২৮ জুলাই কমরেড চারু মজুমদারের শহীদ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ
“ভারতবর্ষের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রথম এতো তীব্র ও তীক্ষ্ণভাবে বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্ন করা হয়েছিলো; তুমি কার পক্ষে?”
নকশালবাড়ি সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্বশেষ বিভাজন-রেখা। এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত জীবনযাপনও নকশালবাড়ির কৃষক-অভ্যুত্থানের আগে যেমনটি ছিল পরে আর তেমনটি থাকেনি। নকশালবাড়ির রাজনীতি সফল হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে বিতর্ক থাকতে পারে, দেশব্যাপী সেই নিপীড়িত জনতার বিপুল অভ্যুত্থানে ত্রুটি বিচ্যুতি কতটা ছিল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা আজও নকশালপন্থীরা দখল করতে পারেনি এটাও তর্কাকতীত বাস্তবতা। কিন্তু ১৯৬৭তে তরাইয়ের আকাশে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ যে ভারতবর্ষের আবহমানকালের ইতিহাসের এক অভিনব পালাবদলের সংকেত বহন ক’রে এনেছিল এটা আজ শত্রুমিত্রনির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। সমাজ গবেষকরা আজ নানাভাবে সমীক্ষা ক’রে দেখেছেন ভারতবর্ষের জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে নকশালবাড়ির অগ্নিস্ফূলিঙ্গ একেবারে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। এমনকি শাসকশ্রেণীগুলির আদবকায়দাও সে বদলে দিয়েছে। তাই প্রায় তেতাল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও আপাত: পরাজিত, বিপর্যস্ত, ছত্রভঙ্গ একটি আন্দোলন আজও প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়, অন্ধ্রপ্রদেশে, বিহারে, ঝাড়খণ্ডে, ছত্তিশগড়ে, জামগড়ে, পুরুলিয়ায়, মেদীনিপুরে বা বাংলাদেশের কোথাও কোথাও আজও বেজে ওঠে কৃষকযুদ্ধের রণদামামা।
আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই নকশালবাড়ির প্রভাব অপরিসীম। একটি ‘মৃত’ আন্দোলন সম্পর্কে এখনো শত্রুপক্ষের আতঙ্ক কাটে না।এখনো শত্রুপক্ষের লেখাপত্রে নকশালবাড়ির বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা অব্যাহত। অন্যপক্ষে নকশালবাড়ির রাজনীতির সপক্ষেও শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে অসংখ্য কণ্ঠস্বর সরব ও সোচ্চার। যে শিল্প-সাহিত্যের বাণিজ্যিক চরিত্রকে আমরা ‘বাজারী’ বলে চিহ্নিত করি, সেই বাজারী পত্র-পত্রিকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীসাহিত্যিকেরা এখনো নকশালপন্থীদের প্রতি সহানুভূতির বন্যা বইয়ে দেন। এখনো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘পূর্ব পশ্চিম’ লিখতে গিয়ে চারু মজুমদারকে চরিত্র হিসেবে আনেন, ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয় চারু মজুমদারের অসাধারণ স্কেচ, প্রচ্ছদ-নিবন্ধ বেরোয় অন্ধ্রের নকশাল আন্দোলন নিয়ে!
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ভোর রাতে শিলিগুড়ির দীপক বিশ্বাসের বিশ্বাসঘতকতায় চারু মজুমদার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় কলকাতার এন্টালী এলাকা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। লালবাজারের পুলিশী হাজতে টানা বারো দিন পাশবিক অত্যাচার সহ্য করে ২৮ জুলাই শহীদের মৃত্যু বরণ করলেন আজীবন বিপ্লবী এই মানুষটি। চারু মজুমদার আজ নেই। কিন্তু তিনি ভারতবর্ষের শোষিত জনগণের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন শোষণমুক্তির এক অমোঘ অস্ত্র মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত নকশালবাড়ির রাজনীতি।
সারা বিশ্ব বর্তমানে এক ভয়াবহ ক্লেদযুক্ত ঘৃণ্য রাজনীতির মায়াজালে বন্দী। শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। কেউ নেই পাতানো খেলা আর শাসন-শোষণ করার জন্য চিরদিনের বন্দোবস্ত নেয়া শোষকের বিরুদ্ধ শক্তি। ভেঙ্গে পড়েছে ক্রেমলিনের দুর্গ। টালমাটাল চীনের প্রাচীর। সংশোধনবাদীদের দখলে চেয়ারম্যান মাওয়ের চীন। মাওয়ের প্রিয় হো চি মিন এর ভিয়েতনাম সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বন্ধু! একা একা কিউবা আর উত্তর কোরিয়া পুঁজিবাদী চক্রের আক্রমনের দিন গুনছে। পূর্ব ইয়োরোপ ফিরে গেছে বিপ্লবপূর্ব অমানিশার কালে। ভারতের কমিউনিস্টরা ভোটের টানে গ্রাম ছেড়ে রাইটার্স-এ উঠে দম নিচ্ছে! সীতারাম ইয়েচুরিরা কংগ্রেসের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতার স্বাদ পেতে মরিয়া। এইসব সুবিধাবাদীতা, আপোষকামীতা, ভীরুতা, সংশোধনবাদ, ভোটের রঙ্গ আর তথাকথিত গণতন্ত্রের মায়া মরিচিকায় বিভ্রান্ত এ যুগের তরুন, কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী আর নিপীড়ি আপামর মানুষ তবুও তাঁর আসার অপেক্ষায় প্রহর গুণে চলেছে। তিনি আসবেন। নিশ্চই তিনি আসবেন।
স্তালিনের মরদেহ গ্রাস করে মাটি, লেনিনের মূর্তি ভেঙ্গে পড়ে, মার্কসের মূর্তি সরে যায়, লেনিনের কফিনে মোড়া মমি লেনিনগ্রাদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, রেড স্ক্যয়ারের নাম বদলে যায়, লেনিনগ্রাদ হয়ে যায় সেন্ট পিটার্সবুর্গ! মাওয়ের মুখে লেপে যায় অপমানের কালি, সেই কালি লেপনকারী কে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়, নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তারা ভোটে হেরে যায়, নকশালপন্থী নির্বাচন প্রার্থীদের প্রায় সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়! অসীম চ্যাটার্জীও ভিক্ষুকের বেশে হেঁট মুণ্ডে দাঁড়ায় আলিমুদ্দিনে!
তবু অন্ধ্রে ঘনঘন বৈঠক বসে, পুরুলিয়ার কৃষকরা নন্দিগ্রামে রক্ত ঝরায়, টাটার দখলকে হটিয়ে দেয়, এক সময়ের লাল নেতারা টাটার হয়ে ওকালতি করে, শিল্পপার্ক গড়ে উন্নতির সোপানের স্বপ্ন দেখায়, আধা সামরিক বাহিনী উপদ্রুত অঞ্চলে ফ্ল্যাগ মার্চ করে বেড়ায়, মনিপুরের নারীরা উলঙ্গ হয়ে অত্যাচার অপমানের প্রতিবাদ করে, মাওবাদীরা অন্দ্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড,উত্তরখণ্ড আর ছত্তিশগড়ে অবস্থান শক্ত করে! বন্ধ কারখানার সামনে ও ফুটপাথে কঙ্কালসার শরীর পড়ে থাকে সারি সারি, সল্টলেকে বহুতল বাড়ি তোলে লালরঙের মন্ত্রী ও মাফিয়া।
মানুষ কান পেতে আছে, তুমি কথা বলো, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ চারু মজুমদার!
"অসমাপ্ত বিপ্লব অমর বিপ্লবী কমরেড চারু মজুমদার" বইয়ের ভূমিকা থেকে সংকলিতঃ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৩৫