আগে কিছুটা গোপন থাকলেও তারেক রহমানের ইস্যু এখন আর বিএনপিতে মোটেই গোপন নয়। বরং বিএনপির গণ্ডি পেরিয়ে দলটির সমর্থকগোষ্ঠী ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যেও তারেকের ‘রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ’ -এ আলোচনা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। বলা হচ্ছে, বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পুরোটাই নির্ভর করছে তারেক রহমানের রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর। অর্থাৎ দলের সিনিয়র এই ভাইস-চেয়ারম্যান আগামীতে বিএনপির রাজনীতিতে থাকবেন কি না তার ওপর দলটির ‘ভবিষ্যৎ’ নির্ভর করছে। আর খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরের মাধ্যমে এই ইস্যুই তারেকের সঙ্গে আলোচনা করে নিষ্পত্তি করবেন বলে দলটির নেতারা ধারণা করছেন। কিন্তু স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে মুখ খুলতে রাজি নন দলের নেতারা ।
তবে সমর্থক পেশাজীবী নেতাদের মধ্যে শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এবং প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন স্বীকার করেছেন, তারেক রহমানকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। কিন্তু বিএনপি কী করবে সেটি দল তথা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিজস্ব বিষয়। এমাজউদ্দীন আহমদ বাড়তি শুধু এটুকু বললেন, ‘দেখা যাক আমরা চেয়ারপারসনকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি’।
তারেকের বিরুদ্ধে এর আগে যারাই কথা বলেছেন তারাই তার সমর্থকদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। সর্বশেষ মে মাসে দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য তার সমর্থকদের হাতে ধানমণ্ডি এলাকায় লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
গত ১৪ আগস্ট যাওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে পিছিয়েছে খালেদার লন্ডন সফর। তবে আগামী ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর তার ওই সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
সূত্রমতে, বিএনপির রাজনীতিতে যদি তারেকের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন বিএনপি কতটা পাবে তা নিয়ে বিএনপির পাশাপাশি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও প্রশ্ন আছে। ফলে তারা খালেদা জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। বলছেন, অনেক চেষ্টা করেও তারেককে আস্থায় নিতে পারছে না ভারত। কারণ ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েও তারেক তা রক্ষা করেননি। উল্টো ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে তারেক কিংবা তার অনুসারীদের দায়ী করছে ওই দেশটির ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ বলে পরিচিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ফলে এবার বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা কিংবা আস্থায় নেওয়ার প্রশ্নে ওই দেশটির প্রথম শর্তই হলো- বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারেক কী করবে? কারণ তারেক ক্ষমতায় ফিরে এলে প্রতিশ্রুতি রক্ষা তো করবেই না, উল্টো সবকিছু ভণ্ডল করে দেবে এমন আশঙ্কা করছে দেশটির কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এমন অন্তত তিনজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেন, তারেকের পাশাপাশি জামায়াত ইসলামী নিয়েও ভারতের আপত্তি আছে। কিন্তু জামায়াত ইস্যুটি রাজনৈতিক। তাই জামায়াতের সঙ্গে তাদের (ভারত) নিজেদের কথা বলার পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু তারেক ইস্যুটি কিছুটা বিএনপির ব্যক্তিনির্ভর। ফলে এই ইস্যুতে তাদের রাজি করানো যাচ্ছে না। তারা অন্তত আগামী ১০ বছর রাজনীতি থেকে তারেকের ‘অবসান’ চায়।
এদিকে শুধু ভারত নয়; যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকদের কাছেও এখন পর্যন্ত তারেক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি। ওই দেশগুলোও মনে করে, জঙ্গিবাদ দমন ইস্যুতে ভবিষ্যতে তারেকের সমর্থন কতখানি পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নন। কারণ ক্ষমতায় থাকতে রাজশাহী অঞ্চলে কথিত বাংলা ভাইয়ের উত্থানের নেপথ্যে সমর্থনদানকারী বিএনপি নেতারা তারেকেরই সমর্থক ছিলেন। এছাড়া একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায়ও তারেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে, সুশীল সমাজের মধ্যে বিএনপির সমর্থকদের পাশাপাশি তুলনামূলক ‘নিরপেক্ষ’দের মধ্যেও তারেকের সমর্থন প্রায় নেই বললেই চলে। বিশেষ করে নানা কারণে বর্তমান সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ অংশ, যারা বিএনপিকে সমর্থন করলেও তারেকের বিষয়ে ঘোরতর বিরোধী। এ অংশের মতামত হল- ওয়ান-ইলেভেনের পর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও তারেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোনও পরিবর্তন হয়নি। তিনি আগের মতোই সমাজে ঘৃণিত ও অপরিপক্ক কিছু নেতাকর্মী দ্বারা এখনো পরিবেষ্টিত বলে তারা মনে করেন। ফলে রাজনীতি থেকে আপাতত তারেকের অপসারণের পক্ষে তারাও। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও বড় অংশ তারেকের বিপক্ষে। তারা মনে করেন, বিএনপিতে তারেকের কর্তৃত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হলে ওই দলে তাদের আর ভবিষ্যৎ নেই। ফলে বাইরের বিভিন্ন শক্তি যখন তারেকের বিরুদ্ধে কথা বলেন, এর সঙ্গে ‘সায়’ দেন বিএনপির ওই নেতারাও।
সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিষয় হলো- দেশের ভেতর ‘ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র’ বলে পরিচিত সামরিক ও বেসমারিক আমলারাও তারেক রহমানকে পছন্দ করেন না। অথচ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ওই শক্তিগুলো ‘নিয়ামক’ ভূমিকা পালন করে থাকে বলে মনে করা হয়। বিএনপি নেতারা জানান, তারেক ক্ষমতায় গেলে ওয়ান-ইলেভেনের পর সংঘঠিত বিভিন্ন ঘটনায় প্রতিশোধ নেবে বলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও আলোচনা আছে। ফলে তারাও তারেকের বিপক্ষে।
এদিকে, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারাসহ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ বেশকিছু রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে ঐক্য গড়তে আগ্রহী। কিন্তু তাদেরও প্রধান ভয় তারেক। বি. চৌধুরীসহ ওই দলগুলোর নেতারা মনে করেন, ক্ষমতায় যেতে পারলে বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন সরকার পুরোপুরি তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ওই অবস্থায় তাদের কোনও গুরুত্ব থাকবে না। বরং বিভিন্ন ইস্যুতে তারেক প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। ফলে দলগুলোর আগ্রহ সত্ত্বেও বিএনপির সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা বেশিদূর এগোয়নি। সবকিছু তারেক ইস্যুতে আটকে আছে। বাংলাট্রিবিউন
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৮:৪০