ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে কাজ করতে যেয়ে এরশাদ এবং তার জাতীয় পার্টির গুরুত্বটা আমি হারে হারে বুঝি। নিউজ তৈরির সময় খুঁজতে বসি- এরশাদ কিংবা তার দলের কোন খবর আছে কি-না। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এই দলটি তো তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ দল নয়, তাহলে কেন এদের খবর পেতে এত উদগ্রীব থাকি? এমন প্রশ্ন একদিন করলেন এক সহকর্মী।
বললাম, বাজার চলতি বাংলা বা হিন্দি চলচ্চিত্র দেখেন? দেখবেন মুভিটি যত সিরিয়াসই হোক না কেন, মাঝে কয়েক মিনিটের একটা কৌতুক দৃশ্য থাকে। কিছু কমেডিয়ান আছে, তারা সেখানে বেশ সক্রিয় থাকেন। সিরিয়াস ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে একটা হাস্য-কৌতুক দর্শকদের কিছুটা রিলিফ দেয়। আমাদের দেশের অভাব অনটন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, গণতন্ত্রিক সংকট, প্রশাসনিক জটিলতার মত মন ভার করা খবরের মধ্যে এরশাদ ও তার দলের কাজকর্ম কিছুটা হলেও দর্শকদের জন্য বিনোদনের খোরাক দেয়। এরশাদ আর জাতীয় পার্টি- সব মিলিয়ে একটা টোটাল বিনোদন। বিনোদনের একটা প্যাকেজ।
এরশাদ সকালে বলেন এক কথা, বিকালে আর এক কথা। এই তো বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বললেন- তিনি নির্বাচনে অংশ নিবেন না। তার উপর চাপ প্রয়োগ করা হলে, তার বিছানায় বালিশের নিচে লোডেড পিস্তল আছে, তিনি আত্মহত্যা করবেন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে গেছে, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, শপথও নিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দলের চেয়ারম্যান হিসাবে উপহার পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত’র পদটি। ধারণা করা যায় তার ওই বিছানা, বালিশ, লোডেড পিস্তল সবই আছে বহাল তবিয়তে। আত্মহত্যা আর করা হয়নি। বিছানা, বালিশ ব্যবহৃত হচ্ছে অন্য কাজে। আর নিজে মন্ত্রীর পদমর্যাদার দূতের পদটি উপভোগ করছেন তড়িয়ে তড়িয়ে। উপভোগ না করলে, নিশ্চয়ই এতদিনে এই অপমানজনক অবস্থান থেকে পদত্যাগ করতে চাইতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। করতে যে চেয়েছেন, তেমনও শুনিনি।
বিশ্ব রাজনীতিতে এরশাদের জাতীয় পার্টি এক বিস্ময়কর নাম। পার্লামেন্টে এরা প্রধান বিরোধী দল। এই প্রধান বিরোধী দল তারা কিভাবে হয়েছে, সেটা অবশ্য অন্য বিতর্ক। সে আলোচনায় এখন যাচ্ছি না। বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও কেবিনেটে রয়েছে এদের তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। এই দলের চেয়ারম্যানও খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। মন্ত্রীর পদমর্যাদার এই বিশেষ দূত আবার মাঝে মধ্যেই প্রকাশ্য সভায় সরকারের সমালোচনা করেন। বলেন, এই সরকার নাকি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে, দেশের মানুষ মোটেই ভালো নেই, উন্নয়ন হচ্ছে না। দেশের মানুষ এখন তার দল জাতীয় পার্টিকে চায়, ইত্যাদি। সব মিলিয়ে দারুন এক নাটকই বটে। তবে নাটক হলেও অতটা পাকা নয় এর স্ক্রিপ্ট। বরং অনেকটা যাত্রা’র মতো আনাড়ি হাতের বলেই মনে হয়। সম্ভবত সে কারণেই জাতীয় পার্টিকে ব্যঙ্গ করে অনেকে যাত্রা পার্টিও বলে থাকে।
জাতীয় পার্টির এবারের নাটকটা শুরু হয়েছে রংপুর থেকে। গত রবিবার সেখানে পার্টি চেয়ারম্যান হঠাৎ করেই তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন। সেই সঙ্গে বললেন যে, তার অবর্তমানে জিএম কাদেরই হবেন পার্টির কর্ণধার, তিনি ধরবেন দলের হাল। তার এই ঘোষণা নিয়েই যত বিপত্তি। জাতীয় পার্টি এরশাদের দল। উনি এর চেয়ারম্যান। শুরু থেকেই তিনি চেয়ারম্যান। দলটির একটা গঠনতন্ত্র আছে, দল কিভাবে চলবে, কার কতটা এখতিয়ার- সেসব লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু সেসব থোড়াই কেয়ার করেন এরশাদ। যা ইচ্ছা তাই করেন, যা ইচ্ছা তাই বলেন। নিজেই বলেন, আজীবন তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান থাকবেন। বলেন- তিনিই জাতীয় পার্টি, তার সিদ্ধান্তই জাতীয় পার্টির সিদ্ধান্ত।
তবে এবার যারা তার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিবাদ করার জন্য তারা গঠনতন্ত্রের কথা বলেছেন। বলেছেন, গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যানের পদটি নেই। এরকম একটা নিয়োগ এরশাদ একা একা দিতে পারেন না। তার উচিৎ ছিল প্রেসিডিয়ামের মিটিং করে তাদের মতামত নিয়ে এটি করা। এই প্রতিবাদকারীদের মধ্যে রয়েছেন দলের সেই সময়ের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, তাজুল ইসলামসহ আরও বেশ কয়েকজন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এরশাদের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছেন যারা তারা সবাই সংসদ সদস্য। আওয়ামী লীগের বিশেষ বদান্যতায় তারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কোথাও কোথাও নির্বাচিত হয়েছেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। সেসব জায়গায় সরকারী দল আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী পর্যন্ত ছিলো না। মোট কথা রীতিমত ছাড় দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদেরকে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য বানিয়েছে।
আর বিপরীত দিকে এরশাদের এই ঘোষণার পক্ষে যারা শুরুতে ছিলেন, সেখানে এরশাদ নিজে এবং নতুন মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার ছাড়া আর কোন সংসদ সদস্য নেই। ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে এরশাদের আহ্বানে যারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন, করে হয়তো হা-হুতাশ করেছেন, তাদেরই ভিড় দেখা যাচ্ছে এখানে।
দুই ধারার এই বিভাজনটাই আসলে স্পষ্ট করে দেয় কার কি উদ্দেশ্য। একপক্ষ লটারীর মত ভাগ্যগুণে কিছু পেয়ে গেছেন, জীবনে যা ভাবেননি সেই মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। এখন তারা এরশাদের কথা শুনে সেটা হারাতে চাইবেন কেন? যে প্রক্রিয়ায় এবার হয়েছেন, তার পুণরাবৃত্তি যে হাজার বছরেও আবার হবে, তেমন আশাও নিশ্চয়ই তারা করেন না। তাই কোনভাবে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চান পাঁচটি বছর। আর বিপরীত দিকে, বঞ্চিতের দল। উদাহরণ হিসাবে জিএম কাদেরের কথাই ধরা যাক। বিগত আওয়ামী লীগের জোট সরকারে তিনি মন্ত্রী ছিলেন। কেবল ভাইয়ের কথা মানতে যেয়ে এবার তার আর ক্ষমতার অংশ লাভ সম্ভব হলো না। অথচ এরশাদের স্ত্রী রওশনের মতো তিনিও যদি এরশাদের কথা না শুনতেন, তাহলে হয়তো আজ তিনিও মন্ত্রী থাকতেন আওয়ামী লীগের দয়ায়।
এই বিভাজনের গণিত থেকে এতটুকু স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্ষমতার ভাগ পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টিই সবকিছুর প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি পেয়ে একদল সেটা ছাড়তে চাচ্ছে না, আর একদল সেই হালুয়া-রুটি না পাওয়ার বেদনায় নীল হচ্ছে।
আর এরশাদ বা রওশন? একটু বড় মাপের হলেও এদেরও মূল কথা কিন্তু ওই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব নিকাশই। প্রথমে বরং রওশনের কথা বলা যাক। উনি এখন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। রওশন এরশাদের মত মহিলা এই দেশের জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা। পুরো জাতির জন্য এ এক নির্মম পরিহাস। উনি কতটা যোগ্য- সে বিতর্কে না যেয়েও এতটুকু বলা যায়, উনি নিজেও কখনো কল্পনা করেননি যে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি কোন দিন বসতে পারেন। এই ভদ্রমহিলার মধ্যে লোভ বিষয়টা আগেও বহুবার দেখা গেছে। ফলে মুফতে পাওয়া বিরোধীদলীয় নেতার পদ তিনি কেন ছাড়তে চাইবেন?
এবার তাকানো যাক এরশাদের দিকে। ইনি কেন হঠাৎ এমন কঠোর পদক্ষেপ নিতে গেলেন? আসলে এখানেও রয়েছে স্বার্থ। নিতান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থ। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে গত বুধবার (২০ জানুয়ারি ২০১৬) তার বক্তব্যে। দলীয় কার্যালয়ে নেতা কর্মীদের কাছে তিনি তার অন্তিম ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, তার কিছুই চাওয়া পাওয়ার নাই, তিনি কেবল চান তার মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর মত তারও যেন জন্মদিন এবং মৃত্যুদিবস পালিত হয়। আসলে এটাই তিনি চান। তিনি হয়তো এতদিনে বুঝতে পেরে থাকবেন, বঙ্গবন্ধুর তিনি হতে পারবেন না। পারবেন না তো কি হয়েছে, আশা করতে তো দোষ নেই। যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু’র সঙ্গে মিলিয়ে “পল্লীবন্ধু” নামটি পর্যন্ত সংগ্রহ করেছিলেন। অর্থাৎ চেষ্টা একেবারে কম করেননি। ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেধেছিলেন এই আশা নিয়ে যে, সরকার গঠন করলে মহাজোট তাকে হয়তো প্রেসিডেন্ট বানাবে। সেই রকম একটা চুক্তিও নাকি হয়েছিল। তিনি তার এই আকাঙ্ক্ষার কথা গোপনও রাখেননি। বরং প্রকাশ্যেই বলেছেন। পুরো মেয়াদের জন্য না হোক, অল্প সময়ের জন্যও যেন তাকে একবার প্রেসিডেন্ট বানানো হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা তার এই আশা পূরণ করেননি। বরং আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি বানালো জিল্লুর রহমানকে। জিল্লুর রহমান তখনই বেশ অসুস্থ ছিলেন। তাই তিনি মারা গেলে হয়তো আওয়ামী লীগ তাকে রাষ্ট্রপতি বানাতে পারে- এমন আকাঙ্ক্ষার কথাও প্রকাশ করতেও কুণ্ঠিত হননি এরশাদ। শেখ হাসিনা তার সে আশাও পূরণ করেননি। রাষ্ট্রপতি থাকতে থাকতেই মারা গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমান। তখনও শিকে ছিড়েনি এরশাদের ভাগ্যে। রাষ্ট্রপতি হয়েছেন আবদুল হামিদ। আবারও হতাশ এরশাদ। এরপর এলো ২০১৪ সালের বহু বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এবার অবশ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনেকটাই বিদ্রোহীর মত আচরণ করেছেন এরশাদ। আসলে তিনি হয়তো তখন ভেবেছেন, তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশ আওয়ামী লীগ কখনোই মিটাবে না। তাই শেষ মুহূর্তে ডিগবাজী মেরে চেষ্টা করেছেন আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে। আর এতেই ভাগ্য খুলে গেছে তার ঘরের বউ রওশনের। দুর্বিনীত স্বামীকে পদানত করে তিনি বনে গেছেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। স্ত্রীর নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদকে বসতে হয়েছে পার্লামেন্টে।
কিন্তু একদা স্বৈরাচারী যে সবসময়ই স্বৈরাচারী, সুযোগ পেলেই স্বৈরাচারী, সেটা আবারও প্রমাণ করলেন এই সামরিক শাসক। জিএম কাদেরকে যারা চেনেন, তারা স্বীকার করবেন, দলটির মধ্যে এই লোকটিই যা কিছু সেন্সেবল, লজিক্যাল। এরশাদ যদি তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নির্বাচন করতে চান, তাহলে অবধারিতভাবেই জিএম কাদেরের নাম চলে আসবে। কেবল নিজের ভাই বলেই নয়, যোগ্যতার বিবেচনাতেও সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু এই যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয় কাজটি করতে যেয়েও এরশাদ ঠিক তার সেই স্বৈরাচারী আচরণটিই করলেন। কারও সঙ্গে কথা না বলে, একা একাই হঠাৎ করে তাকে কো-চেয়ারম্যান করে দিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এই কো-চেয়ারম্যানের কাজটা কি? এই পদটি কি জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে আছে? ঠিক এই প্রশ্নটিই করেছিলেন আনিস-বাবলু-তাজুলরা। না, নেই। এই পদটির কোন অস্তিত্ব পার্টির গঠনতন্ত্রে নেই। নেই তো কি হয়েছে? এরশাদ বললেন- আগামী কাউন্সিলে এই পদটি তৈরি করা হবে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে, তোমরা ঘর করতে থাকো, সন্তানাদিও উৎপাদন করতে থাকো, যখন কাজী পাওয়া যাবে বিয়ে পড়িয়ে নেবো!
গত কয়েকদিনে এরশাদ সাহেব যেসব কথা বলেছেন, তার দিকে তাকালে বেশ কৌতুকই অনুভূত হয়। তিনি বললেন- তিনি জীবিত থাকতে কেউ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হতে পারবে না (তাহলে ওয়ান ইলেভেনের সময় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ কি হয়েছিলেন?), হাওলাদারকে মহাসচিব করার এই সিদ্ধান্ত তার মৃত্যু পর্যন্ত পরিবর্তন হবে না (এই একই কথা বলেছিলেন তিনি বাবলুকে মহাসচিব করার পরও, তার মৃত্যু হয়নি কিন্তু মহাসচিব পাল্টে গেছে), জাতীয় পার্টির তিনিই সব তার কথা মতই সব হয় এখানে (২০১৪ এর নির্বাচনে তিনি বলেছিলেন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে। তার স্ত্রী, তার মহাসচিব হাওলাদারসহ অনেকেই তার কথা শোনেননি। তারা এখনও বহাল তবিয়তে এই পার্টিতেই আছেন), ইত্যাদি। আসলে এরশাদকে সকলে এখন একটা হাস্যরসের উপাদান হিসাবেই বিবেচনা করে। কিন্তু যতই হাস্যকর আর অযৌক্তিক কথা বলুন না কেন, তবুও এটাই তো বাস্তবতা যে উনিই জাতীয় পার্টির প্রধান। পার্টির স্বৈরাচারী চেয়ারম্যান। উনি যা চাইবেন, তাই হবে পার্টিতে। তবে উনি কখন কি চাইবেন, কখন আবার নিজের কথা থেকেই ডিগবাজি মারবেন, এটা কেউই বলতে পারেন না।
বুধবার (২০ জানুয়ারি) নতুন আর একটা ইচ্ছার কথা এরশাদ সাহেব। বললেন, জাতীয় পার্টি এবার প্রকৃত বিরোধীদল হিসাবে আচরণ করতে চায়। এটা তারা পারবেন কি পারবেন না, সেটা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এই কথার মাধ্যমে এতটুকু তিনি ঠিকই বলে দিয়েছেন যে, জাতীয় পার্টি এখন “প্রকৃত বিরোধী দল” নয়। তাহলে কি? তাহলে কি সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি বিরোধীদল? অথবা সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী দল? নিজেদের এই অবস্থান নিয়ে হয়তো রওশন, আনিস, বাবলু, তাজুল, রাঙ্গাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু এই তথ্য কি খোদ সরকারের জন্যই কিছুটা বিব্রতকর নয়? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে কোন মাপের নির্বাচন হয়েছে, দেশে বর্তমানে কতটা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র আছে, জাতীয় সংসদের বিরোধীদল কতটা অনুগত বা গৃহপালিত- এই সবই কি পরিষ্কার হয়ে যায় না?
আর এই যে প্রকৃত বিরোধী দল হওয়ার খায়েশ, সেটাকেই বা কতটুকু আন্তরিক বলা যাবে? প্রকৃত বিরোধী দল হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান বিরোধটি কি? সেটি হচ্ছে সরকারের কেবিনেটে জাতীয় পার্টির তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, আর মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসাবে এরশাদের সগর্ব অবস্থান। আচ্ছা না হয় মানলাম, মন্ত্রী হয়ে যাওয়ায় ওই তিনজন এরশাদের কথা শুনছেন না, কিন্তু এরশাদ নিজে কেন বিশেষ দূতের পদ থেকে বের হয়ে আসছেন না? নিজে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসাবে বহাল থাকবেন, আর মুখে বলবেন তিনি প্রকৃত বিরোধী দল, মানবে মানুষ?
মানুষ মানুক বা না-ই মানুক, তাতে তার কি-ই বা আসে যায়। স্বৈরাচারী প্রধান বৈশিষ্ট্য তো এটাই। তাকে নিয়ে, তার কর্মকাণ্ড নিয়ে কে কি বললো, তাতে তার কোন কিছুই আসে যায় না। স্বৈরাচারী কাজ করে নিজের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। গত দুই বছরের কর্মকাণ্ড দেখার পর একথা তো আর কাউকে বলে দেয়ার দরকার পড়ে না যে, “বিশেষ দূত” পদটি আসলে কিছুই না। দুধ-ভাত টাইপের। এই যে “প্রকৃত বিরোধী দল” হবো বলে হুঙ্কার, এটাও আসলে ওই না পাওয়ার বেদনা থেকেই উৎসারিত। উনি যেন সরকারকে বলতে চাইছেন- আমাকে কিছু একটা দাও, কাঠি লজেন্স ধরিয়ে দিয়ে আর কয়দিন?
এখন কি দেয়, সেটাই দেখার বিষয়। এরশাদ কি হালুয়া-রুটির ভাগ পাবেন নাকি কাঠি লজেন্স চুষতে চুষতে কাটাবেন জীবনের বাকি দিনগুলো?