২০১৮ সালটি ছিল তুরস্কের পর্যটন শিল্পের জন্য এক নতুন রেকর্ড ছোঁয়ার বছর। গতবছর প্রায় ৪ কোটির বেশি বিদেশি পর্যটক তুরস্ক ভ্রমণ করেন। তুরস্কে ভ্রমণপিয়াসুরা মূলত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি দর্শন, সমুদ্র সৈকতে বা পাহাড়ের গায়ে অবসর কাটানো ও চিকিৎসা নিতে এদেশে আসেন।
চুল প্রতিস্থাপনে তুরস্ক ইউরোপের শীর্ষে আর বিশ্বে তিন নম্বর অবস্থানে আছে। ইস্তানবুলের কোনো কোনো এলাকায় হাঁটলে প্রায় প্রতি ৫০-১০০ মিটারে একাধিক হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট বা এস্টেটিক সেন্টার চোখে পড়বে।
হেলথ ট্যুরিজম বা স্বাস্থ্য পর্যটনে তুরস্ক বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় একটি দেশ। তুরস্কের থার্মাল হেলথ এন্ড ট্যুরিজম এসোসিয়েশনের প্রধান ইয়াভুজ ইলিকের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশটিতে প্রায় ১০ লাখ বিদেশী পর্যটক শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সেবা নেয়ার জন্য আসে। স্বাস্থ্য পর্যটনের অনেকগুলো বিভাগের একটি হলো মাথার টাক সমস্যার সমাধান বা চুল প্রতিস্থাপন বা হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট।
চুল প্রতিস্থাপনে তুরস্ক ইউরোপের শীর্ষে আর বিশ্বে তিন নম্বর অবস্থানে আছে। ইস্তানবুলের কোনো কোনো এলাকায় হাঁটলে প্রায় প্রতি ৫০-১০০ মিটারে একাধিক হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট বা এস্টেটিক সেন্টার চোখে পড়বে।
বিদেশিরা কেন হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করতে তুরস্ক আসে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইস্তানবুলের মেজিদিয়েকোয় এবং বাশাকশেহিরে কথা হয় মাথায় চুল লাগাতে আসা কয়েকজনের সাথে।
কাতারের ইয়াসির হোসাইন আল হাসান তাদেরই একজন। তিনি যখন ইস্তান্বুলে আসেন তখন তুরস্কের চুল প্রতিস্থাপন সেক্টরের পরিধি সম্পর্কে তার সামান্যই ধারণা ছিল।
২৪ বছরের এই যুবক তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের পরামর্শে পারি জমান ইস্তানবুলে।
মাথায় টাক নিয়ে তিনি অনেক দিন ধরেই অস্বস্থিতে ভুগছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে, বন্ধুবান্ধবের মাঝে সবসময় একটা অস্বস্থিতে থাকতেন তিনি। নিজেকে কেমন বেমানান মনে হতো সবার মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। কিছুদিনের মধ্যেই গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটা চাকরি নিবেন, পরে বিয়ে। অনেক পরিকল্পনা, স্বপ্ন, ভাবনা। কিন্তু সবকিছুর শেষে এসে এই টাক মাথাটাই যেন সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় তাকে।
পরে এক আত্মীয়ের পরামর্শে একটা চুল প্রতিস্থাপন কোম্পানির সাথে যোগাযোগ হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
তার ইস্তানবুলের এয়ারপোর্টে নামার পর থেকেই ওখানে অভ্যর্থনা, গাড়ি করে হোটেলে নিয়ে যাওয়া, সেখান থেকে ডাক্তারের ক্লিনিকে যাওয়া-আসাসহ সব কাজই কোম্পানি অতি যত্নের সঙ্গে সম্পন্ন করেছে।
ক্লিনিকের অপারেশন টেবিলে শুয়ে যখন তিনি আমার সাথে কথা বলেন তখন অনেকটাই সন্তুষ্ট মনে হয়েছে তাকে।
'আমি ইস্তান্বুলের চুল প্রতিস্থাপন নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। এবার আমার নিজেরই অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত আমি যে সেবা পেয়েছি, সেটা ভিআইপি সেবার মতোই মনে হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট।'
কথা বলার সময় একজন নার্স আর দু জন টেকনিশিয়ান একাগ্রচিত্তে তার মাথায় চুল প্রতিস্থাপন করছিলেন।
'একজন ডাক্তার আর তার তিনজন সহযোগী একত্রে কাজ করলে চার থেকে পাঁচ ঘন্টার মধ্যে একটা মাথার চুল প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব,' -বলছিলেন লিউ হেলথ (LiwHelath) -এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল কাফী।
বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কাফী তুরস্কে প্রথম আসেন পড়ালেখার উদ্দেশ্যে। অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি করে এখন একটা উনিভার্সিটিতে চাকরি করছেন। ইউনিভার্সিটির বাইরে পুরো সময়টা দেন LiwHelath-এ।
ড. আব্দুল্লাহ আল কাফী বলেন, ‘আমরা লিউ হেলথ কন্সালটেন্সি হিসেবে একজন রোগীর তুর্কিতে পা রাখার পর থেকে শুরু করে ট্রিটমেন্ট নিয়ে তুর্কি ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ সেবা প্রদান করি।’
কাফী তার কয়েকজন তুর্কি বন্ধুর সঙ্গে কোম্পানিটি পরিচালনা করছেন। LiwHelath ইস্তানবুলের নব শহরায়ণের প্রাণ কেন্দ্র বাশাকশেহিরে অবস্থিত। ইস্তানবুলের নতুন এয়ারপোর্ট থেকে সবচেয়ে কাছের নগর এলাকা এটি।
ডা. মেলিকে জানান কোকসুজ LiwHelath-এর একজন হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট স্পেশালিস্ট।
তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, বিদেশিরা কেন তুর্কিতে আসে টাক সমস্যার সমাধানে?
'সাশ্রয়ী মূল্য এবং উন্নত মানের চিকিৎসা,' তিনি উত্তর দিলেন।
তার মতে, তুরস্কের হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট স্পেশালিস্টরা অনেক বেশি অভিজ্ঞ। কারণ তাদের প্রচুর হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করতে হয়।
ডা. মেলিকে জানান কোকসুজ তার ১৯ বছরের প্রফেশনাল জীবনে প্রায় ৫ হাজারের উপরে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করেছেন।
'আমাদের কাজ হলো হাতের কাজ, অভিজ্ঞতার কাজ। আপনি যত বেশি কাজ করবেন তত বেশি অভিজ্ঞ হবেন।'
তিনি বলেন, 'টাক সমস্যা সমাধানে আমাদের সফলতা প্রায় শতভাগ। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় রেফারেন্স।'
তার বেশিরভাগ রোগী আসে আরব দেশগুলো এবং ইউরোপ থেকে। তবে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এমনকি চীন, জাপান থেকেও অনেকেই টাক সারাতে আসেন। ইউরোপের চেয়ে প্রায় ৫ ভাগ কম মূল্যে তুর্কিতে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়।
LiwHelath-এর হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার ঘুরিয়ে দেখালেন ড. কাফী এবং ডা. কোকসুজ। চমৎকার সাজানো গোছানে একটা অভ্যর্থনা কেন্দ্র। দুজন তুর্কি নারী কাজ করছে। সোফায় বসে আছে একজন রোগী এবং কয়েকজন দর্শনার্থী। তাদেরকে চা দিচ্ছেন কেউ একজন।
অপারেশন রুমগুলোতেও আছে একই ধরণের ছিমছাম, পরিচ্ছন্নতা এবং সাজানো গোছানো সরঞ্জাম। এক রুমে তিনজন নার্স এক মহিলার মাথায় ছোটোখাটো সার্জারি করছেন। আরেক রুমে তিনজন মহিলা একজন পুরুষের মাথায় সযত্নে চুল বসিয়ে যাচ্ছেন।
FUT এবং FUE প্রযুক্তি
ডা. কোকসুজ জানান, তুর্কিতে প্রায় সব হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টারেই FUE প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
চুল প্রতিস্থাপনের দুটি প্রধান পদ্ধতি হল FUT এবং FUE। এগুলির মধ্যে শুধুমাত্র তফাৎ হলো কীভাবে চুল তোলা হচ্ছে, কীভাবে এই চুল আবার রোপন বা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।
আধুনি পদ্ধতি FUE-তে ১মিমি বা তারও ছোট একটা ড্রিল ব্যবহার করে সাবধানতার সঙ্গে ১ থেকে ৪টি চুল রয়েছে এমন পৃথক চুল গুচ্ছ তোলা হয়। এই পদ্ধতিতে মাথার পিছনের দিকে বা অন্য যেখানে চুল আছে সেই ডোনার এরিয়া বা দাতা এলাকাতে কোনো স্থায়ী দাগ দেখা যায় না এবং দাতা এলাকার চুলের ঘনত্বের কোনো পরিবর্তনও নজরে আসে না। রোপন পদ্ধতিও ওই একই রকম।
চুল প্রতিস্থাপনের মৌলিক পদ্ধতিটা হলো একটা ছোট ছিদ্র করে তার মধ্যে চুল গুচ্ছকে ঢুকিয়ে দেওয়া। ছিদ্রটা করা হয় একটা ছোট স্কালপেল বা সূঁচ দিয়ে।
LA বা লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া করেই উভয় প্রক্রিয়া করা হয়। FUE-র একটা বড় সুবিধা হলো অস্ত্রোপচার-পরবর্তী পর্যায়ে এটা খুব কমই যন্ত্রণাদায়ক এবং এতে কোনো ক্ষতচিহ্ন থাকে না। এর একটা অসুবিধা হলো, এর জন্য অনেক বেশি সময়ের দরকার পড়ে।
অন্যদিকে FUT পদ্ধতিতে রোগীর মাথায় একটা সেলাই পড়ে যা থেকে কয়েক মাস যাবৎ এমনকি ক্ষত সেরে গেলেও একটা অস্বস্তি থেকে যায়। নতুন চুল আর দাতা এলাকার মধ্যে একটা স্থায়ী দাগ পড়ে।
টাক সমস্যা সমাধানে একমাত্র শর্ত
FUE-তে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০০ চুল গুচ্ছ (অর্থাৎ প্রায় ৪০০০ চুল) বসানো হয়, যেখানে FUT-এ একদিনেই ২০০০ পর্যন্ত চুল গুচ্ছ (গ্র্যাফ্ট) বসানো যায়। সাধারণত একদিনের একটা সেশন প্রায় ৫-৬ ঘন্টা ধরে হয়। কোনো সমস্যা ছাড়াই যদিও এর মাঝেই লাঞ্চ, টয়লেট, ব্রেক নেওয়া যায়। সেসন শেষ হওয়ার পরে রোগী বাড়ি চলে যেতে পারেন। পরবর্তীতে ডাক্তাররা রোগীর সঙ্গে ইন্টারনেটে যোগাযোগ করে চুল গজানোর ধাপ গুলো পর্যবেক্ষণ করেন।
ড. কাফী বলেন, তারা শুধু চুল প্রতিস্থাপনই না দাড়ি প্রতিস্থাপনও করেন। ‘তবে চুল বা দাড়ি যেটাই প্রতিস্থাপন করতে চাইবেন অবশ্যই আপনার মাথার পেছনে বা কোনো এক অংশে সামান্য হলেও চুল বা দাড়ি হাতে হবে। পুরোপুরি টাক মাথা বা যার সামান্য পরিমান দাড়িও নেই তার চুল বা দাড়ি প্রতিস্থাপন অসম্ভব।’
বিদেশ থেকে রোগীরা তাদের সাথে https://liwhealth.com/ ওয়েবসাইটের উপর থেকে যোগাযোগ করে। হোয়াটস্যাপ বা ইমেইলের মাধ্যমেও যোগাযোগ করতে পারে।
তার মতে তুর্কিতে আসার আগে অবশ্যই সব কিছু ভালো ভাবে খোঁজখবর নিয়ে আসা উচিত। কম খরচ দেখলেই সেখানে না গিয়ে বরং উন্নত মান এবং সর্বোচ্চ সেবা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, ‘চুল প্রতিস্থাপনে বিদেশ থেকে কোনো রোগী আসলে সর্বমোট দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সব প্রসেস সম্পন্ন করা হয়।’
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ১০:১৬