বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের পাঁচ হাতের মধ্যে আমি কখনো যাই না, সব সময় সেটা থেকে কমপক্ষে পাঁচ হাত দূরে থাকি৷ হুমায়ূন ভক্তরা স্টলটা এমনভাবে ঘিরে থাকে যে ভিড় ঠেলে এর বেশি কাছে যাওয়া সম্ভব হয় না৷ আর হুমায়ূন আহমেদ যদি স্টলে থাকেন তাহলে তো হাত পঞ্চাশের মধ্যেই যাওয়া যায় না৷ দূর থেকে স্টলটা দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়৷ একবার এক বন্ধুপত্নী বইমেলায় হুমায়ূনের একটা বই আমার হাতে দিয়ে বললো, “হুমায়ূন আহমেদের একটা অটোগ্রাফ এনে দিতে পারবে?”
আমি বললাম, “পাগলে কামড়েছে নাকি?”
“কেনো পাগলে না কামড়ালে হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ আনা যাওয়া যায় না?”
“যায়৷ সে ক্ষেত্রে নিজেকেই পাগল হতে হয়৷”
বন্ধুপত্নী হাসতে লাগলো৷ বাস্তবিক পাগলে না কামড়ালে বা নিজে পাগল না হলে যুদ্ধ করে হুমায়ূনের অটোগ্রাফ আনতে যায় নাকি কেউ? যায় নিশ্চয়৷ অটোগ্রাফ শিকারীরা অটোগ্রাফের জন্য অনেক কিছু করতে পারে৷
আজকেও অন্যপ্রকাশের স্টলের ধারে কাছে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিলো না৷ বাস্তবিক স্টলটার কথা আমার মনেই ছিলো না৷ বইমেলার মাইকে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হুমায়ূনের বইয়ের নাম শুনে মনে পড়লো- আহহা, আমার তো হুমায়ূনের একটা বই কেনার কথা!
মনে পড়তেই মেজাজটা একটু বিলা হয়ে গেলো৷ আজ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের কোনো বই কিনিনি৷ পণ করেছিলাম কোনোদিন কিনবো না৷ পণটা কি এবার ভাঙতে হবে?
হুমায়ূন ভক্ত পাঠক, এ পর্যন্ত পড়েই চোখ কুচকে ভাববেন না যে আরেক আঁতেল এসেছে, এখনই বলবে যে হুমায়ূনের বই হচ্ছে রাবিশ মাল, কেনার যোগ্য না৷
না, আমি সেটা বলবো না৷ হুমায়ূনের বই কেমন সেটা নিয়ে আমি কিছু বলতে যাচ্ছি না৷ আমি হুমায়ূনের বই কিনিনা তার কারণ ভিন্ন৷
প্রথম ঢাকায় আসার পর কিছুদিন হা বই হা বই করে ঘুরে বেড়ালাম৷ বাইরে থাকতে পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বই এনে পড়া যেতো৷ ঢাকায় সবেধন নীলমনি মার্কা একটা পাবলিক লাইব্রেরী আছে বটে, কিন্তু সেটা আমার বাসা থেকে অনেক দূরে আর সে বেটারা বাসায় বই নিতে দেয় না৷ সে লাইব্রেরীর সময়ও বিচিত্র, যেতে আসতেই লাইব্রেরী বন্ধ হয়ে যায়, দু দন্ড বসে পড়ার সময় পাওয়া যায় না৷ আর লাইব্রেরীর কাঠের চেয়ারে বসে কোমর ব্যাথা করে বই পড়ে কোন পাগলে? বই পড়তে হয় আরাম করে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে৷ অন্য কোনো লাইব্রেরীও চিনি না যারা বাসায় বই আনতে দেয়৷ তো কি করি৷ শুরু করলাম আশেপাশের মানুষদের বাসায় ধরণা দেয়া৷ যার কাছে হাত পাতি সেই দেখি হুমায়ূনের দু-চারটা বই বের করে দেয়৷ এই করতে করতে এক সময় দেখলাম না কিনেই হুমায়ূনের বেশিরভাগ বই পড়ে ফেলেছি৷ তখন ভাবলাম যাক, এই জীবনে আর হুমায়ূনের বই কিনবো না৷
কিন্তু প্রতিজ্ঞাটা আজ ভাঙতে হলো৷ হুমায়ূন নিউ ইয়র্কে বসে কি লিখেছেন সেটা পড়ার খায়েশ হয়েছে এক জনের৷ আর সে খায়েশ সে আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে৷ বইটা আমাকে কিনে তাকে গিফট করতে হবে৷ মানুষের খায়েশ দেখে মরে যাই!
মন মেজাজ খারাপ করে ভিড় ঠেলে অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে হাজির হলাম৷ স্টলের লোকগুলো এতই ব্যস্ত যে ওরা কোনোদিকে তাকাতেই পারছে না, সবাই মিলে চোখ বুঁজে রয়েছে৷ চুপিসারে নিউ ইয়র্কি বই একটা হাতে নিয়ে বললাম- “নিলাম৷”
ওরা চোখ না খুলেই বললো, “নেন গা৷ ঐ বাক্সে দেড়শো টাকা ফেলায় দিয়ে যাইয়েন৷”
হাহ, হায়রে গিফট!