somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কাল্পনিক_ভালোবাসা
বহুদিন আগে কোন এক বারান্দায় শেষ বিকেলের আলোয় আলোকিত উড়ন্ত খোলা চুলের এক তীক্ষ্ণ হৃদয়হরনকারী দৃষ্টি সম্পন্ন তরুনীকে দেখে ভেবেছিলাম, আমি যাদুকর হব। মানুষ বশীকরণের যাদু শিখে, তাকে বশ করে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিব সারাটি জীবন।

সস্তা প্রেমের গল্প নাম ' আমার বৃষ্টি বিলাস'

১৯ শে জুন, ২০১৩ রাত ১২:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেখার দুর্বলতার কারনে অহেতুক বড় হয়েছে। আমি পর্ব হিসেবে লিখতে চাই না বা পারি না। তাই এক সাথেই দিলাম। যাদের সময় স্বল্পতা তারা চাইলে এড়িয়ে যেতে পারেন ধন্যবাদ। :)


একটা সময় বৃষ্টিকে নিয়ে আমার অনেক আদিখ্যেতা ছিল। রীতিমত আয়োজন করে আমি বৃষ্টিতে ভিজতাম। বাবার সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করেই ছাদের স্টোর রুমটা দখল করেছিলাম। বৃষ্টি হলে আমি সেখানে চলে যেতাম। একটা পুরানো সাউন্ডবক্স ছিল, সেটাকে কিছুটা মেরামত করে তার সাথে আমার পুরানো ওয়াকম্যানটাকে জুড়ে দিয়ে একটা ক্যাসেট প্লেয়ারের মত বানিয়েছিলাম। ঝুম বৃষ্টি হত আর ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজত হিলারী স্টাগের ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক। অধিকাংশ সময়ই বাজত এ মোমেন্ট উইথ ইয়্যু ট্র্যাকটা। অসাধারন একটা অনুভুতির ব্যাপার ছিল সেটা, সত্যি অসাধারন। প্রবল বর্ষন হচ্ছে, আমি ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি, ঠান্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়, মাঝে মাঝে ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছি ভাবতেই আমার এখনও দারুন শিহরন জাগে।

বৃষ্টির প্রতি এত ভালোবাসা থাকার কারনেই হয়ত আমি বৃষ্টি নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়লাম। শ্রাবনের অঝোর ধারার বৃষ্টির মতই সুন্দর ছিল মেয়েটি। এই বৃষ্টি আর বৃষ্টিময় ছিল আমার জীবন। সবাই ভাবত, যা বাবা! যে ছেলের বর্ষার প্রতি এত ভালোবাসা তার বুঝি কোন এক বর্ষার দিনেই প্রেম হয়েছে। আমার খুব মজা লাগত। এমনটা হলে মন্দ হত না। আমি কিছুটা হতাশ হয়েই বলতাম, নাহ! আমাদের পরিচয় কোন এক বর্ষা দিনে হয় নি, বরং আমাদের পরিচয় হয়েছিল গ্রীষ্মের এক তপ্ত বিকেলে, প্রচন্ড আলোকিত কোন এক রোদ্র দিনে। ওর পরনে ছিল হলুদ এর মাঝে ছোপ ছোপ সবুজ রং একটা সালোয়ার কামিজ আর সাদা রং এর ওড়না। শেষ বিকেলের আলো হলুদ জামায় পড়ে কেমন যেন একটা সোনালী রং এর অদ্ভুত আভা ছড়াচ্ছিল। আমি প্রচন্ড মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিল, হ্যাঁ এটাকেই বুঝি মানুষ মুগ্ধতা বলে। প্রতিটি মানুষ হয়ত ওকে দেখেই মুগ্ধ হয়। আর মেয়েদের মনে হয় একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে, যা দিয়ে তারা ছেলেদের মুগ্ধতা নিমিষেই বুঝতে পারে। বৃষ্টিও বুঝতে পেরেছিল বিধায় আমার মুগ্ধতা আরো পরিপূর্নতা লাভ করেছিল।

আমি যথেষ্ট স্মার্ট একটা ছেলে , কিন্তু তার সাথে দেখা হলে কেন যেন বোকার মত হয়ে যেতাম। আমি জানতাম মানুষ প্রবল সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলে কিছুটা নির্বাক হয়ে যায় কিন্তু বোকা হয়ে যায় তা জানা ছিল না। ক্যান্টিনে বসে বৃষ্টি যখন তার ঠোঁটের স্পর্শে ছোট ছোট চুমুকে চা পান করত আর দুহাতে আঁকড়ে ধরে থাকত ঐ সস্তা চা এর কাপটিকে, আমি মনে মনে প্রবল ঈর্ষান্বিত হয়ে ভাবতাম, ইস! আমি যদি ঐ সস্তা চায়ের কাপটি হতে পারতাম!!!

যে মেয়েটির সাথে আমার দেখা হত ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে অথবা লাইব্রেরীতে কিংবা চা এর দোকানে সেই দেখা আস্তে আস্তে হয়ে গেল পার্কে অথবা আধো আলোময় কোন রেস্টুরেন্টে। আমাদের প্রেম কিভাবে শুরু হয়েছিল তা ঠিক মনে নেই। ঘটা করে কেউ কাউকে বলিনি ভালোবাসি, কিন্তু তারপরও নিজেদের মাঝে আমরা নিজেদের ভালোবাসার প্রতিবিম্ব ঠিকই দেখেছিলাম। জীবনের এই কয়টি বছর আমার কাছে এই সব পার্ক আধো আলো রেস্টূরেন্ট খুব বিরক্তিকরই লাগত। অথচ এখন কি সুন্দরই না লাগে। প্রেম আসলে মানুষকে বদলে দেয় না, তার চিরচেনা পৃথিবীকে সুন্দর করে দেয়। এই নতুন পৃথিবীটা আরো সুন্দর লাগত যখন আমরা রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াতাম আর বৃষ্টি হত। বন্ধুরা মজা করে বলত, তুই তো শালা ভাগ্যবান!! তোর দুই দুইটা বৃষ্টি। একটা পাশে বসে আর একটা আকাশ থেকে পড়ে। আমি হো হো করে হাসতাম। সেটা মনে হয় গর্বেরই হাসি ছিল কিংবা কোন এক সুখী মানুষের হাসি।

যেদিন দূর্ঘটনাটা ঘটল, সেদিন আকাশটা বেশ মেঘলা ছিল। মাঝে মাঝে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বেশ একটা শিহরন জাগানিয়া ব্যাপার। ছুটির দিন, রাস্তাও বেশ ফাঁকা। আমরা ছুটছি, হাসছি, গান গাইছি নানা রকম পাগলামোতে ভরা সুন্দর কিছু মুহুর্ত। আমাদের ভালোবাসা যেন প্রকৃতির মাঝেও ছড়িয়ে পড়ছে। আর্শিবাদ স্বরুপ ঝরে পড়ছে নানা রঙের পাতা। আমরা রিক্সায় উঠলাম। বৃষ্টি গুন গুন করে গান গাইছে। বাতাসে তার চুল এলোমেলেও হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে উড়ে এসে পড়ছে আমার মুখে। আমি বার বার মুগ্ধ হচ্ছি। আমরা যখন হাইকোর্টের সামনের সিগন্যাল পার হচ্ছি হঠাৎ সামনে থেকে আসা একটা বাস গতি নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে আমাদের রিক্সার উপর উঠে গেল। আমি, বৃষ্টি, রিক্সা ড্রাইভার আর রিক্সাটা দুমড়ে মুচড়ে গেল, ছিটকে পড়লাম রাস্তায়।

আমার সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসছিল। সব কিছু কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে মানুষের হইচই, ধর ধর চিৎকার। কিন্তু কিছুই যেন আমাকে স্পর্শ করছিল না। আমি শুধু বৃষ্টিকে খুজছিলাম। বহু কষ্টে চোখ মেলে দেখি বৃষ্টি আমার সামনে একটু দূরেই পড়ে আছে। সারা শরীরে রক্তের বন্যা, ওর হাত একটু একটু কাঁপছে। আমি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ওকে ধরার জন্য হাত বাড়ালাম। কিন্তু একবিন্দু এগুতে পারলাম না। বরং আস্তে আস্তে বৃষ্টির রক্তের ধারা আমার দিকেই ধেয়ে আসছে, এক সময় তা এসে স্পর্শ করল আমার আঙ্গুলের মাথায়। কেন যেন আমার সেই ছাদের রুমের কথা মনে পড়ে গেল। মনে হল, আমি আমার ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছি আর দূরে কোথাও বাজছে মেহদীর স্টেপস টু দ্যা প্যারাডাইস ট্র্যাকটা। আমার দু চোখ বন্ধ হয়ে এল, গ্রাস করল নিরাট অন্ধকার।



প্রথম যখন চোখ খুললাম, তখন নিজেকে প্রায় অন্ধকার একটা রুমে আবিষ্কার করলাম। লম্বাটে একটা রুম। মাঝখানে একটা আলো মিটমিট করে জ্বলছে। কেমন যেন একটা স্যাতস্যতে পরিবেশ। রুম জুড়ে তীব্র ডেটলের গন্ধ। পরক্ষনেরই বুঝতে পারলাম এটা একটা হাসপাতাল।

-মামা উঠছেন নি?
আমি চমকে উঠে পাশে তাকালাম। অন্ধকারে কে যেন বসে আছে। সামনে এগিয়ে আসতেই মুখে আলো এসে পড়ল। চিনতে পারলাম, এটা তো আমাদের সেই রিক্সাওয়াল! মাথায় বড় একটা ক্ষত চিহ্ন। সেখান ব্যান্ডেজের ফাঁকে তাজা রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে । বাম চোখটা কেমন যেন মনে হচ্ছে কোটর থেকে বের হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এক দলা মাংস পিন্ডের মধ্যে কেউ একটা চোখ বসিয়ে দিয়েছে। আমার কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠল। আমি অবাক জিজ্ঞেস করলাম,
কি ব্যাপার আপনাকে এখনও কোন চিকিৎসা দেয় নাই? মানে এখনও তো রক্ত বন্ধ হলো না?

মামা আমরা গরীব মানুষ। দুই দিন ধইরা এমনিই আছি। আমগো আর কে দেখে। আপনাগো মত মাইষেরই রক্ষা রইল না, আর আমি তো গরীব মানুষ।

দুই দিন ধরে এই ভাবে আছেন মানে!!! আপনার যে অবস্থা তা কি দুই দিন ধরে থাকার মত? এখানকার ডাক্তাররা কোথায়? আপনার পরিবারের লোকজনই বা কোথায়??

দেখলাম তিনি আমার কথার জবাব না দিয়ে রহস্যময় হাসি হাসলেন। আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল। একটা মানুষ দুই দিন ধরে একটা হাসপাতালে এই ভাবে পড়ে আছে আর কেউ চোখে পর্যন্ত দেখছে না, এটা কেমন ধরনের কথা? আমি বেড থেকে নেমে দরজার দিকে গেলাম।ইমারজেন্সিতে গিয়ে একটা তোলপাড় করতে হবে।

মামা বাইর হইয়েন না। এইখানেই থাকেন। বাইরে আপনার ভাল লাগবো না। লোকটার ডাকের মধ্যে কেমন যেন একটা গা শিউরানো ব্যাপার ছিল। আমার গায়ে কাঁটা দিল। আমি লোকটার চোখের দিকে তাকালাম। সেখানে কেমন যেন একটা অনুনয় ফুটে আছে।

লোকটা আবার বলা শুরু করল, আপনার পরিবারের লোক খবর পাইছে, তারা আসতেছে। আমার পরিবারের লোকজনও আজকে খবর পাইছে, কিন্তু টাকা নাই তাই ঢাকায় আসতে পারতাছে না। আমার গ্যারেজের মালিক আসতাছে। একলগে যামুগা। আপনে এইখানেই বইয়া থাকেন। খালি বাইরে যাইয়েন না।

আরে রাখেন! ফাইজলামী নাকি! দুই দিন ধরে এইভাবে অমানুষের মত ফেলে রাখছে, এর একটা বিহিত করতে হবে আগে। তুমি থাক মামা, আমি আসতেছি।

না না মামা যায়েন না। এইখানেই থাকেন।

আমি বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। বারান্দার একদম শেষ মাথায় আমাদের রুমটি। আমি করিডোর ধরে সামনে এগুতে লাগলাম। করিডরটা কেমন যেন খা খা করছে। একটা মেয়েকে দেখলাম বুকের ওড়না ঠিক করছে। আমি হঠাৎ সামনে পড়াতে কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। কিন্তু মেয়েটার তেমন কোন বিকার দেখলাম না। আমার সামনেই বুকের ভেতর হাত দিয়ে টাকা বের করে তা গুনছে। আমি ভারী অবাক হলাম। এখনকার দিনের মেয়েদের আসলে লজ্জাশরম এক প্রকার উঠেই গিয়েছে। আমি বিরক্ত হয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম।

করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একজন চল্লিশার্ধো মহিলাকে দেখলাম জায়নামাজে বসে আছেন। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আর তসবিহ গুনছেন। তার পাশেই একটা কিশোরী মেয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একজন ভদ্রলোক সম্ভবত এই মহিলার স্বামী ও মেয়েটির বাবা, টেনশনে এই মাথা থেকে সেই মাথা হাঁটছেন। একটু সামনে তাকাতেই দেখি রবিন, তুষার, আসিফ, তমাল, তানিয়া আর শর্মীও বসে আছে। এরা তো বৃষ্টির বন্ধু!! এরা এখানে কি করছে? সাথে সাথে আমার বৃষ্টির কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল আমাদের সেই দূর্ঘটনার কথা। আমি ছুটে গেলাম তমালের কাছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বৃষ্টি ......বৃষ্টি কেমন আছে? ও এখন কোথায়? কি অবস্থা এখন?

কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না আমার সাথে। এমন কি আমার দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকাল না। আমি চিৎকার করে আবার জানতে চাইলাম, বৃষ্টি কোথায়? তোমরা কথা বলছ না কেন??

কোন জবাব পেলাম না। রবিনের কাঁধ ধরে আমি ঝাকি দিলাম। করুন স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে প্লীজ বল, ও কোথায়? কেমন আছে?

রবিন কিছুটা বিরক্ত হলো। বিরক্ত হয়ে তমালকে জিজ্ঞেস করল, ফাজলামো করিস? এটা ফাজলামো করার সময়? কাঁধে গুতা দিলি কেন?

তমাল অবাক হয়ে বলল, আমি গুতা দিয়েছি?? আমি? তোর মাথা গেছে!! একটা মানুষ জীবন মৃত্যুর লড়াই করছে আর তিনি এখানে শুরু করছেন বিটলামী!! তো কি কোন সেন্স হবে নারে রবিন?

হঠাৎ অপারেশন রুমের দরজা খুলে গেল। ডাক্তার সাহেব বের হয়ে এলেন। সবাই তার কাছে ছুটে গেলো। শর্মী জিজ্ঞেস করল, বৃষ্টির অবস্থা কি এখন ডাক্তার সাহেব?

আল্লাহর অশেষ রহমত, অপারেশন সফল হয়েছে। ও এখন মোটামুটি বিপদমুক্ত। কিছুক্ষনের মধ্যে রুমে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে দূর্ঘটনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগবে।

সবাই সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করল। তারপর কেবিনের দিকে চলে গেল। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাক আমার বৃষ্টি ঠিক আছে। কিন্তু আমার হঠাৎ কেন যেন প্রচন্ড অভিমান হলো। আমার কথা তারা একবারও কেউ জিজ্ঞেস করল না? আমি আর বৃষ্টি তো এক সাথেই ছিলাম। আমি না হয় সুস্থ আছি, তাও তমালরা তো একবার জিজ্ঞেস করতে পারত আমাকে আমি কেমন আছি? এমন কি আমার সাথে কথা পর্যন্ত বলল না। ওরা কি এই দূর্ঘটনার জন্য আমাকে দায়ী করছে?

আমি ইমাজেন্সির খোঁজে বের হয়ে গেলাম। করিডোরের মাঝামাঝি আসতে দেখলাম, তমালরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আমার বৃদ্ধ বাবা আর আমার ছোট মামা। আমার বাবা হাউ মাউ করে কাঁদছেন। তমাল আমার বাবাকে ধরে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি সামনে এগিয়ে গেলাম, বাবা হয়ত আমাকে না দেখে কাঁদছেন। কাছে যেতে শুনলাম তমাল বলছে,
চাচা, ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোন লাভ হয় নি। হাসপাতালের আনার কিছুক্ষনের মধ্যেই জহির ভাই মারা যান। আমরা লাশ নিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু কিছু ফরমালিটির কারনে পারছিলাম না। তাই আপনাদের আসতে হল।

আমি চমকে উঠলাম। আমি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি আর আমাকেই কিনা মৃত বানিয়ে দিল। এইভাবে একজন মানুষের কাছে কেউ মিথ্যে কথা বলতে পারে? নাহ! বৃষ্টিকে এই সব ছেলে থেকে দূরে রাখতে হবে। ঘৃনায় আমার গা রি রি করে উঠল। কি নোংরা মানসিকতা। আমি চিৎকার দিয়ে বাবাকে ডাক দিলাম, বাবাআআআআ, ও বাবাআআআ আমি বেঁচে আছি। ওরা বাজে ছেলে, তোমাকে মিথ্যে বলছে। তুমি কেঁদো না বাবা।

কিন্তু বাবা কিছুই শুনতে পেলেন না। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি টের পেলেন না। আমি চিৎকার করে আমি ছোট মামাকে ডাকলাম, কেউই আমার কথা শুনতে পারছে না। আমি পাগলের মত ছোটাছুটি করছি, কিন্তু আমাকে দেখতে পারছে না কেন? আমার সাথে সবাই এমন কেন করছে?? কি করেছি কি আমি?? প্রচন্ড অভিমানে বুকটা ভার হয়ে এল। মন খারাপ করে সামনে চলে এলাম আমি।

হাসপাতালের দুইটা বয় আমাকে পাশ কাটিয়ে গেল। আমি পিছন ফিরে তাকালাম। তারা বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। কি যেন বলল, তারপর আমার দিকেই আসতে লাগল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সবাই আমার ভেতর দিয়েই কেমন চলে যাচ্ছে। আমার কেমন যেন নিজেকে হাল্কা হাল্কা লাগছে। আমি বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে এসব। সবাই করিডোরে শেষ মাথায় যাচ্ছে যে রুম থেকে আমি বের হয়ে ছিলাম। একজন বয় এসে রুমের সামনে লাইট জ্বালালো। আমি চমকে উঠলাম। রুমের দরজার লেখা, মর্গ।

আমার মাথা ঘুরিয়ে উঠল। আমি কোন মতে দেয়াল ধরে দাঁড়ালাম। ভেতর থেকে সবাই ধরাধরি করে একটা মানুষ বের করে আনছে। সাদা কাপড়ে মুখটা ঢাকা। মামা কাছে গিয়ে কাপড়টা সরালেন, আমি আমারও চমকে উঠলাম। আমি নিজেকে দেখতে পেলাম। ঠোঁট দুটো আধা খোলা। একটা চোখ দেখা যাচ্ছে না। মাথার ডান সাইডটা প্রায় থেতলে গিয়েছে। ডান চোখ দেখে মনে হলো এক একদলা মাংস পিন্ডের মাঝে কালো কি যেন একটা চকচক করছে। নিজের অজান্তেই মাথার ডান পাশে হাত দিলাম আমি। কেমন যেন ভেজা ভেজা নরম কিছু স্পর্শ পেলাম। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমার আর কিছু মনে নেই।


আজিমপুর গোরস্থান। ভোর পাঁচটা। মাত্রই ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। আমার কবর খোঁড়াও কাজও শেষ। সবাই তারাহুড়া করছে, কারনে আকাশের অবস্থা ভালো না। যে কোন সময়ে বর্ষন শুরু হতে পারে। আমার বাবা ও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকেই কাঁদছে। আমার কান্না আসছে না। মারা গেলে অনুভূতি ঠিক মত কাজ করে না। শুধু মাঝে মাঝে যখন বৃষ্টির কথা ভাবি তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন চিন চিন করে। ব্যাস আর কিছু না।

সুন্দর একটা সকাল হচ্ছে। মেঘলা সকাল। পাখি ডাকছে। এত চমৎকার একটা সকালে আমার পৃথিবী ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমার খুব ইচ্ছে করছে বৃষ্টিতে ভিজতে, বৃষ্টিকে পাশে নিয়ে বসে থাকতে। কিছুক্ষন আগে আমাকে কবরে শোয়ানো হয়েছে। হঠাৎ বুকে এক দলা মাটি এসে পড়ল। দেখলাম আমার বাবাই প্রথমে মাটি দিলেন, তারপর আস্তে আস্তে বাকিরা সবাই মাটি দিচ্ছে। খুব দ্রুতই মাটি ভরে যাচ্ছে। খুব দ্রুতই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে আমার পৃথিবী। বাবাকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, ও বাবা! আমাকে একটু সময় দাও না, আমি শেষবারের মত একটু বৃষ্টিতে ভিজতে চাই। আমার বৃষ্টির প্রতি আদিখ্যেতা তুমি কি ভুলে গিয়েছ? একটু ভিজি?

বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হয়েছে। দ্রুতই সবাই হাত লাগাচ্ছে। তাড়াতাড়ি মাটি দিতে হবে। ইতিমধ্যে কবরটা বেশ সুন্দর একটা আকার ধারন করেছে। কে যেন কিছু ফুল ছিটিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ জোরে বৃষ্টি পড়া শুরু হল। ঈমাম সাহেব বললেন, বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহ রহমত। চলুন সবাই মুর্দার জন্য দোয়া করি। সবাই বৃষ্টির মাঝে হাত তুলে দোয়া করছে। বৃষ্টি আমার হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে সবাইকে, আমার কবরটাকে। কবরের ছাদে বৃষ্টির রিনিঝিন শব্দে আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে। আমি এই ঘুম নষ্ট করতে চাই না।
আমার এই বৃষ্টি বিলাসে অন্যকারো প্রবেশ নিষেধ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৪ ভোর ৬:৩৩
৪৭টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×