কথায় আছে, কারো সর্বনাশ তো কারো পৌষ মাস। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে আসলে ঘটলও তাই। ঘটনাটি নিয়ে সৌদি রাজ পরিবার অনেক লুকোচুরি খেলেও শেষ পর্যন্ত পার না পেয়ে যখন এক এক করে হত্যার সবকিছুই স্বীকার করতে শুরু করল, ঠিক তখনি আমেরিকার কিছু ঘটনা যেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এলো।
আমেরিকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে প্যাকেট বোমা পাঠানোর ঘটনা গত কয়েকদিন ধরে সে দেশের পত্র-পত্রিকা এবং রাজনৈতিক মহলকে যেভাবে ব্যস্ত রাখছে তাতে সৌদি রাজ পরিবার কিছুটা হলেও তাদের রোষ থেকে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পেল।
তুরস্কের সরকারি-গোয়েন্দা আর পশ্চিমা রাজনৈতিক-মিডিয়ার ক্রমাগত চাপে সৌদি আরব শেষ পর্যন্ত শিকার করতে বাধ্য হলো যে খাশোগিকে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের ইস্তাম্বুল কনস্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে।
গত সপ্তাহের এই স্বীকারোক্তির পরেও সৌদি রাজ পরিবার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার যে সন্দেহের তীর যুবরাজ বিন সালমানের দিকে ছিল তা থেকে সালমানকে বাঁচানোর উপায় খুঁজতেছিল।
খাশোগিকে হত্যার ঘটনা সারা বিশ্বে এমন সমালোচনার ঝড় তুলল যা থেকে পার পাওয়ার জন্য সৌদির দরকার ছিল আরও বড় চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা যা খাশোগি হত্যা ঘটনাকে ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করবে এবং সবার দৃষ্টি ওইদিকে নিয়ে যাবে।
অনেক প্রতীক্ষার সেই মোক্ষম সময় এলো গত পরশুদিন যখন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো, সিএনএন টেলিভিশন থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ডাকের মাধ্যমে বোমা পাঠানোর ঘটনা ঘটল।
খাশোগি ঘটনাকে ছাড়িয়ে প্যাকেট বোমার এই ঘটনাটি আমেরিকা এবং ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের প্রধান শিরোনামে আসতে থাকল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প - যিনি শুরু থেকেই সৌদি রাজ পরিবারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে আসছেন - এই প্যাকেট বোমের ঘটনাকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন।
যাইহোক, আমেরিয়াকান মিডিয়া যখন প্যাকেট বোমের ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত তখন সৌদি রাজ পরিবার খাশোগির ছেলে এবং পরিবারকে বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সুযোগ করে দিল।
অন্যদিকে যুবরাজ বিন সালমান তার তুর্কিবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে তুরস্কের সঙ্গে ঐক্য বজায় রেখে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন।
বিন সালমান বলেন, 'একটা চক্র খাশোগি হত্যাকে ইস্যু করে সৌদি আরব ও তুরস্কের সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যত দিন আমি বিন সালমান, বাদশা সালমান এবং তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোগান বেঁচে থাকবেন তত দিন এই সম্পর্ক অটুট থাকবে।'
তার এই ঘোষণার পরে সৌদি আরবের প্রধান কৌশলীর অফিস স্বীকার করে যে জামাল খাশোগির হত্যা ছিল পূর্বপরিকল্পিত।
ঘটনার তদন্তের জন্য রাজতন্ত্রের প্রধান কৌঁসুলি তুরস্কে আসছেন। এদিকে তুরস্কের পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থা এখনো খাশোগির লাশ খুঁজছে।
এক্ষেত্রে কনস্যুলেট ভবনের বাগানের কুয়ার মধ্যে লাশ পাওয়া গেছে বলে যে গুজব ছড়িয়েছে তাও সত্য নয়। কনস্যুলেট ভবন, কনস্যুলেটের গাড়ি-বাড়িসহ যত জায়গা পুলিশ খুঁজছে কোথাও এখনো পর্যন্ত খাশোগির লাশ পাওয়া যায়নি।
খাশোগির লাশ পাওয়া গেছে বলে পত্রপত্রিকায় যেসব সংবাদ বেরিয়েছে তুরস্কের পুলিশ সেগুলোকে ভিত্তিহীন বলছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রপতি অবশ্য বলছেন, যে সৌদি যেহেতু খাশোগি হত্যার বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে সেহেতু লাশ খুঁজে বের করার দায়িত্বও তাদের।
তিনি আরও বলেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী খাশোগির লাশ স্থানীয় কোনো ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেহেতু সৌদির উচিত সেই স্থানীয় সহযোগীর নাম প্রকাশ করা।
তুরস্ক এখন জোর দিয়ে বলছে যে দোষীদের বিচার ইস্তাম্বুলেই করতে হবে। আর এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত যাদের সৌদি সরকার গ্রেফতার করেছে তাদেরকেও তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
এরদোগান অবশ্য হুশিয়ারি করে দিয়েছেন যে, খাশোগি হত্যার আরও তথ্যপ্রমাণ তাদের কাছে আছে যেগুলো "সঠিক সময়ে এলেই" প্রকাশ করে দেয়া হবে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
লেখক: সারওয়ার আলম, ডেপুটি চিফ রিপোর্টার-নিউজ পাবলিশার, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:১৭