somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘মুক্তি কাহা হ্যায়, মালাউন কাহা হ্যায়, আওরাত কাহা হ্যায়?’

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নয় মাসব্যাপী ওদের প্রশ্ন ছিল, ‘মুক্তি কাহা হ্যায়, মালাউন কাহা হ্যায়, আওরাত কাহা হ্যায়?’ ওদের কাঁধে সর্বক্ষণ রাইফেল থাকত। ওরা বাঙালিদের মতো ভাত খেত না, ওদের প্রিয় খাদ্য ছিল রুটি আর গরুর মাংস। গরুর মাংসে মাথা গরম হয়। হিন্দু নারী ধর্ষণ করা ছিল ওদের একটি মারাত্মক আকাক্সক্ষা। এটা শুধু যৌনলিপ্সা নয়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল হিন্দুদের শত্রুজ্ঞান করে। অথচ জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের সঠিক বাস্তবায়ন হলো না। যে হিন্দুদের শত্রু ঘোষণা করা হলো তারা পূর্ব বাংলায় থেকে গেল বলির পাঁঠার মতো। আবার জিন্নাহ যে বলেছিলেন মুসলমানরা পাকিস্তানে থাকবে, কেননা হিন্দুরা আর মুসলমানরা এক ভূখণ্ডে থাকতে পারে না, তারা জাতি হিসেবে আলাদা; তাদের বসবাসের জায়গাও হবে আলাদা। অবশ্য জিন্নাহ এতদূর যাননি যে, আকাশ, নদী, সমুদ্র, প্রকৃতি, যানবাহন আলাদা আলাদা হবে। তারপর দেখা গেল জিন্নাহ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসেই তার কথা উল্টিয়ে দিয়েছেন। বললেন যে, না না, তাই কি হয়? সবাই হবে পাকিস্তানি। রাষ্ট্রের সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক কী? ওটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ কথা না বলে উপায় ছিল না জিন্নাহর। পূর্ব বাংলায় এত হিন্দু, পশ্চিম বাংলাসহ সারা ভারতে এত মুসলমান রয়ে গেল। তারাতো দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষে জর্জরিত হবে। মাওলানা আজাদ বলেছিলেন যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব সমস্যা বাড়াবে ছাড়া কমাবে না। কারো কথায় কান দেননি জিন্নাহ। সুভাষচন্দ্র বসু, খান আবদুল গাফ্ফার খান, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী কারো কথায় কান দেননি। তাদের কথা মনে পড়েছিল জিন্নাহর পাকিস্তান লাভের পর। মনে পড়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব হিন্দুকে মুসলমানের কাছে আর মুসলমানকে হিন্দুর কাছে শত্রু বানানো হলো। এর পরিণাম হবে ভয়াবহ।
কী অবস্থা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর উভয় দেশের সংখ্যালঘুদের? ভয়ে তারা গর্তের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। পাকিস্তানি নাগরিকদের মগজে জিন্নাহ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আর কোনো উন্নতির দরকার নেই, শুধু হিন্দুদের শত্রুজ্ঞান করতে হবে তাতেই পাকিস্তানের শনৈ শনৈ উন্নতি হবে।’
এ কারণে দীর্ঘ নয় মাসে পাক জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার, মেজর, কর্নেল ও সিপাহিরা খুঁজে বেড়িয়েছে মালাউন, মুক্তি আর আওরাত। এই ফতোয়া দিতে দেরি করেনি যে বাঙালি নারী মাত্রই হিন্দু নারী, যুদ্ধের সময় বিধর্মী নারীদের বিবস্ত্র করা, ধর্ষণ করা জায়েজ। মাওলানা মওদুদী ও গোলাম আযমরাও এই ফতোয়া সমর্থন করেছিল। যে টিক্কাখান বেলুচিস্তানের কসাই নামে খ্যাত, বেলুুচদের ওপর ঈদের দিনে ঈদের মাঠে প্লেন থেকে গুলিবর্ষণ করে রক্তাক্ত করেছিল, সেই নরখাদককেও মওদুদী, গোলাম-নিজামী মুজাহিদ, সাকারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুসলমান বলে ঘোষণা দিয়েছিল। আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বলত ‘দুশমন’ ভারতের ‘দালাল’।
পত্রিকায় দেখলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা জননী বলেছেন যে, পাকপশুরা তাকে গর্তের মধ্যেই ধর্ষণ করেছে। পাক সৈন্যদের নির্মম বর্বরতা সর্বাধিক নেমে এসেছিল বাঙালি নারীর ওপর, আহারে! কত হেনস্তা, কত বেইজ্জতি, কত সম্ভ্রমহানি, কত শ্লীলতাহানি করেছে ইসলামের দোহাই দিয়ে ওরা, অথচ ওদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে এতটুকুও গøানি হয়না এ দেশি পাকি দালালদের।
শরীর শিউরে উঠি পান্না কায়সারের ‘মুক্তিযোদ্ধা আগে ও পরে,’ সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ ও ড. নীলিমা ইব্রাহীমের ‘বীরাঙ্গনা’ বই পড়ে। বধ্যভূমিগুলোর বর্ণনা এখনো ঠিকমতো আসেনি। কিছু কিছু পেয়েছি, তাতেই লোমহর্ষক চিত্র এসেছে। ড. মুনতাসীর মামুন বলেছেন যে, বধ্যভূমিতে বস্তা বস্তা হাড়গোড়, মাথার খুলি পাওয়া গেছে।
ওরা ভাবত বাঙালিরা মুসলমান নয়, তাই পরিকল্পনা করেছিল প্রত্যেক বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করে মুসলমানের বীজ রোপণ করবে। মদ খেতে খেতে, রুটি ও মাংস খেতে খেতে ওরা এই নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল। আরো নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চললে ওরা এই কাজটি করতে পারত। খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে নারী ধর্ষণের মাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে মালাউন খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে আওরাত খুঁজে বেড়ানোর মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। রাজাকাররা মুরগি ডিম, গরু-ছাগল সাপ্লাই দেয়ার সময় নারীও সাপ্লাই দিত মিলিটারিদের ক্যাম্পে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে প্রতিটি বাংকারে ধর্ষিতা নারী পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ওরা সর্বাধিক ক্রুদ্ধ ছিল। তাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রথম প্রহরে প্রথম আঘাত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হল থেকে যেসব ছাত্রী ধরতে সক্ষম হয়েছিল তাদের চূড়ান্ত বর্বরতার শিকার হতে হয়েছিল।
পরাজয় আসন্ন জেনে বুদ্ধিজীবী নিধনে নেমে পড়েছিল, বুদ্ধিজীবীদের ওরা মনে করত হিন্দু ও কস্যুনিস্ট। দেশ স্বাধীনের পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনরা ভেঙে পড়েছিল বধ্যভূমিতে। তারা বিরাণ-বধ্যভূমিতে যে ক্ষত-বিক্ষত, বিকৃত লাশ পেয়েছে, তাকেই বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। কত নির্মমভাবে ড. জেসি দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, জহির রায়হান ও তদীয় ভ্রাতা শহিদুল্লাহ কায়সারকে হত্যা করেছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
ওদের এজেন্টরা এখনো এই দেশে একই রকম বর্বরতা চালানোর চেষ্টা করছে। অতএব সাধু সাবধান।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক, গবেষক।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠিক কোন বিষয়টা মৌলবাদী পুরুষরা শান্তি মত মানতে পারে???"

লিখেছেন লেখার খাতা, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৭


ছবি - গুগল।


ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম এখন আর শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, রোজগার এর একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্মও। একটু স্মার্ট এবং ব্রেন থাকলে ফেসবুক/ইনস্টাগ্রাম থেকে রোজগার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×