somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্লাশের বাইরে ক্লাশের পড়া

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৫:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাইরের শ্রেণীকক্ষের ত্রিমাতৃক চিত্র

আসুন, একটা পড়ার ঘর চিন্তা করি, যার ছাঁদ হলো নীল আকাশ, পায়ের নিচে শীতল মাটি…যে ঘরে কোন দেয়াল নেই, নেই কোন পড়ার বেঞ্চি! যেখানে ক্ষুদে বিজ্ঞানীগভীর মনোযোগ দিয়ে পিপীলিকার-র বাসার তত্ত্ব তালাশ করে, গণিতবিদ হাসি হাসি মুখে বৃষ্টি মাপে, উঠতি লেখক হঠাৎ করেই লেখার উপকরণ খুঁজে পায় আর অভিনেতা প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে আপন মনে অভিনয় করে! যেখানে ফুল, পাখী আর গাছ প্রতিদিন সবার বন্ধু হয়ে যায়! এই ঘরে, অভিভাবকেরা পরস্পরের কাছ থেকে টিপস নেয় , পড়শী হয় তো একটু থামে, কুশলাদি জানে আর শিক্ষকেরা প্রথাগত বাক্স-র বাইরে চিন্তা করে সৃষ্টিশীল…...
এই আশ্চর্য সুন্দর ঘটনাগুলো তখনই সম্ভব হয়ে উঠে যখন স্কুলের সামনের খোলা জায়গাটাতে একটা শ্রেণীকক্ষ, ইংরেজীতে বললে Outdoor Classroom বানানো যায়!

বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের ঝরে পড়ার উচ্চ হারের জন্যে দায়ী অনেক গুলো কারণের মধ্যে একটি হলো ফিজিক্যাল বা ভৌত পরিবেশের দুর্বলাবস্থা, আরো সহজভাবে বলতে গেলে ছাত্রসংখ্যার তুলনায় ছোট শ্রেণীকক্ষ যেখানে গবেষণা ও পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে পাঠদানের সুযোগ কম। অথচ মনোবিজ্ঞানীদের মতে স্কুলবয়সী (৬ থেকে ১১ যাদের বয়স) ছেলে-মেয়েরা সবচেয়ে ভালো শিখতে পারে যখন তাদের সত্যিকারের উপকরণের পরীক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে শেখানো যায়।

আমাদের দেশে শিক্ষার কথা বলতে গেলে সিলেবাস, শিক্ষকের পাঠদান, বই বিতরণ নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু যে পরিবেশে শিশুরা শিক্ষালাভ করে সেই স্কুল ভবন ও তার চারপাশের পরিবেশ আলোচনা থেকে সবসময় অনুপস্থিত থাকে। অথচ যে কোন কিছুর ক্ষেত্রে পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ- কারণ ,মানুষ যে পরিবেশে বাস করে সেই পরিবেশ মানুষের আচার-আচরণ ও শিক্ষার উপর বিরাট প্রভাব ফেলে। শিক্ষাদানের পরিবেশ শিক্ষকের শিক্ষাদানকে প্রভাবান্বিত করে, শিক্ষকদের মতে-প্রাথমিক স্কুলের পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষাদানের অনুকূল নয়, যার ফলে ছাত্ররা স্কুলের প্রতি খুব সহজেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, স্কুলে আসা কমিয়ে দেয় এবং একসময় ঝরে পড়ে।
আমাদের দেশে শিক্ষার পরিবেশ বলতে শুধু ক্লাশরুমকেই বোঝানো হয়! অথচ বিদ্যালয়ের বাইরে প্রকৃতি যে বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে পাঠদানের সুনিপুণ পরিবেশ তৈরি করে আছে এই ব্যাপারটা অনেক সময়ই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় না! শহরের স্কুলগুলোতে জায়গার স্বল্পতার জন্যে অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের বাইরের পরিবেশে পড়ানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না কিন্তু গ্রামের বেশীর ভাগ প্রাইমারী স্কুলগুলোর সামনে অনেকটা খোলা জায়গা থাকে! অনেক স্কুলে দেখা যায় ছোট ক্লাশরুমে অনেক বেশী ছাত্র নিয়ে ক্লাশ চলছে, সবাই বসার পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না! স্কুলের খোলা জায়গাটাকে শুধু টিফিনের সময় খেলার জায়গা হিসেবে না ভেবে খুব সহজেই স্বল্প খরচে বাইরের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে কাজে লাগানো যায় ! গবেষণা থেকে জানা যায়- যে বয়েসী শিশুরা প্রাথমিক স্কুলে যায় তারা ঘরের চেয়ে বাইরে সময় কাটাতে বেশী পছন্দ করে। ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি স্কুলের উপরে করা এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে- স্কুল ভবনের বাইরের পরিবেশই বাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। তাছাড়া, বাইরের শ্রেণীকক্ষে বাচ্চারা যেসব বিষয় বইয়ে পড়ে তা-ই সরাসরি প্রকৃতিতে দেখে হাতে-কলমে আরো ভালোভাবে শিখতে পারে। কোন মাটি বেলে বা দোঁআশ অথবা কোনটা একবীজপত্রী বা দ্বিবীজপত্রী গাছ তা শেখার জন্যে বাইরের শ্রেণীকক্ষই হতে পারে সবচেয়ে উপযোগী জায়গা।

বুয়েটে স্থাপত্য বিভাগের মাস্টার্স থিসিসের অংশ হিসেবে সম্প্রতি নরসিংদীর রায়পুরায় কান্দাপাড়া শহীদ বশিরুল ইসলাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েএকটি বাইরের শ্রেনীকক্ষ বানানো হয়! পরবর্তিতে প্রকৃতির কাছাকাছি এই বাইরের শ্রেনীকক্ষে পাঠরত শিশুদের উপর গবেষণায় দেখা গেছে- বাইরের ক্লাশে পড়ানোর পর তারা তাদের বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষায় বেশী নম্বর পাচ্ছে! শিশুরা বাইরের ক্লাশে থাকতে বেশী পছন্দ করে, সেখানে তারা অনেক বেশী মনোযোগী হতে পারে, পড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় বহুগুন। স্কুলের শিক্ষকদের মতে, ক্লাশরুমের চেয়ে বাইরের ক্লাশে শিক্ষকরা পড়াতে বেশী সচ্ছন্দ বোধ করেন, নানান রকম পদ্ধতি প্রয়োগ করে খেলাচ্ছলে শিক্ষা দেয়া যায়, শিশুরা ক্লাশে অনেক বেশী অংশগ্রহণ করে। ক্লাশরুমের ভীড়ে, গ্রীষ্মের গরমে অতিষ্ঠ হওয়া অপর্যাপ্ত আলোতে ঠিকমতো বই বা ব্ল্যাকবোর্ড দেখতে না পাওয়া শিশুরা তাদের বাইরের ক্লাশে খোলা হাওয়ায় -স্পষ্ট দিবালোকে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে সক্রিয় ভাবে ক্লাশের পড়ায় অংশগ্রহণ করে বেশী শিখছে ও পরীক্ষায় বেশী নম্বর পাচ্ছে! এ শ্রেণীকক্ষ নির্মাণের নানাকাজে শিশুদের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের মধ্যে একটা মালিকানাবোধ তৈরী করে যার ফলে এই জায়গার পড়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বেশী, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ওরা নিজেরা-ই নেয়!

উল্লিখিত বাইরের ক্লাসরুমে শিশুদের ক্লাশ করার আর মিলিত হওয়ার জায়গা স্কুল দিতে পারলে, বাংলাদেশের স্কুলগুলো শিশুদের জন্যে হয়ে উঠবে আক্ষরিক অর্থেই মজার এক জায়গা। যেখানে যাওয়ার জন্যে ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে, যেখানে বাচ্চারা খেলতে খেলতে শিখবে, প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে শান্ত আর সবুজ হয়ে উঠবে এক এক শিশু। প্রাথমিক স্কুল থেকে আর ছাত্রছাত্রীরা ঝরে পড়বে না।
শিশুরা তো তাদের জায়গায় ঠিক আছে, মন দিয়ে পড়াশোনা করছে- তাদের সেই পড়া-শোনার জন্যে উপযোগী পরিবেশ তৈরী করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করে দিয়ে শিশুদের সুশিক্ষার পথ সুগম করতে কি আমরা এগিয়ে আসবো না?


শিশুরা শ্রেণীকক্ষ তৈরীর কাযে সাহায্য করছে


বাইরের ক্লাশে বিজ্ঞান পড়ছে শিশুরা


শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড


শিশুদের সাথে......



[আমার এই লেখাটি কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয় প্রথম আলোতে তাদের প্রতিবেদকের একটা রিপোর্টসহ! পুরো লেখাটি ছাপা হয় নি, কিছুটা ছাঁটা হয়েছে শেষের দিকে, ব্লগের সবার সাথে পুরো লেখাটা শেয়ার করলাম!]

ই-পেপার লিঙ্ক Click This Link
আমার লেখার লিঙ্ক Click This Link
প্রথম আলো প্রতিবেদকের রিপোর্ট Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৫:০০
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×