তখন আমি কলেজ পাশ করেছি। ভর্তির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি দেশময় । জন্মসূত্রে খুলনা আমার প্রিয় শহর, অনেক আপন ঠিকানা। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইকিনা এইভেবে গিয়েছিলাম বিএল কলেজে। ভালই লেগেছিল। কিন্তু খুব একটা আগ্রহ জাগেনি। কারন মাথায় ছিল বড় কোথাও, ঢাকা অথবা রাজশাহী। তারপরও শেষ ভরসা হিসাবে বিএল কলেজকেই চিন্তা করছিলাম। হাজার হোক জন্মশহর, গন্ধটায় যেন আলাদা! মনে হলেই বুঝতে পারি আতুর ঘরের গন্ধ, আমার ছোট বেলা, সারা শহর চষে বেড়ানো সেই সব দূরন্ত দিনগুলো ! এরই মধ্যে একদিনের অল্প কিছু স্মৃতি আপনাদেরকে বলছি।
কলেজ থেকে শহরে ফিরতে হলে সবচেয়ে ভাল উপায় হলো টাউন সার্ভিস। অন্যের দেখাদেখি আমিও তাতেই চড়ে বসলাম। প্রথমে অনেক ভীড়, কেউ কাওকে চেনা যায়না, বোঝা যায়না এমন অবস্থা। নিউ মার্কেট, জিয়া চত্বর পার হয়ে শহরের ভিতর ঢুকলেই অনেকটা হালকা হয়ে যায়। তখন একে অপরকে ভালভাবে দেখা যায়, সুন্দরী হলে মনেরমত করে সাজিয়ে চিন্তার রাজ্যে কিছুক্ষন ভালবাসার স্বপ্ন আকাঁ যায় । এমনটি কখনও হয়েছিল তা দাবী করছি না। তবে দেখলাম বেশ কয়েকজন সুন্দর চেহারার বালীকা আমার পাশেই অবস্থান নিয়েছে। আহ্ আমার কোনো বান্ধবী নেই। এরাও মনে হয় কলেজে ভর্তি হবে। হলে ভালই। একদিকেই বাসা, একই বাস, মন্দ হবেনা। এসব ভাবতে ভাবতে কবরস্থান এসে গেছি। না খারাপ কিছু ভাববেন না। এটা একটি জায়গার নাম। সেখান থেকে ১০ মিনিট হাটলেই আমার বাসা। রিক্সাতেও যাওয়া যায়। এটা ইচ্ছা আর পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।
যাকগে, কে কে নামবে একটু লক্ষ করলাম। না সুন্দরীদের কেও মনে হয় নামবে না! ঠিক আছে কেও না থাকলে রিক্সা নিয়েই চলে যাবো। ঐতো ওরা সবাই নামছে। আহা কি মজা! কমপক্ষে দুই-তিনজনতো পাবই হাঁটার সঙ্গি হিসাবে। হঠাৎ পুলোকিত অনুভব করছি, আর চিন্তা করছি, হু বিএল কলেজেই পড়তে হবে। বাসে কত মজা, বান্ধবী পাওয়া যাবে এটা নিশ্চিত।
দেখি ওরা কোথায় যায়। চিন্তা করে নিজেকে একটু মেয়েলীপণার মত করে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকলাম। কিছুদূর যেতেই একজন হারিয়ে গেল। এইরে সামনে আর একটা গলী। এবার বুঝি বাকী সবাই চলে যায়! সঙ্গী হারাবার জ্বালা চিন্তা করে আঁতকে উঠলাম। পেটে ক্ষুধাও জমেছে। ভুলই কি করলাম। কেনো যে রিক্সা নিলাম না! কৈনা কোথাও কোনো রিক্সা নেই, আশেপাশে তাকালাম। অভিজ্ঞতা বলে, ঐ অবস্থানে কোনোদিন রিক্সা থাকেও না। আর এভাবে হাটলেই বা কি? কেওতো কথা বলছি না। এত ভাব নিয়ে হাটছিইবা কেনো? ওরা কি আমাকে দেখছে? এই সব চিন্তা করছি আর নিকটবর্তী হবার চেষ্টা করছি। আহ এই প্রথম আমি মুক্ত। মেয়েদের দিকে আমি কত সহজে তাকাতে পারি। কোথাও কোনো বাধাঁ নেই। স্বাধীনতা, তুমি কতই না তৃপ্তিদায়ক!
হঠাৎ পাশথেকে আওয়াজ, আপনি কি বিএল কলেজে পড়েন নাকি ভর্তি হবেন? এইতো কাজ হচ্ছে। মনে মনে বলি ক্ষুধা পেটে হাটার প্রাপ্তি এবার মিটলো তাহলে। সাকসেস, তুমি এগিয়ে যাও, কথা বলো, যত খুসী কথা বলো। এখানে কথা বললে কেও আর তোমার শক্ত বাপকে নালীশ দিবে না, অযথা বকুঁণি খাওয়ার কোনো ঝুকিঁ নেই। তুমি কথা বলো।
ও আচ্চা হ্যাঁ, আমি ভর্তির চিন্তা করছি। সহজাত প্রশ্ন, আপনি? উত্তর, হ্যাঁ আমিও। ও আচ্ছা তাই। আপনার বাসা বুঝি এদিকেই?হ্যাঁ তা না হলে আমি এদিকে যাচ্ছি কেনো?
এইরে সেরেছে, কি একটা প্রশ্ন করলাম! আমি কি গাধা হয়ে গেলাম? বাণী চিরন্তণীতে পড়েছিলাম, ছেলেরা প্রেমে পড়লে গাধা হয়ে যায়। আমিতো এখনই গাধা হয়ে গেছি। প্রেম হলেতো চিড়িয়াখানায় যেতে হবে।
এরই মধ্যে অন্য একজনও আমাদের আলাপচারীতায় যুক্ত হলো। মন্দনা, না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাচ্ছি মনে হলো। যাক্ পারফরমেন্স আরও ভাল করতে হবে। প্রশ্নগুলো অনেক ভাল হওয়া চায়। আহ্ আরতো বেশী পথ নেই! গল্পে গল্পে পথ যেন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। যাক সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
আচ্ছা আপনিওকি খুলনা থেকেই কলেজ পড়েছেন? হ্যাঁ, আযমখান কমার্স কলেজে। হ্যাঁ শুনেছি কলেজটা নাকী অনেক ভাল। আপনি কি কোথাও কোচিং করছেন? না, আমি করছি না। তবে চিন্তা করছি কয়েকটা মডেল টেষ্ট দেবো- একটু ভাব নিয়ে বললাম। আপনি? আমি আসলে গাইড ফলো করছি- বললো এক জন।
কাকে রেখে কাকে প্রাধান্য দিবো বুঝতে পারছি না। ভারী সমস্যাই পড়া গেল। কেও যদি একজন বুঝতে পারে আমি অন্যকে বেশী পাত্তা দিচ্ছি তাহলেতো খাওয়া শেষ। কি করি... কি করি... ব্যালান্স করতে হবে। দুজনের দিকে সমান ভাবে তাকাতে হবে, আর মাঝখানে থেকে হাঁটাটায় ভাল মনে হলো। তাই করলাম।
হ্যাঁ আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে ভালই লাগলো। আশা করি আবার দেখা হবে। সামনের গলীতেই আমার বাসা। আমাকে যেতে হবে। ও আচ্ছা আপনার নামটা কিন্তু জানা হলো না?উত্তর, আমার নাম 'কণা'। হ্যাঁ আপনাদের নাম জেনে নেওয়াটাও ভাল। আপনার নাম কি, বলেই কণা অন্য মেয়েটির দিকে তাকালো। আমিতো প্রায় বলেই ফেলেছিলাম আমারটা। যাক্ লেডী সুড বি ফার্স্ট। আমার নাম, 'হেনা' । 'ও তাহলে আপনার নাম' বলে দুজনে একসাথে আমার দিকে তাকালো। আমি ততক্ষণে ছন্দের দোলায় যেন ভেসে যাচ্ছি, আহ্ কণা, তারপর হেনা। হ্যাঁ বলুন আপনার নাম...টা? আমার নাম 'রাণা'। শুনতেই দুজনে হা হয়ে গেল! কি মিল, কি ছন্দ, কণা, হেনা, রাণা।
একজন বলেই বসলো, আসলে অনেক ভাল লাগলো, অনেক দিন মনে থাকবে এই কথা, এই ছন্দ: কণা, হেনা, রাণা। বলেই গলীর মধ্যে কণা হারিয়ে গেল। কিছুদূর যেতেই আমার বিদায়ের পালা। কণা গেছে, এবার হেনাকেও হারাতে হবে। সত্যি বলতে কি এই হেনায় একটু বেশী সুন্দরী, শরীরের গড়ন ঠিক যেমনটি হওয়া চায়! বেশী কষ্ট অনুভব করতে থাকলাম। ঠিক আছে হেনা, আবার দেখা হবে। হ্যাঁ আবার দেখা হবে বলে, মিষ্টি হাসিতেই বিদায় ঘন্টা বাজলো। ফিছন ফিরে তাকাবার সাহস হলো না। নিজেকে অনেক দূর্বল অনুভব করলাম। এইমাত্র শেষ হয়ে যাওয়া ১০ মিনিটের কথা চিন্তা করতে থাকলাম। বিএল কলেজের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেল। খুলনাতেই থাকবো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। বাসার গেট খুলেই দেখি খালাম্মা ভাত দেবার যোগাড় করছেন। আমাকে দেখেই প্রশ্ন করলেন, রানা তোমার কলেজ কেমন লাগলো? আমি বললাম, "ভালো, অনেক ভাল।"
সবটুকু তখন বলতে পারিনি । হঠাৎ আজ ১৯ বছর পর ঐ ১০ মিনিটের কথা কেনো যেন মনে হয়ে গেল। কথা ছিল দেখা হবার; না দেখা হয়নি। কণা হেনা কোথায় আছে কে জানে! আর রাণা, সিঙ্গাপুরে বসে কিছুক্ষনের জন্য হলেও তাদেরকে ফিরে পেয়েছে। আহ্: কণা-হেনা-রাণা!
আমাদের জন্য দোয়া করবেন। সবাই ভাল থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১১ দুপুর ১:৫৪