ত্রয়োদশবর্ষীয় কন্যা মৃত্তিকা লিখেছে--
আজ আমার মন ভালো নেই
আজকে আমার মন অনেক খারাপ। আমার মন একদম ভালো নেই। কারণ আমার সবচেয়ে best friend, আমার সবচেয়ে প্রিয় ও কাছের মানুষ, যে ছাড়া পৃথিবীতে কেউ আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করেনা – আামার বাবা ভীষণ অসুস্হ। আজকে বাবার সাথে বিকালে হাঁটতে বের হয়েছি। আজকে স্কুলে কি হয়েছে সব কিছু বাবাকে খুলে বললাম, যেটা প্রতিদিনই করি।সন্ধ্যায় বাবা কাজ করে বাসায় ফিরল। আমাকে বলল, ‘পেটে অনেক ব্যাথা করছে।’ বলেই খাটে শুয়ে কম্বল গায়ে দিল। আামি বললাম, ‘বাবা, এসি ছেড়ে দিব?’ বাবা বলল, ‘না! শীত লাগে।’ আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত গরমে কারো শীত লাগে? বাবা বলল, ‘এপেন্ডিসাইটিস হতে পারে।’ আমি ‘Appendicitis’ নামে কোন রোগের নাম শুনিনি। তাই ইন্টারনেটে এপেন্ডিসাইটিস নিয়ে পড়া শুরু করলাম। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এপেন্ডিসাইটিস নিয়ে অনেক কিছু জেনে গেলাম। একটা জায়গায় লেখা দেখলাম –‘Untreated Appendicitis may cause death.’ এটা পড়ে ভয়ে আমার আত্মা কাঁপতে থাকলো।
বাবা উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। বাবা যেই দিকে মুখ দিয়ে শুয়ে আছে আমি তার বিপরীত পাশে বসলাম। আামার মনে তখন একটা কথাই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে – ‘যদি সত্যিই এপেন্ডিসাইটিস হয়?’ এক পর্যায়ে আমি কথা নেই - বার্তা নেই শব্দ করে কেঁদে দিলাম।
বাবা বলল, ‘একি! কাঁদছ কেন? আমি sure না যে appendicitis হয়েছে।’
আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম, ‘বাবা, আমাকে প্রমিস কর, আমাদের ছেড়ে তুমি কোথাও যাবেনা।’
বাবা কিছু না বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। আমি আরো বেশি ফোঁপাতে থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর বাবা আমাকে বলল, ‘নাইমকে (আমাদের বাসার ম্যানেজার) ডাকো।’ আমি চোখ মুছে বাবার হাত ছেড়ে নাইমকে ডাকতে গেলাম। আম্মুকে বলল, ‘তুষারকে (বাবার ফ্রেন্ডকে) ফোন কর।’
আমি আবার বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। বাবা আবার আমার হাত চেপে ধরল। কিছুক্ষণ পর তুষার আংকেল আসলেন। তুষার আংকেল বাবার পেট টিপে দেখলেন, বাবা তুষার আংকেলকে যেসব বলল তা শুনে আমি ৮০% নিশ্চিত হয়ে গেছি যে বাবার appendicitis হয়েছে। তুষার আংকেল বাবাকে হসপিটালে নিয়ে গেলেন। আমি আমার খাটে শুয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরেরদিন সকালে বাবা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। আমাকে বলল, ‘আমি হাসপাতালে-এ ভর্তি হব।’
আমি বললাম, ‘তোমার কি হয়েছে?’
বাবা বলল , ‘Appendicitis.’
এরপর স্কুলে গেলাম। ফ্রেন্ডদের সাথে খুব কম কথা বললাম। আমার যে মন খারাপ, তার ছাপ নিশ্চয়ই আমার চেহারায় ছিল, যেই আমাকে দেখে সেই বলে, ‘তোমার কি মন খারাপ?’ আমি অনেক কষ্টে বলি, ‘কই, না তো।’
আমার মন সত্যিই অসম্ভব খারাপ। আমার মনে হচ্ছে, কেউ আমার বুকের ভেতর একটা ভারী পাথর ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাজরিয়ানও অবাক হয়ে গেল। আমি অনেক চেষ্টা করছি কথা বলার, কিন্তু কিছুতেই পারছিনা। অন্য সময় দুনিয়ার সব কথা বলে তাজরিয়ানের মাথাই খারাপ করে দিতাম। ঠিক করলাম, মন খারাপের কথা কাউকেই বলব না। পরে মনে হল, ফ্রেন্ডদের কাছে কিছু লুকানো উচিত না। এছাড়া নিজের কষ্টের কথা কারো সাথে শেয়ার করলে কষ্টের পরিমাণ কমে যায়।
আমি চেয়েছিলাম শুধু ফ্রেন্ডদেরকেই কথাটা বলতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ক্লাসের সবাই কথাটা জেনে গেল। বাংলা ক্লাসে ডালিয়া আকতার টিচার মাদার তেরেসাকে নিয়ে একটা চেপ্টার পড়াচ্ছিল। আমার পড়ায় মোটেই মন বসছিল না। নিজের অজান্তেই অন্য পৃষ্ঠায় চলে গেলাম।আমি বসেছিলাম ফার্স্ট বেঞ্চে। তাজরিয়ান আমাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘টিচার!’ ওর গলা শুনে মনে হল, ভয়ে-আতংকে অজ্ঞান হয়ে যাবে। আমি চিন্তার জগৎ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসলাম। দেখলাম, টিচার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল। টিচার হুংকার দিয়ে বললো, ‘STAND UP!!’
আমি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁড়ালাম।
কয়েকদিন আগেও বাবার সাথে টিচারদের আচার-ব্যবহার নিয়ে কথা বলছিলাম।আমি বাবাকে বললাম, ‘মনে কর কোন student এর বাসায় ডাকাত ঢুকে কারো পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। স্টুডেন্টটা মন খারাপ করে পড়া না শিখে স্কুলে গেল। টিচার পড়া ধরলে সে পড়া বলতে পারল না। এজন্য টিচার না বুঝে তাকে শাস্তি দিবে। কয়েকটা ধমক দিবে, কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, ক্লাস থেকে বের করে দিবে।’
বাবা বলেছিল, ‘তোমার সাথে আমি একমত। টিচারদের আসলেই এমন করা উচিত না।’
আর আজকে আমার এই অবস্হা! কিন্তু আমার সময় উল্টোটা ঘটল। কারন আমার যে মন খারাপ, সেটা নিশ্চয়ই আমার চেহারায় ফুটে উঠেছে।
টিচার কড়া গলায় বললো, ‘তোমার মনোযোগ কোথায়? আমি কি পড়াচ্ছি আর তুমি কি পড়ছ?’
রাগে-দুঃখে আমার চোখে পানি জমতে থাকলো। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করলাম পানি আটকাবার। চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম, টিচার পর্যবেক্ষণের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। টিচার হঠাৎ গলার সুর পাল্টে বলল, ‘মন খারাপ?’
আমি মাথা নাড়লাম। ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকালো।
টিচার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’
-‘বাবা অসুস্হ।’
-‘কি অসুখ?’
-‘Appendicitis.’
-‘অপারেশন করতে হবে?’
-‘জি।‘
-‘বসো।’
আমি বসলাম। টিচার আবার সবাইকে পড়ানো শুরু করলো। টিচারের সাথে এই ঘটনা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।
পরে আবিষ্কার করলাম এটা একটা কমন অসুখ। অনেকেই আমাকে বলল তাদের পরিচিত কারো না কারো অসুখ হয়েছে আর এটা গুরুতর কিছুনা। আমার ভয় অনেকটুকুই কমে গেল।
বাসায় যেয়ে দেখলাম কেউ নেই। সবাই হসপিটালে।আম্মুকে ফোন দিলাম। আম্মু বলল গাড়ি পাঠিয়ে দিবে। হসপিটালে যেয়ে শুনলাম বাবার অপারেশন প্রায় শেষ। বাবাকে কিছুক্ষণ পর বের করে আনলো। আমি দেখলাম বাবা হাসার চেষ্টা করছে।
বিকালে আবার বাবার কাছে গেলাম। বাবা ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে ‘ও মাগো’ ‘ও বাবাগো’ বলছে। বাবার অবস্হা দেখে আমার মানুষের সেবা করার ইচ্ছা আরো অনেকদূর এগিয়ে গেল।
পরদিন আমি স্কুলে গিয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে ইচ্ছামত আড্ডা দিলাম। একদম স্বাভাবিক হয়ে গেলাম।
আমি ঘুমানো আর স্কুল ছাড়া দিনের প্রায় সবটুকু সময় বাবর কাজে কাটাই। আমার প্রধান কাজ বাবার সেবা করা। এই কাজে যাতে একটুও ব্যাঘাত না ঘটে তাই আমি ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। তাতে কিছু আসে যায়না, আমাকে দেখে কেউ বুঝতোই না আমি ক্যাপ্টেন আর আমি কোন কাজই ঠিকমত করতে পারতাম না।
কয়েকদিন পর বাবা আস্তে আস্তে সুস্হ হয়ে গেল। আমি অনেক ছোট থাকতে বাবা একবার বাস একসিডেন্ট করে প্রচুর ব্যাথা পেল। আমি সেটা না বুঝতে না পারলেও বাবার অভাব অনুভব করে খুবই কষ্ট পেতাম।
বাবাকে আমি বাসায় নিয়ে আসলাম। বাবা পুরোপুরি সেরে যাওয়ার আগেই আম্মু গলগ্লাডারে স্টোন ধরা পড়লো। সেটা আরেক কাহিনী!