ভুল চিকিৎসা, অপচিকিৎসা, সেবার মানএসব নিয়ে রোগী এবং স্বজনদের মাঝে সবসময়ই অসন্তোষ বিরাজমান ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে একজন চিকিৎসক, ডাঃসুলতানা আফরোজ নিজেই এধরনের ঘটনার শিকার। সুলতানা আফরোজ রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ১১তম ব্যাচের ছাত্রী, তার জীবনসঙ্গী ডাঃ শোয়েব আহমদও একই ব্যাচের। একটি টিভি চ্যানেলে এসম্পর্কিত রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ডাক্তার ও হাসপাতালের দায়বদ্ধতা পুনরায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ডাঃ আফরোজ জরায়ু টিউমারের জন্য ঢাকার মীরপুরের ডেল্টা হাসপাতালে ভর্তি হন। অস্ত্রপচারের পর "দুর্ঘটনাবশতঃ" তার একটি মূত্রনালী(ureter) কেটে ফেলা হয়। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই এটি "দূর্ঘটনা"বশতঃই ঘটেছে, তাহলে প্রশ্ন তোলা যায় তারা ৪ দিন পর্যন্ত ঘটনাটি রোগীর স্বজনদের কাছে লুকানোর চেষ্টা করেছে কেন? হিষ্টোপ্যাথলজীর রিপোর্ট আসবার পর তারা স্বজনদেরকে জানিয়েছে ঘটনাটির কথা। যদি অপারেশনের সময়ই জানাতো, তবে রোগীর কেটে ফেলা মূত্রনালীটিই একজন urologist প্রতিস্হাপন করতে পারতেন। চারদিন পর জানানোতে ,রোগীর ইনটেস্টাইন(নাড়ী) থেকে টিস্যু নিয়ে ureter পুনঃগঠন করা হয়। আশ্চর্য হলেও সত্যি, যে ডাক্তার পুনঃগঠন করেছিলেন,চিকিৎসা দেবার আগে আফরোজের স্বামী ডাঃ শোয়েবের কাছে নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন, এ নিয়ে কোন আইনগতঃ জটিলতা না হওয়ার!! হায় চিকিৎসা নৈতিকতা!! সুলতানা আফরোজ বর্তমানে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর আছেন। যদি একজন নিম্নবিত্ত রোগী হতেন,তিনি কোথায় যেতেন! একজন ডাক্তারের চিকিৎসার ক্ষেত্রেই এই অবস্হা! সাধারন রোগীদের ক্ষেত্রে কি হচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এখন সময় এসেছে এ বিষয়টি নিয়ে গভীর চিন্তা করার। রোগীদেরকে আইনগত সুরক্ষার পাশাপাশি ডাক্তারদেরও আইনগত বন্ধনে আনবার প্রয়োজন রয়েছে, সুরক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে।
চিকিৎসাক্ষেত্রে “নেভার ইভেন্টস” এই শব্দটা ২০০১ সালে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন কেন কাইজার,এমডি।তিনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সী ফর হেলথ কেয়ার রিসার্চ এন্ড কোয়ালিটি এর ন্যাশনাল কোয়ালিটি ফোরামের ‘সিইও’। শল্য চিকিৎসার সময় যেগুলো কখনোই ঘটা উচিত নয় সেসব ঘটনাগুলো (বিশেষত wrong site surgery) বুঝাতে এটি ব্যবহ্রত হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। ডাক্তারদের অমনোযোগীতা,ব্যস্ততা,তাড়াহুড়ো,দক্ষতার অভাব, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতা,অপ্রতুল প্রশিক্ষন,ব্যবসায়িক মনোভাব,সর্বোপরি চিকিৎসা নৈতিকতার অবক্ষয় এসবের কারন।২০১১ সালে প্রকাশিত তালিকায় এসব কিছুঘটনার শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে এরকমঃ
১.শল্যচিকিৎসা
ক. সার্জারী/অথবা অন্য কোনও ইনভেসিভ প্রণালী করার সময় ভুল স্হানে করা।(ডান পা’র জায়গায় বাঁ পা’য়ে অস্ত্রপচার)
খ. ভুল রোগীকে অস্ত্রপচার।
গ. ভুল অস্ত্রপচার।
ঘ. অস্ত্রপচারের/পদ্ধতির পর অসাবধানতা বশতঃ যন্ত্রপাতি/অনাহুত বস্তু শরীরের ভেতর রেখে দেওয়া।
২. চিকিৎসাযন্ত্র অথবা ঔষধ সম্পর্কিত
ক. হাসপাতালে বিষাক্ত ঔষধ,যন্ত্র অথবা বায়োলজিকাল প্রোডাক্ট ব্যবহারের ফলে রোগীর মৃত্যু অথবা অসুস্হতা।
খ. সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাযন্ত্রের পরিবর্তে অন্য কোন যন্ত্র ব্যবহারের ফলে দুর্ঘটনা।
গ. হাসপাতালে এয়ার এম্বোলিজম (শিরার ভেতর বাতাস ঢুকে যাওয়া)
৩. রোগী সুরক্ষা সম্পর্কিত।
ক. সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ রোগীকে হাসপাতাল থেকে অভিভাবক ব্যতিরেকে ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া।
খ. হাসপাতাল থেকে পালানো রোগীর ক্ষেত্রে মৃত্যু অথবা আহত হওয়ার মত দূর্ঘটনা।
গ. হাসপাতালে ভর্তিকালীন রোগীর আত্নহননের চেষ্টা অথবা নিজ ক্ষতি করার চেষ্টা যা পরবর্তিতে তার বিকলতার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
৪. রোগী ব্যবস্হাপনা সম্পর্কিত
ক. রোগীকে ভুল ঔষধ,ভুল মাত্রা,ভুল রাস্তা,ভুল সময়,ভুল পরিমান,ভুল তৈরি ঔষধ সেবন করানো।
খ. অনিরাপদ রক্ত অথবা রক্তউপজাত সঞ্চালন।
গ. লো রিস্ক প্রেগনেন্সী সত্বেও হাসপাতালে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু।
ঘ. লো রিস্ক প্রেগনেন্সী সত্বেও হাসপাতালে প্রসবকালীন নবজাতকের মৃত্যু।
ঙ. কৃত্রিম গর্ভসঞ্চারের ক্ষেত্রে ভুল স্পার্ম অথবা ডিম্বসহাপন।
চ. হাসপাতালে ভর্তি অবস্হায় বিছানা থেকে পড়ে যাওয়া।
ছ. হাসপাতালে ভর্তি অবস্হায় তিন অথবা চার মাত্রার “শয্যাক্ষত”।
জ. পুনঃপ্রতিস্হাপনের অযোগ্য কোন বায়োলজিক্যাল প্রডাক্ট হারানো।
ঝ. যথাসময়ে ল্যাবরেটরী,রেডিওলজী বা এধরনের কোন রিপোর্ট সংগ্রহে ব্যর্থতার কারনে রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি।
৫. পরিবেশগত কারণ।
ক. হাসপাতালে ভর্তি অবস্হায় বৈদ্যুতিক শকে মারা অথবা আহত হওয়া।
খ. মেডিক্যাল গ্যাস সরবরাহ লাইনে ভুল গ্যাস,বিনা গ্যাস অথবা বিষাক্ত গ্যাস সরবরাহের ফলে রোগীর মৃত্যু অথবা ক্ষতি।
গ. হাসপাতালে ভর্তি অবস্হায় আগুন লেগে শারীরিক ক্ষতি অথবা মৃত্যু।
৬. রেডিওলজী সম্পর্কিত।
ক. এমআরআই এলাকায় ধাতব পদার্থের উপস্হিতির ফলে রোগীর ক্ষতি।
৭. ক্রিমিনাল ইভেন্টস
ক. ডাক্তার অথবা স্বাস্হ্যকর্মীর পরিচয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান।
খ. হাসপাতালে যৌন হয়রানী।
শতকরা ৭১% ক্ষেত্রে “নেভার ইভেন্টস” ঘটনাগুলোর ফলাফল মৃত্যু বলে দেখা গেছে।মৃত্যু অথবা যাই হোক রোগী ও পরিবারের জন্য “নেভার ইভেন্টস”এক বিপর্যয়কর অভিজ্ঞতা।শারীরিক,আর্থিক,মানসিক,পারিবারিক সমস্ত ক্ষেত্রেই বিপর্যয়,শুধুমাত্র চিকিৎসকের অমনোযোগীতা,অদক্ষতা যার মূল কারন।
হিপোক্রীটাস্ এর শপথ এর মূলনীতি “Beneficence”-(to do good) এবং “Non-maleficence”-(to do no harm) এর অস্তিত্ব আমাদের চিকিৎসক আর হাসপাতালগুলোর কতটুকু আছে?
Play Videoটিভি প্রতিবেদনটি