হেমন্তের সকালের নরম, মিষ্টি রোদে পিঠ দিয়ে ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে মৃন্ময়ী। তার কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া ঘন কালো কোকড়া চুল গুলো সবার কাছেই ঈর্ষণীয়। প্রথম প্রথম মৃন্ময়ী ভেবে পেত না তার চুল বা রূপ নিয়ে কেন আসপাশের বাড়ীর গৃহিণীরা এত ঈর্ষা করে! মানুষ ঈর্ষা করতে পারে কারো ভালো কাজ নিয়ে বা গুণ নিয়ে, চুল বা রূপ নিয়ে কেন! আস্তে আস্তে বুঝতে পারে এখানকার সহজ সরল পুরোদস্তুুর গেরস্থ বাড়ীর বউ-ঝি'দের জানার গন্ডি সীমিত, সাংসারিক সামান্য কিছু ব্যাপার ছাড়া তারা তেমন কিছু নিয়ে ভাবতে পারেনা। তাদের এই ঘরের বাইরেও যে আরো জগত আছে, ভাবনার অনেক বিষয় আছে, করার অনেক কিছু আছে সেটা তারা ভাবতেই পারে না। এই মুহুর্তে মৃন্ময়ী যেমন ভাবছে অতনুর সাথে তার পরিচয়ের সূত্র নিয়ে। আজ থেকে ২৩ বছর আগে আজকের এই দিনে তাদের বিয়ে হয়েছিল। পরিচয়ের সূত্রটা কর্মক্ষেত্রের মাধ্যমে হলেও পরিণয়টা পারিবারিক ভাবেই হয়। সিলেটের মণিপুরী নীল জমিনে সাদা পাড়ের শাড়ী, ডান পাশে বড় ফিতার ব্যাগ ঝুলানো, ডানহাতে কালো চামড়ার বেল্টের ঘড়ি , বাম হাতে চিকন মুখ খোলা একটি বালা, বড় বড় চোখ চোখ জোড়ায় মোটা কাজল ছাড়া আর কোন প্রসাধনের বাহুল্য নেই মুখে; এই ছিল কর্মক্ষেত্রে যোগদানের প্রথম দিনের মৃন্ময়ী। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যায় অতনু, যাকে বলে প্রথম দেখাতেই প্রেম! কিন্তু অতনু একটা ব্যাপার কখনোই মুখে স্বীকার করে না সেটা হচ্ছে নতুন যোগদান করা শিক্ষিকাকে অতনুর মনে হয় দুনিয়ার সবচাইতে মুডী এবং রাগী। এই ভাবনাটাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো হয়ে থেকে যেতো যদি না ছাত্রীদের সাথে ক্লাসের মৃন্ময়ীকে দেখতো।
সহকর্মী হিসেবে পরিচয়, আস্তে আস্তে টুকটাক কথা থেকে পরিণয়। দুজনেই অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেউ কখনো অনধিকার চর্চা করেনি তাদের এই দীর্ঘ তেইশ বছরের দাম্পত্য জীবনে। মনোমালিন্য, দ্বন্দ্ব যে একেবারে যে হয়নি কখনো তা নয়। তবে সেটা সামাল দেবার ক্ষমতাও দু'জনে রাখে। যেমন বিয়ের আগে তারা পরস্পর পরস্পরকে জানায় তাদের দু'জনের-ই অতীত রয়েছে। অতনু আরো কিছু শেয়ার করতে চেয়েছে মৃন্ময়ীর কাছে তবে মৃন্ময়ী তাতে বাধা দিয়েছে। মৃন্ময়ীর ধারনা প্রতিটি মানুষের-ই কিছু বিষয় থাকে যা একান্ত-ই তার নিজের। প্রত্যেকের নিজস্ব একটি জগত থাকে যেখানে আর কারো প্রবেশের অনুমতি থাকতে নেই। নিজেরা-ই একটি চুক্তিতে আসে। ঠিক করে যদি বেঁচে তাদের পঁচিশ তম বিবাহ বার্ষিকীতে তাদের এই জগতটা সম্পর্কে, এই অতীত সম্পর্কে উভয়ে উভয়কে জানাবে! সবার কাছে অদ্ভুত শোনালেও তারা উভয়েই মেনে নেয় এই শর্ত। তাইতো এই তেইশ বছরে প্রতি বছর একটি বিশেষ দিনে মৃন্ময়ীকে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া নীল রংয়ের একটি তাঁতের শাড়ী কালো ব্লাউজের সাথে পড়তে দেখেও এর কারন জানতে পারেনি অতনু যেমনি ভাবে মৃন্ময়ী জানতে পারেনি অতনুর বিশেষ বিশেষ দিনে পড়া অতি যত্নে রাখা কালো চামড়ার বেল্টের ঘড়ির ইতিহাস!
মৃন্ময়ীর শাড়ীর খুব শখ। তার বিয়ের আগের নিজের কেনা সব শাড়ীর ইতিহাস বললেও একটি কালো জমিনে সোনালী জরির বুটি আর ম্যাজেন্টা পাড়ের বেনারসী শাড়ীটির ইতিহাস কখনো বলেনি। শাড়ীটির নাকি জোড়া রয়েছে, ঠিক একই নকশার কেবল রং ভিন্ন। একই সাথে অর্ডার দিয়ে এক জোড়ায় বানানো হয়েছিল। এটার ইতিহাসও নীল শাড়ীর ইতিহাসের সাথেই বলবে মৃন্ময়ী। যেমনি ভাবে অতনু বলবে সাদা রাজশাহী সিল্কের উপর নীল বাটিক করা পান্ঞ্জাবীটির কথা যেটি পুরনো হয়ে হলদেটে হয়ে গেছে।
বাড়ীর পাশের খাল পার হয়ে দিগন্ত জুড়ে কেবল ফসলের মাঠ। মাঠের ওপারে নীল আকাশে চোখ মেলে ভাবনার অতলে হারিয়ে যায় মৃন্ময়ী। আর দু'টি বছর। তার পরেই এত দিনের গোপন কথা প্রকাশ করবে দু'জন দুজ'নার কাছে। ওর ভয় হয় মাঝে মাঝে অতনু কী বলবে ওকে? সহ্য করতে পারবে তো? যদি না পারে....না না কী সব ছেলে মানুষের মত ভাবছে ও! এসব বয়স অনেক আগেই ওদের পার হয়ে গেছে। এত বছরের ভালবাসা, বিশ্বাসকে পুরনো, জীর্ণ অতীত কখনই নড়বড়ে করে দিতে পারবেনা। পর মুহুর্তেই ভাবে অতনু কী ভাবে নেবে যখন শুনবে ওর অসম একটি সম্পর্ক ছিল? ও কীভাবে বলবে যে তাঁতের নীল শাড়ীটি ওর একসময়ের চার বছরের ছোট বন্ধু উপলের দেওয়া? ভার্সিটিতে থাকতে কোন এক বর্ষায় উপল উপহার দিয়েছিল নীল শাড়িটি। কেন জমানো টাকা দিয়ে শাড়ী কিনে দিয়েছে তাই নিয়ে একচোট ঝগড়া করে নিয়েছিল ও। কীভাবেই বা বলবে যে কালো শাড়ীটির জোড়া বেগুনী একটি শাড়ী রয়েছে যেটি উপলের বউকে দিয়েছিল ওদের বিয়েতে। ধবধবে ফর্সা বউয়ের জন্যে বেছে ছিল বেগুনী রংয়ের শাড়ী আর শোকের বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ নিজের জন্যে নিয়েছিল কালো রংয়ের শাড়িটি!
বয়সে মৃন্ময়ী বড় হলেও দু'জনের সম্পর্ক ছিল তুই-তোকারী বন্ধুত্বের। বন্ধুত্বের মাঝে কখন যে সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে গিয়েছিল সেটা বুঝতে পারেনি মৃন্ময়ী। বুঝেছিল উপল যেদিন তার হবু বউ পুষ্প'র সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। উপল কাউকে বিয়ে করবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু খবরটায় মৃন্ময়ীর কেন এরকম লেগেছিল সেটা আজো অজানা। সে কি তাহলে ভালবাসে উপলকে? "না না অসম্ভব...এটা হতেই পারেনা", পরক্ষণেই নিজেই নিজেকে বলে। তাহলে উপলের প্রতি এই অনুভুতিটার সংজ্ঞা কী?
থাক না হয় সম্পর্কটা অসংজ্ঞায়িত। " ছোট বেলায় কিছু সরল অংক করতো যার সমাধান হতো না, তেমনি জীবনে কিছু সম্পর্ক থাকে, কিছু ব্যাপার থাকে যার সংজ্ঞা হয় না, ব্যাখ্যা হয় না। এটা না হয় সেরকম-ই কিছু"....মৃন্ম..য়ী..... ভাবনায় ছেদ পরে অতনুর ডাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫১