কেশর দোলানো বাবরি চুলের আপাদমস্তক শিল্পী - আহমেদ নেওয়াজ। যিনি চিত্রশিল্পী, গ্রাফিক ডিজাইনার, ইন্টেরিয়ার ডিজাইনার, চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রাক্তন প্রভাষক, ব্যন্ড গ্রুপ সোল্স এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠক । নন্দনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এ শিল্পীর ছোঁয়া লাগেনি। কিন্তু প্রসঙ্গ হলো আপনি ছবি আঁকছেন না রান্না করছেন , তা মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে তা কিভাবে করছেন।অর্থাৎ কতটুকু তা শিল্পীত ভাবে হচ্ছে তা বিবেচ্য। শিল্পী আহমেদ নেওয়াজ রঙ রেখার সীমা ছাড়িয়ে বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক যাই করেছেন, তা শিল্পীত মননের ছোঁয়াই অনন্য হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে তিনি শিল্প প্রভাবক হিসেবে এ অঞ্চলের জনমানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন একটি মাজত রুচির বৈভবে। তার সামষ্টিক চেতনা সৃষ্টি ঢাকা -চট্টগ্রাম কে সমানতালে কিংবা কখনো কখনো চট্টগ্রামকে এগিয়ে রেখেছে।
তার জন্মদিনকে ঘিরে ৩১ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৫ পর্যন্ত বন্ধুরা আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি ও শিল্প প্রাংগণ হাটখোলায় শিল্পীর স্কেচ ড্রয়িং কলম-কালিতে আহমদ নেওয়াজ এর খেরোখাতা প্রদর্শনী। শেষ দিনে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এ প্রদর্শনী দেখার এক অনুজ সহ। দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমার উপরি দায়িত্ব ছিল বিমূর্ত বিষয় আশয় খোলাসা করার।তখন আমার মননে কাজ করছিলো অসামান্য শিল্পতত্ত্বিক প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের শিল্পবোধ ও শিল্প চৈতন্য বইয়ের আলোচনাগুলো।আলী আহসান স্যারের শিল্পের স্বভাব ও আনন্দ শিরোনামে আরো একটি শিল্প আলোচনার বই রয়েছে- যা বাংলাদেশে অনেক চিত্র সমালোচকের মনন গঠনে ভূমিকা রেখেছে।........
কবিতা ব্যাবচ্ছেদের মূল উপাত্ত যেমন শব্দ,ভাস্কর্যের ইট সিমেন্ট, গানের কথা ও সুর,তেমনি চিত্রের মুল উপাদান রঙ ও রেখা। রঙ যদি নির্দিষ্ট হয়ে যায়- তখন রেখার বৈচিত্র্য,গঠন,গড়ন,বিকাশ ও উত্তানের মধ্য দিয়ে চিত্র আলোচনা গড়ে ওঠে।কলম কালিতে করা আহমেদ নেওয়াজের আটান্নটি স্কেচ প্রদর্শনী ও ক্যাটালগে গ্রন্থিত হয়েছে। তবে কলম ও কালিতে বৈচিত্র্য আছে। নানা রঙ ও মাত্রার কলম এবং কাগজের সমন্বয় হয়েছে। যা ক্যাটালগে বোঝা যায় না।
প্রসঙ্গ হিসেবে এসেছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ,বিজয়,দায়মুক্তি, প্রেম,অন্তর্গত বিষয় আশয়, মানবতা,মানুষের মনো বৈপরিত্য,চেতনা,রবীন্দ্র-নজরুল,আধ্যাত্মিকতা,নারী, নর-নারীর সম্পর্ক,ধর্মবোধ,অসাম্প্রদায়িকতা,স্মৃকি, চিরন্তনা-জন্ম-মৃত্যু,সৃজনবেদনা,ভালোলাগা,নৈর্ব্যক্তিকতা,প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি অবলোকন এবং আত্মপ্রতিকৃতি।
ব্রোশিয়ারে চৌদ্দটি স্কেচ স্থান পেয়েছে। স্বভাবতই তা শিল্পীর নির্বাচন। কিন্তু যারা প্রদর্শনী দেখেছেন কিংব ক্যাটালগ দেখেছেন তারা বলবেন এর বাইরে আরো চমৎকার স্কেচ শিল্পীর রয়েছে। বিশেষ করে আলোকিত প্রার্থনা,সাত মার্চ, পক্ষে বিপক্ষে,বৈপরীত্য,বিশ্বাসের বাতিঘর,জয় বাংলা, স্মৃতি একাত্তর, মুখোমুখি বসিবার, অবগাহনের মধুরিমা,মাটি হবো মাটি সহ আরো অনেক স্কেচ ভালোলাগায় স্থান পাবে|
২.
স্মৃতি একাত্তর স্কেচটি একটি পুরনো বাড়ি, কাঠামো বলে দেয় উনিশ শতকের শুরুতে নির্মান। তার শীর্ষে জয়বাংলা এবং দেয়ালে লেখা বাংলাদেশ স্বাধীন কর।ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। স্বাধীনা সংগ্রাম চলাকালে এভাবে ব্যাক্তি বিশেষে ঘরের দেয়ালে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান কতটুকু নিরাপত্তার ছিলো তা ভাববার বিষয়! কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম , জনগণ চেতনা কে ছুঁয়ে ছিলো শিল্পী আহমেদ নেওয়াজের সংগ্রামী বোধ। তারুণ্যের স্বাক্ষর এ স্কেচটি।সাত মাচর্ঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম স্কেচটি একটি ইতিহাসকে ধরে রাখার চেষ্টা। বঙ্গবন্ধুর সাত মাচর্ের ভাষণের সেই উদ্ধৃপ্ত হাত তিনি এঁকেছেন। ঝঞ্জার মাঝে শ্বেত পান্জাবীর সেই তেজদীপ্ত হাত ইতিহাসের বজ্রনিনাদ হয়ে শিল্পীত হয়ে ওঠেছে এ স্কেচে। জয় বাংলা র বলিষ্ঠ ফিগার ও রেখা স্বাধীনতা সংগ্রাম কে উজ্জীবিত করার দীপ্ততায় ভাষ্যর। দায়মুক্তি স্কেচটি কলম কালির সাথে অন্য মাধ্যমে ফাঁসির রজ্জুটি উজ্জ্বল ভাবে পষ্ট করা হয়েছে।পক্ষে বিপক্ষে স্কেচটি চারটি বিচ্ছিন্ন রেখার উপস্থাপনা। ফিগারের প্রয়োজনে কখনো সরু কখনো পুরু হয়েছে।শুধু শেষ রেখার উপান্তে দুটো মোটা বিন্দু দিয়ে প্রৌঢ়ত্ব প্রকাশ করেছেন শিল্পী। এটি তার অনন্য স্কেচ। অসাধারণ কুশলতার নান্দনিক বোধ প্রকাশ পেয়েছে এ স্কেচে।তেমনি আর একটি স্কেচ বৈপরীত্য। মাত্র দুটো রেখা ও একটি বিন্দুর প্রকাশে সম্পূণর্িমা পেয়েছে এ স্কেচটি।দীর্ঘশ্বাস এর নারী ফিগারটি চমৎকার তবে বিমূর্তায়নে পুরো বিষয় পষ্ট হয়নি। বাঙালী মুসলমান পরিবারের সন্তান হিসাবে বিশ্বাসের বাতিঘর স্কেচটি ঐতিহ্য সচেতন বলে শিল্পীকে চিহ্নিত করে। আধুনিক বিমূর্ত চিত্রকলার ধারায় অনন্য একটি উদাহরণ হতে পারে শিল্পী আহমেদ নেওয়াজের আলোকিত প্রার্থনা স্কেচটি। বিষয় ,রেখা, উপস্থাপনা, আলোছায়ার বিন্যাস কিয়োবিক গ্রাফ গুলো সত্যি তার অন্তরগত শিল্প সত্ত্বাকে সার্থক ভাবে প্রকাশ করে।আলোর মহিমা, আসুরের দমন সুরের জয়,আলোকবর্তিকা স্কেচগুলো তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ।
তার অবগাহনের মধুরিমা,মুখোমুখি বসিবার,মীন,অশেষ চুম্বন,অভিসার,প্রজাপতি একদিন, আত্মসমর্পন, আখি পাখির লিখিত যন্ত্রণা, অপেক্ষার আগুনে পোড়া মন, নক্শী কাথার স্বপ্ন বুনন,আলোর ঝর্ণাধারা চমৎকার স্কেচ হিসেবে দর্শক নন্দন হবে।
যে কোনো শিল্প মাধ্যমের প্রধান বিষয় প্রেম। সে রূপে হোক। শিল্পী আহমেদ নেওয়াজ সমাজ সচেতন হয়েও অন্তর্গত বিষয় আশয় হিসেবে প্রেমই মূখ্য।দীর্ঘশ্বাস,প্রেম প্রকৃতির খেরো,অবগাহনের মধুরিমা,সম্ভানার হাতছানি,প্রকৃতির ভালোবাসা, গন্তব্যহীন গন্তব্যে, পূর্ণতা,মুখোমুখি বসিবার,অন্তর্গত উপখ্যান, অশেষ চুম্বন, অবলোকন চিত্রপট, অভসার,প্রতীক্ষা, আলোকিত অন্ধকার, আত্মসমর্পন,অন্যরকম নারী স্কেচগুলো এ প্রাসঙ্গিক।স্কেচগুলোতে প্রেম নানা পর্বে উপস্থাপিত হয়েছে।তা কখনো প্রেমজ, কখনো কামজ, কখনো পূর্ণতায়।সঙ্গ অসঙ্গও এসেছে তবে নান্দনিক ভঙ্গিতে। কখনো মনে হয়ন খুব বেশী লবনাক্ত|
৩.
শিল্পী আহমেদ নেওয়াজের রেখার ছুটে চলা দূরন্ত , অসামান্য। এক টানে পূর্ণতা পেয়েছে অনেক ক্ষেত্রে চমকে দেয়ার মতো। তার স্কেচে সামান্য কটি রেখা কথা বলে ওঠে। বিশেষ করে পক্ষে বিপক্ষে, বৈপরীত্যে বসবাস,মীন, মুখোমুখি বসিবার,অবলোকন চিত্রপট,আখি পাখির অকথিত যন্ত্রনা,আগ্রাসন,আত্মপ্রতিকৃতি,নুরজাহানের হন্তারক বিলাস,অন্তলীন সম্পর্ক রেখা চিত্রে বক্তব্য পূর্ণতা পেয়েছে সুক্ষ কিন্তু বাক্ নৃত্যে।শুধু এর রেখাগুলো বলে দেয় শিল্পী আহমেদ নেওয়াজ কতো কতো পরিণত শিল্প সত্ত্বা ধারণ করে আছে।
৪.
খেরোখাতার সমস্ত স্কেচগুলোর মাঝে কোথায় যেনো পরিণত শিল্পের অসাধারণ সংযম নিয়ন্ত্রন আছে। বহূমাত্রিক এ শিল্পীর গভীর বোধের মৌন শিল্প হয়ে স্কেচগুলো কথা বলে নিজের ,পরিপার্শ্বের,সমাজের,রাষ্ট্রের, কিংবা কখনো কখনো মানবিক ঐক্যের,মানবিকতার,অসাম্প্রদায়িক চেতনার,আধাত্মিকতার। বৃহত্তর বাঙালী সংস্কৃতিতে বঙালি মুসলমানের একটি আলাদা চারিত্র্য আছে- যা উদার , অসাম্প্রদায়িক, তবে গণচেতনায় উদ্ধৃপ্ত। শিল্পী আহমেদ নেওয়াজ অবচেতন ভাবে তার প্রতীক হয়ে ওঠেছেন এ কলম কালির খেরোখাতায়। এ চেতনাই শিল্পীকে চিরন্তনের জিয়ন কাঠি ছোঁয়াবে।
৫.
কলম কালিতে আহমেদ নেওয়াজ এর খেরোখাতা। সম্পাদনাঃ অনুপ সাহা ও সুব্রত বড়ুয়া রণি। প্রকাশ কালঃ ১৬ শ্রাবণ ১৪২২ বঙ্গাব্দ, ৩১ জুলাই ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ।
উৎসর্গঃ লিপি-আমার বাবা আবু মোহাম্মাদ তবিবুল আলম
আমার মা সাদাত আরা বেগম
তোমাদের আলোতে আমার মুক্তি