্ছে; অথচ কানসাট, আড়িয়াল বিল, ফুলবাড়ী, রূপগঞ্জের মতো কোথাও একটা বিদ্রোহেও নেতৃত্ব দিতে পারেনি। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আমি সন্দিহান!”
এখানে দেখা যাচ্ছে শাহেরীন বর্তমানে সক্রিয় বাম দলগুলোর দিকভ্রান্ত হওয়া, নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া এবং নেতাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখাকে সম সাময়ীক সময়ে দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সম্পৃক্ত হতে না পারার ব্যর্থতা বলে মনে করছেন।
শাহেরীন এর তুলে ধরা এই দিকটি নিয়ে চমৎকার পয়েন্ট তুলে ধরেছেন সুজয় সাম্য। তিনি বলেছেন; “ বামপন্থিদের নিয়ে খুব কমন এবং পুরোন একটা অভিযোগ হচ্ছে এরা মানুষের কাছে পৌছাতে পারে না। এর কারণ হিসেবে আপনি দেখাচ্ছেন আসলেই বামপন্থা নিয়ে বাম দলগুলোর নেতাগুলর স্বচ্ছ ধারণা আছে কী না? কিন্তু আপনি পুঁজিবাদী সংস্কৃতির শক্তিটাকে একবারও বুঝতে চাইলেন না। এই সমাজে তো মানুষ জন্মের পর পরই পুঁজিবাদী সংস্কৃতি আয়ত্ব করে ফেলে। সবাইকে শিক্ষা দেয়া হয় ক্যারিয়ার গড়তে,নিজ নিজ ভালো বুঝতে। সেখানে তো শিক্ষাই দেয়া হয় সমাজ সম্পর্কে আগ্রহী না হয়ে ,ব্যাক্তিগত উন্নতির দিকে ধাবিত হতে। এই মানুষগুলোকে ফুলবাড়ী ,কানসাট বোঝানো কী এতো সহজ,সর্বহারার সংস্কৃতি বোঝানো এতো সহজ? মিডিয়া পুঁজিবাদী,শিক্ষা পুঁজিবাদী আর দোষ ঐ বামপন্থিদেরই?”
সুজয় সাম্যর বক্তব্যে উঠে এসেছে বামপন্থা নয়, পুঁজিবাদী মিডিয়া, পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ঘটনা পরম্পরা ধরতে না পারায় বামপন্থীদের উপর দোষ চাপানো হয়। আসলে তাদের ওপর দোষ চাপানোর আগে স্যোসিও ইকোনমিক স্ট্রাকচার বা আর্থ সামাজিক কাঠামো বিবেচনায় আনতে হবে।
ওই পোস্টের আলোচনায় বলেছিলাম নেতৃত্বের কেন্দ্রীকতাকে মার্কসবাদী বিশ্লেষণে বিশেষত বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতায় বিচার করতে হবে। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি দিয়ে বিচার করতে ব্যর্থ হওয়ায় এদেশের মার্কসবাদী দলগুলোকে ঠিক এই ধরণের প্রশ্নের সন্মুখিন হতে হচ্ছে, যে প্রশ্ন উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিচার করার আগে দেখে নিতে হবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কি? এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদই বা কি?
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির দৃষ্টিভঙ্গী হলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। এই বস্তুবাদকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বলা হচ্ছে, কারণ বস্তুজগতের ঘটনাপ্রবাহের প্রতি এর দৃষ্টিভঙ্গী ও সেগুলোকে বিশ্লেষন ও ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি হলো দ্বান্দ্বিক, আর ঘটনাপ্রবাহের ব্যাখ্যা হলো সে সম্পর্কে এর ধারণা ও তত্ত্ব হলো বস্তুবাদী। এবং সমাজজীবনের অনুশীলনে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নীতিগুলোর প্রয়োগকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ; সমাজজীবনের ধারা, সমাজ ও তার ইতিহাসের অনুশীলনে দ্বান্দ্বিক নীতিগুলোর প্রয়োগ হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কসের মতে ‘মানস’ মানুষের মন কর্তৃক প্রতিফলিত এবং বিভিন্ন মনন প্রকরণে রূপান্তরিত বস্তুজগত ছাড়া আর কিছুই নয় (কার্ল মার্কস, ক্যাপিটাল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০, জর্জ অ্যালেন ও অ্যন উইন লিমিটেড, ১৯৩৮)। মার্কসীয় বস্তুবাদকে আমরা ডায়ালেকটিক্স ম্যাটারিলিজিয়ম কেন বলি? ডায়ালেকটিস বা দ্বন্দ্বতত্ত্ব কথাটি এসেছে গ্রীক শব্দ ডায়ালেগো থেকে। এর অর্থ হলো আলোচনা করা, তর্ক করা। চিন্তার স্ববিরোধগুলি প্রকাশ করা এবং পরস্পর বিরোধী মতের সংঘাত হলো সত্যে পোঁছানোর শ্রেষ্ঠতম পদ্ধতি।
মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে, বস্তুজগত পরস্পর সংযুক্ত এবং সমগ্রভাবে সুসংহত, যার মধ্যে বস্তুসমষ্টি ও ঘটনাপুঞ্জ পরস্পরের সঙ্গে প্রকৃতিগতভাবে সংযুক্ত, তারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং পরস্পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কাজেই কোন ঘটনাকে পারিপার্শ্বিক ঘটনাপুঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে সেটি আর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে দেখা হবে না। কিভাবে এই ঘটনা প্রবাহ দেখতে হবে সে প্রসঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলস আরো বিশদে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা এই পরিসরে স্থান সংকুলান হবে না। তাই সংক্ষিপ্তসার আলোচনা করছিঃ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বলে যে, নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে বিকাশের প্রক্রিয়া ঘটনার সুসামঞ্জস্য প্রকাশ হিসেবে ঘটে না, তা ঘটে বস্তু ও ঘটনার অন্তর্নিহিত বিরোধের অভিপ্রকাশ হিসেবে, এই সব বিরোধের ভিত্তিতে বিরুদ্ধ ধারাগুলির একটি ‘সংঘাত’ হিসেবে। এ বিষয়ে লেনিন বলেছেনঃ ‘প্রকৃত প্রস্তাবে দ্বন্দ্বতত্ত্ব হলো বস্তুর একেবারে মর্মে অবস্থিত অন্তর্নিহিত বিরোধের অধ্যয়ন।’ (লেনিন, ফিলোসফিক্যাল নোট বুক, রুশ সংস্করণ, পাতা ২৬৩) লেনিন আরো বলেছেন-‘বিপরীতের সংঘাতই হলো বিকাশ’।
অতএব কর্মপন্থায় ভুল এড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই সর্বহারা শ্রেণী-কর্মপন্থা অনুসরণ করতে হবে। সর্বহারা এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থের সামঞ্জস্য আছে এই রকম সংস্কারবাদী কর্মপন্থা অনুসরণ করা চলবে না যে ‘পুঁজিবাদ আপনা-আপনি সমাজবাদে রূপান্তর হয়ে যাবে’! এটা আপোষপন্থীদের পথ। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আরো বিস্তারিত আলোচনায় গেলে আমাদের মূল বিষয় থেকে সরে যাব, তাই এখানেই থামতে হচ্ছে।
এবার শাহেরীনের প্রশ্নে আসা যাক। আমাদের নেতারা যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করেন এবং সেই চেষ্টার আলটিমেট রেজাল্ট আরো একটি নতুন দল গজিয়ে ওঠা কিংবা নতুন একটা ফ্র্যাকশন তৈরি হওয়া, তা কিন্তু এই ‘বিপরীতের সংঘাত’ না বোঝার ফলে সৃষ্ট। দলে হোক বা রাষ্ট্রে হোক প্রতিটি ঘটনা যে বস্তুজগতে পরস্পর সংযুক্ত এবং সমগ্রভাবে সুসংহত, যার মধ্যে বস্তুসমষ্টি ও ঘটনাপুঞ্জ পরস্পরের সঙ্গে প্রকৃতিগতভাবে সংযুক্ত, তারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং পরস্পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এবং কোন ঘটনাই যে পারিপার্শ্বিক ঘটনাপুঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় সেটি তারা বুঝতে সক্ষম হন না। এবং সে কারণে দলের ভেতর ভিন্নমত আসলে মনে করে বসেন ‘উপদলীয় কোন্দল’। তেমনি সমাজজীবনে এটা বুঝতে না পেরে ভাবেন পরিস্থিতি বিকোশিত হয়নি, কিংবা রাষ্ট্রের বিরোধীতা করার মত সময় আসেনি, বা রাষ্ট্রের বিপক্ষে যাওয়ার মত ক্ষমতা তারা অর্জন করেননি! তাই দলের ভিন্নমতের মীমাংশার ক্ষেত্রে দুই লাইনের সংগ্রাম বা দুটি ভিন্নমতের সংগ্রাম হিসেবে দেখতে পারেন না।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল কেন্দ্রীকতা। এই কেন্দ্রীকতা অর্থ কিন্তু এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করা নয়। বিরাজমান দ্বন্দ্বের দুটি দিকের প্রধান দিককে কেন্দ্র করা। যদি দলের ভেতর দ্বন্দ্ব থাকে যে, ‘দেশে এখন বিপ্লব অবস্থা বিরাজ করছে’ এবং ‘দেশে এখন বিপ্লব অবস্থা বিরাজ করছে না’। তাহলে এই দ্বন্দ্বের কোনটিকে কেন্দ্র করতে হবে? আমরা মার্কসের সূত্র মতে পাই ‘পুঁজিবাদ আপনা-আপনি সমাজবাদে রূপান্তর হয়ে যাবে! এটা আপোষপন্থীদের পথ’। এই সূত্রই বলে দিচ্ছে দ্বন্দ্বের কোনটি প্রধান দিক। কিন্তু আমাদের দেশের পার্টিগুলোর (যারা নিজেদের মার্কবাদী-লেনিনবাদী পার্টি বলে দাবী করেন) নেতৃত্বের সমস্যা হচ্ছে একটি মার্কবাদী পার্টি যে আদর্শে, যে লক্ষ্যে, যে পদ্ধতিতে গড়ে তোলার কথা তা করতে তারা ব্যর্থ হন। এবং সে কারণেই বিরাজমান দ্বন্দ্বগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চান। যে পক্ষ এটি চায় না, তারা নিজেদের মতামতের মূল্য দেয়া হলো না, তাদের মতামত জয়ী হলো না ভেবে অবশেষে বেরিয়ে আরো একটি নতুন পার্টি গড়েন। এই ধারা চলে আসছে বছরের পর বছর। কখনো কখনো এই সব ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা দলগুলো নিজেদের ভেতরকার সমস্যা জিইয়ে রেখে একটা নামকা ওয়াস্তে ঐক্যের সুর তুলে ঐক্যবদ্ধ হনও। আবার কিছুদিন পর সেই আগের মতই ভাঙ্গন এসে পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে।
কেন্দ্রীকতার আর একটি দিক হচ্ছে, কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কেবলই কমিউনিস্ট পার্টিই করবে এমন নয়। এই বিপ্লবে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সাথে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরাও থাকতে পারে। থাকতে পারে বুর্জোয়া ধারার কিছু দল যারা নিজেদের সাম্রাজ্যবাদের নিগড় থেকে মুক্ত মনে করে। ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় এমন শত শত পার্টি ছিল। কিন্তু বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিল বলশেভিক আর মেনশেভিকরা। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসের ১৭ তারিখে বলশেভিকরা পুরোপুরি ক্ষমতা দখল করে। চীনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। মাও সেতুং এর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগী হিসেবে প্রায় আশিটির মত দল ছিল। তাদের অন্যতম ছিল সানইয়াৎ সেন এর গণতান্তিক দল। জাপ বিরোধী যুদ্ধের সময় এই জাতীয়তাবাদী দলটি কাধে কাধ মিলিয়ে জাপানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল কমিউনিস্ট পার্টি তথা মাও এর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। এই কেন্দ্রীকতা জাতীয় বুর্জোয়া বা জাতীয়তাবাদী দলগুলো মানতে বাধ্য ছিল, কারণ তারা কমিউনিস্ট পার্টিকে যোগ্যতম দল হিসেবেই দেখেছিল। তখন সমগ্র চীনকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ছিল।
আমাদের দেশের বামপন্থী দলগুলো বা মার্কসবাদী দলগুলো, কিংবা কমিউনিস্ট নামধারী দলগুলো আদৌ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে চান কি-না, তা করতে তারা কতটুকু প্রস্তুত, তারা কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে দল পরিচালনা করছে, তাদের মতে বাংলাদেশের সমাজজীবনের ঐতিহাসিক বা বস্তবাদী দ্বন্দ্বগুলোকে তারা কিভাবে দেখছেন এবং কিভাবে সেই দ্বন্দ্বের বিকাশ ঘটাবেন বা ঘটনাবলির ব্যাখ্যা তারা কিভাবে দাঁড় করিয়ে তার মীমাংসা করবেন সেই সব প্রসঙ্গ অনেক বেশি বিস্তৃত আলোচনার দাবী রাখে । তার পরও এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলো আনার চেষ্টা করছিঃ
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে নানা মুনির নানা মত আছে। প্রত্যেকটি দলের ‘সয়ংসম্পূর্ণ’ থিসিস আছে। রণকৌশল-রণনীতি আছে। আছে দল পরিচালনার গঠনতন্ত্র বা ম্যানিফেস্টো। তারা সেই মত দল পরিচালনা করে চারটি ধারার কাজ করতে পেরেছেন। অন্তত তাদের সাম্যক পরিস্থিতি বিবেচনায় তা-ই দেখা যায়। এ নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে।
১. বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থান পুঁজিবাদী, শাসক শ্রেণী পুঁজিবাদের প্রতিভূ, সমাজের অগ্রসরমান শ্রেণী মধ্যবিত্ত, শিল্পীয় শ্রমিকরা বিপ্লবের অগ্রগামী অংশ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী সেই বিপ্লবের সহায়ক। ছাত্র-কৃষক-বুদ্ধিজীবীরা বিপ্লবের অনুগামী। বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। বিপ্লবের পদ্ধতি গণঅভ্যুত্থান। এই দলগুলির অবস্থান এত বেশি দুর্বল যে এরা সমাজ রাজনীতিতে কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না।
২. বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থান পুঁজিবাদী, শাসক শ্রেণী পুঁজিবাদের প্রতিভূ, সমাজের অগ্রসরমান শ্রেণী মধ্যবিত্ত, শিল্পীয় শ্রমিকরা এবং কৃষকরা বিপ্লবের অগ্রগামী অংশ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী সেই বিপ্লবের সহায়ক। ছাত্র-কৃষক-বুদ্ধিজীবীরা বিপ্লবের অনুগামী। বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। বিপ্লবের পদ্ধতি গণঅভ্যুত্থান। তবে বর্তমান অবস্থায় জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে ইস্যুভিত্তিক ঐক্য করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পদ্ধতি অধিকতর কার্যকর। এই মতের দলগুলি নিজেদের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার লিখিত নীতি আদর্শ আঁকড়ে ধরার বদলে বুর্জোয়া দলগুলোকে ‘জাতীয় বুর্জোয়া’ ভেবে নিয়ে দুই প্রধান বুর্জোয়া দলের সাথে গাঁটছড়া বেধে ক্ষমতার শেয়ার পাওয়ায় ব্যস্ত। এদের এক গ্রুপ আওয়ামী লীগের সাথে, অন্য গ্রুপ বিএনপির সাথে নির্বাচনি আতাত করে ক্ষমতার শেয়ার পেয়ে কার্যত বিপ্লবকে ড্রইংরুমে তালাবন্ধ করে দিয়েছে।
৩. বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থান ঔপনিবেশিক। শাসকশ্রেণী ঔপনিবেশিক দালাল। সাম্রাজ্যবাদ এবং তার অঞ্চলিক এজেন্টই প্রধান শত্রু। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে পরাভূত করেই বিপ্লব সম্পন্ন হবে। বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে এরা অগ্রসর হলেও কার্যক্ষেত্রে সমাজের মধ্যবিত্ত বিলাসী অংশ ছাড়া ব্যাপক সাধারণ মানুষের ভেতর এদের কোনোও ভূমিকা নেই। থিসিস, অ্যন্টি থিসিস, দই লাইনের সংগ্রাম, বিশ্ব রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ, গ্লোবালাইজেশন বিরোধী ভূমিকা, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, নিও মর্ডানাইজেশন, মার্কসবাদের তাত্ত্বিক অনুশীলন ইত্যাদি নিয়ে এই ধরণের দলগুলি তাদের কর্মকাণ্ডকে শহরকেন্দ্রীক করে রেখেছে। কারো কারো গ্রামাঞ্চলে কিছু কাজের ক্ষেত্র থাকলেও তা নগণ্য।
৪. বাংলাদেশের আর্থসামজিক অবস্থান আধা সামন্তবাদী-আধা উপনিশেবাদী। পুঁজিবাদের বিকাশ হয়নি। পুঁজিবাদ এখানে প্রধান ডোমিনেটিং ফ্যাক্টর নয়। শাসকশ্রেণী সামন্তবাদী ভাবধারায় দেশ পরিচালনা করে। শিল্পীয় শ্রমিকরা সমাজতান্তিক বিপ্লবের প্রধান শুক্ত হলেও এখানে শিল্পীয় শ্রমিকের বদলে কৃষকরা প্রধান শক্তি। বিপ্লবের স্তর নয়া গণতান্ত্রিক। বিপ্লবের পদ্ধতি বলপূর্বক ক্ষমতা দখল। শ্রেণী সংগঠনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে গণসংগঠনকে পুরোপুরি অস্বীকার করায় শহরাঞ্চলে এদের কোনো ভূমিকা নেই। গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপে ভাগ হয়ে এরা কাজ করে। লেনিনের ‘বিপরীতের সংঘাতই হলো বিকাশ’ তত্ত্বকে এরা যান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করে একের পর এক দল ভেঙ্গে নতুন নতুন দল গড়ে। এদের সংগঠন পরিচালনার পদ্ধতি গোপনীয় ভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দল পরিচালনা। গত ৭ বছরে র্যাব এর হাতে একের পর এক এদের নেতা নিহত হওয়ার পর এই ধরণের দলগুলোর অস্তিত্ব প্রায় বিলিন।
এই সব দলের বা গ্রুপের শত শত রাজনৈতিক থিসিস, কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি, বর্তমান অবস্থান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষপট বিশ্লেষণ, সাম্রাজ্যবাদী রণকৌশল, নয়া বাজার অর্থনীতির বিশ্লেষণ, করপোরেট আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট অনুধাবন, সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, তাদের আঞ্চলিক এজেন্ট, সেই এজেন্টের স্বার্থসংশ্লিষ্ঠতা, গ্লোবাল পলিটিক্স, গ্লোবাল ইকোনমিকস, পুঁজির বিকাশ, পুঁজির লগ্নি, লগ্নিপুঁজির পুনঃলগ্নিকরণ, জাতীয় বুর্জোয়াদের বিকাশ, জাতীয় বুর্জোয়া চরিত্র বিশ্লেষণ, শাসকশ্রেণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট, সাম্রাজ্যবাদের কাছে তাদের অসহায় আত্মসমর্পণ, শাসকদের ক্ষমতার পালা বদলের পদ্ধতি, তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার কৌশল, অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা, শিল্পের ভূমিকা, শ্রমিক শ্রেণীর সংঙ্ঘবদ্ধতা, শিল্পীয় শ্রমিক শ্রেণীর চারিত্রিক বৈশিষ্টহীনতা, উৎপাদন পদ্ধতি, উৎপাদন সম্পর্কের শ্রেণী বিভাজন, উৎপাদন সম্পর্কের সাথে সামাজিক অপরাপর শ্রেণীসমূহের বৈপরিত্য, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দোদুল্যমানতা, তরুণ সমাজের রাজনীতি বিমূখতা, পেটি বুর্জোয়া কর্তৃক সামাজিক ক্ষেত্রগুলোর দখল, মিডিয়ার দালালী, বিকৃত পুঁজি কর্তৃক মিডিয়া এবং সমাজের অগ্রসর অংশকে দখল করা, রাষ্ট্রের ভৌগলিক অবস্থান, রাষ্ট্রের প্রতিবেশীদের শক্তিমত্তা, তাদের সরকার পদ্ধতি, শ্রেণী হিসেবে শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুরদের রাজনৈতিক বিকাশসহ শত শত দিক বিবেচনা করে একথা বলা যায় যে বাংলাদেশের বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক নয়, নয়া গণতান্ত্রিক বা জাতীয় গণতান্ত্রিক। এই স্তরের বিপ্লবে বুর্জোয়া দলগুলোও সম্পৃক্ত হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার মত শিল্পীয় শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ত্বে বিপ্লবের সুযোগ নেই। কেননা সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণী হিসেবে বাংলাদেশের শ্রমিকরা গড়ে ওঠেনি। এরা শিল্প কারখানায় কাজ করে ঠিকই, কিন্তু সারা বছর কাজ করে টাকা জমিয়ে একখণ্ড জমির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এবং কোন এক সময় তারা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেও। এবং সাথে সাথে সেই শ্রমিক একজন ক্ষুদে মালিক হয়ে যায়। সুতরাং তার চরিত্রে সর্বহারা শ্রমিকের বৈশিষ্ট নাই।
এমন ক্রিটিক্যাল বৈশিষ্ট আর জটিল সমীকরণে বছরের পর বছর কালক্ষেপণ করে বাম দলগুলোর অধিকাংশ নেতা-কর্মী হতাশ এবং ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে এখান থেকে ‘মুক্তির’ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন বৃহৎ বুর্জোয়া দলের ছত্রছায়ায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দালালী কৌশল। এবং চারিত্রক বৈশিষ্ট অনুযায়ী আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত এই তিনটি ফ্যাকশনের প্রত্যেকটিতে এরা নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। এই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ক্ষমতাকেন্দ্রের ভেতরে থাকার আরাম বিসর্জন দিয়ে এরা কষ্মিনকালেও বিপ্লবের কথা চিন্তা করবেন না। করতে পারেন না।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৩৬