আমার পাশে বিরাট ভাব লয়ে দাঁড়ায়ে থাকা লোকটারে দেখেন, ক্লাইভ তার নাম। পুরা নাম রবার্ট ক্লাইভ।
এই জায়গাটা হলো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। মানে রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ। রানি ভিক্টোরিয়ার আরেক পরিচিতি ছিল- তিনি ছিলেন ভারতসম্রাজ্ঞী। অথচ আপনারা সকলেই জানেন, রানি ভিক্টোরিয়া ভারতে থাকতেন না। তিনি থাকতেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওই পারে। এই ক্লাইভ নামে লোকটাই ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করিয়েছিল।
রবার্ট ক্লাইভ নামক এই লোকটার আরও আরও পরিচয় আছে। যেমন এই লোক ছিল পলাশীর প্রথম ব্যারন। মানে হলো পলাশীর প্রথম দালাল। আরেকটা পরিচয় হলো, এই লোকের নেতৃত্বে আমাদের সাড়ে সর্বনাশ হয়েছিল। ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদল বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যদলকে পরাজিত করছিল।
তবে ক্লাইভ যে এইখানে মূর্তি হয়ে দাঁড়ায়ে আছে, এইটা তার বিজয় না। বস্তুত এইটাই তার পরাজয়। ক্লাইভের এই মূর্তিই তার ব্যারন বা দালাল হওয়ার গৌরব নামক ব্যর্থতা আমাদেরকে দেখায়ে দিতেছে। ওইখানে যাওয়ার পথে ট্যাক্সি ড্রাইভার দেখি মহাত্মা গান্ধীর ওপরেও বিরাট রাগ। দেশভাগের রাগ এইটা। গান্ধী চাইলে এই দেশভাগ রুখে দিতে পারতেন। কিন্তু দেন নাই। তিনি এইখানে জিন্নাহ আর গান্ধীরে ব্লেন্ডিং মেশিনে ফেলে সুইচ টিপে চালু করে দিলেন। জিন্নাহ তো বিরাট খবিস লোক। তারে আমি দেখতে পারি না। আজকে ভারতের এক ট্যাক্সি ড্রাইভার যখন গান্ধী ও জিন্নাহকে এইভাবে ব্লেন্ড করে দেন- আমার তখন বিস্ময় হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এইসব থাকুক। পরে হবে এইসব আলাপ সালাপ।
এখন ব্রিটিশরা নাই। ১৯৪৭ থেকেই নাই। কিন্তু এই ক্লাইভের উত্তরপুরুষরাই ‘দেশভাগ’ সমীকরণের নামে ভারতবর্ষের বারোটা বাজায়ে দিয়ে চলে গেছে। বারোটা একের ঘড়ির কাঁটা আমাদেরকে পূর্ব পাকিস্তান বানালো। এরপর সাড়ে বারোতে এসে আমরা বাংলাদেশ হয়ে গেলাম ঠিকই- কিন্তু আমরা ভারত থেকে মুক্ত কি হতে পারলাম? ভারত কি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ায়ে নাই?
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের ভেতরে ঢুকে দেখি দেয়ালে লিখে রাখছে- ফ্রি গাইড পাওয়া যাবে। আমি গেলাম সিকিউরিটি লোকের কাছে। সিকিউরিটি লোকে তখন একটা টুলে বসে আরেক লোকের সঙ্গে তুমুল আড্ডা পিটাইতেছে। আমি প্রমিত ভাষায় বলি, ও দাদা, এখানে নাকি ফ্রি গাইড পাওয়া যায়? কোথায় সেই ফ্রি গাইড? আমার লাগবে।
তখন সিকিউরিটির সঙ্গে আড্ডা মারতে থাকা লোকে বলে, বলুন কি জানতে চান?
আমি বলি, গাইড কি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে এখানকার সকল কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন আমার সঙ্গে, বলে হাঁটতে শুরু করে দিল লোকটা।
আমি বলি, ও আপনিই গাইড? শুনুন, এখানে প্রথমবার এসেছি তো, জানি না কিছু। না জানাটা জানতে চাই।
এরপর আমরা হাঁটতে থাকি আর তিনি বলতে থাকেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের ডিজাইন যে বেলফাস্ট সিটি হলের আদলেই যে বানানো- সেইটা জানান।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল দেখতে হুবহু বেলফাস্ট সিটি হলের মতো, এইটা আমার জানা। আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট সিটি হল হলো বেলফাস্ট সিটি কাউন্সিলের পৌরভবন। বেলফাস্ট সিটি হল বানাতে শুরু করছিল ১৮৯৮ সালে, বানায়ে শেষ করল ১৯০৬ সালে। আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল বানাতে শুরু করল ওই বছরেই, ১৯০৬ সালে। বেলফাস্ট তখন গরম গরম তো, হয়ত সেকারণেই তার ডিজাইন ইংরেজ লোকেদের ওপরে প্রভাব বিস্তার করছিল। কিন্তু বেলফাস্ট সিটি হল আয়ারল্যান্ডের লোকেরা আট বছরে বানায়ে ফেললেও ভারতীয় লোকেদের লাগল পনের বছর। অবশ্য বাংলাদেশের লোকেরা বানাতে গেলে তিন চার দশক লেগে যাবে। আমাদের বাংলাদেশী ভাইয়েরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাজ করছেন বাইশ বছর ধরে। এই কাজের পেছনে এখন পর্যন্ত খরচ হয়ে গেছে প্রায় ২৬৩ কোটি টাকা। কাজ কবে শেষ হবে কেউ জানে না। ২৬৫ কোটি টাকা খরচের কথা আছে যদিও কিন্তু কথা কি রাখে কেউ? বলেন?
তো রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যেই বানায়ে ফেলা হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল বা ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধর কাজ শেষ হয় ১৯২১ সালে।
চিন্তা করেন, সাত সমুদ্র তের নদীর ওই পারে রানি মরে গেলেন আর এই পারে তার স্মৃতির নামে বিশাল ভবন বানায়ে ফেলা হলো! কত বিশাল জানেন? ৬৪ একর জায়গা জুড়ে। আরও মজা কি জানেন? স্মৃতি সৌধ বানাতে লর্ড কার্জন ভারতীয় রাজা, জমিদার, ধনী-অভিজাত ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীদেরকে দান করতে বলছিলেন। এইটা আসলে আসলে ভাইসরয়ের আদেশ ছিল। তো এই আদেশ মানবে না। শুরুতে লর্ড কার্জন নাকি তাজমহলরে টেক্কা দিতে এইটাও শ্বেতপাথরে বানাবার কথা ভাবছিলেন।
রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে এই রকমের বিশাল ভবন মেমোরিয়াল শুধু কোলকাতাতেই আছে। লন্ডনে বাকিংহাম প্যালেসের সামনে যেইটা আছে ওইটা শুধু ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল’। তবে ওইটা সৌধ না, স্তম্ভ।
এগুলা অবশ্য গাইড লোকে এইসব কথাবার্তা বলেন নাই। তবে তিনি এইটার খরচাপাতি জানালেন, বললেন, সেই সময় এই স্মৃতি সৌধ তৈরি করতে খরচ পড়েছিল ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা। এরপর খালি নিচতলাটা তিনি ঘুরায়ে দেখালেন। একটা ঘরে বিশাল একটা পেইন্টিং দেখা গেল। তিনি জানালেন, এইটা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পেইন্টিং। ১৮৭৬ সালে আঁকা। আকৃতি হলো ২৩ ফুট উঁচু আর ১৮ ফুট চওড়া। এই পেইন্টিংটা আমেরিকা থেকে কিনে ফেলে এনে রানি ভিক্টোরিয়াকে উপহার দিয়েছিলেন জয়পুরের মহারাজ।
ছবির বিষয় হলো, ১৮৭৬ সালে ওয়েলসের রাজপুত্রের সঙ্গে হাতির ওপরে সওয়ার হয়েছিলেন জয়পুরের মহারাজা রাম সিংহ। তাঁদের নিয়ে বেরিয়েছিল বিশাল শোভাযাত্রা। এই জিনিসই এঁকে ফেলেছিলেন রাশিয়ার এক শিল্পী। ছবির নাম নাম, ‘জয়পুর প্রসেশন’। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো শিল্পীর নামটা এখন আমার মনে নাই, ভুলে গেছি। আপনারা জানেনই, আমারও একটা ডিমনেশিয়া আছে। শিল্পীর নাম ভুলে গেছি বলে আমি সোরি।
রাশিয়ার আঁকিয়ে লোকে এই ছবি এঁকে ফেলার পর ছবিটা আমেরিকায় ছিল। ১৯০৫ সালে জয়পুরের মহারাজ ছবিটা কিনে ফেলে এনে উপহার দেন রানি ভিক্টোরিয়াকে। অথচ দেখেন, রানি কিন্তু মরে গেছেন ১৯০১ সালে! দালাল কি লর্ড ক্লাইভ একলা? মোটেও না। কি সাদা কি কালা আর কি বাদামী- সকল রঙেই এরম দালাল ঝাঁকে ঝাঁকে আছে। থাকবেও। এই এখনকার কথাই ভাবেন- কি ঢাকা, কি কোলকাতা, দালালের কি অভাব কোনো?
সেদিন কোলকাতার লেখক বন্ধু ও শ্রদ্ধাজন একটা ছবি দিলেন। কোলকাতার রাস্তায় কেউ একটা ব্যানার টানিয়ে দিয়েছে, ব্যানারে ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে শিরোনাম লেখা 'ফেমাস বেঙ্গলি লিজেন্ডস'। নিচে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল অবধি আছেন। এবং সবশেষের ছবিটি পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন, ঠিক না?
১৮৫৭ সালের নভেম্বরে রানি ভিক্টোরিয়া একটা ঘোষণা বলে দিছিলেন। ওই সময়ের বাংলা কাগজ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা রানির ঘোষণা ছেপেছিল। রানি বলেছেন, ‘যে সকল লোক গবর্নমেন্টের বিপক্ষ হইয়া অস্ত্রধারণ করিয়াছে, যদি তাহারা আপন আপন গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া স্ব স্ব বৈষয়িক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হয়… অপরাধ একেবারে মার্জ্জনা করা যাইবেক।’
বলে দেওয়ার দরকার নাই যে রানির এই ঘোষণাটা ছিল স্বাধীনতার জন্যে যারা বিপ্লব করছিলেন- তাদের উদ্দেশ্য।
অথচ দেখেন, এই রানিরই স্মৃতিসৌধ ঘরের দেয়ালে দেয়ালে " গবর্নমেন্টের বিপক্ষ হইয়া অস্ত্রধারণ" করা লোকেদের ছবি আর ইতিহাসে সয়লাব হয়ে আছে। সেখানে আছে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুটের খবর আর আমাদের মাস্টারদা সূর্যসেন, আছেন তাঁর সহযোগী প্রীতিলতা, আছে জনসম্মুখে বিপ্লবীদের গুলি করে মেরে ফেলার ছবি। আছে বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা স্বামী বিবেকানন্দ, ভারত মাতা, আর বন্দে মাতরমের দলিলের সঙ্গে নানান করুণ ইতিহাস।
মোটকথা দোতলার পুরোটাই দখল করে আছে রানি ভিক্টোরিয়ার "গবর্নমেন্টের বিপক্ষ হইয়া অস্ত্রধারণ করিয়াছে" যাহারা, তাহারাই। আমার কৌতূহলী মন জানতে চায়, রানির আত্মা কি এইসব দেখিতে পাইতেছে? কিন্তু জানার কোনো উপায় নাই।
এই গল্প বিরাট লম্বা করা যেতেই পারে। এখন আর লম্বা করতে ইচ্ছা করতেছে না। অবলোকন করতে আসছি- অবলোকনই করি। বিতর্ক ভাল্লাগে না।
________________________________________
নিচে কয়েকটা ছবি দেওয়া হলো। দুয়েকটা ছবিতে আমার উপস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়ার অনুরোধ থাকল।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৪৩