"একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না"- আমরা কম বেশি প্রায় সবাই এই কথাটির সাথে পরিচিত। দুর্ঘটনা যে কেবল সড়ক পথেই হবে এমনটি তো নয়। যে কোন জায়গায় যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে। আবার ক্ষয়-ক্ষতির তীব্রতা বুঝে সেখান থেকে উঠেও আসতে হবে আমাদের তাই না? ব্যাপারটা এমন হল আপনি ছোট খাটো কোন দুর্ঘটনায় পতিত হলেন, সেখান থেকে উঠে আসার পথ না খুজে হাউ মাউ কাউ করে কান্না কাটি করতেই থাকলেন.... করতেই থাকলেন....করতেই...এটি কি খুব একটা ভাল দেখায় বলেন? মোটেও না।
যা বলছিলাম দুর্ঘটনার স্থান, কাল ভেদে রকমফের আছে। আজ আমি রান্না ঘরের দুর্ঘটনা নিয়ে আলাপ করবো এবং সেটা থেকে কিভাবে কিভাবে উতরেও যাওয়া যায় সেই রেসিপিও দেব।

আমি নিজেকে একজন আনাড়ী রন্ধনশিল্পী বলে দাবী করি, আমার সমালোচক বন্ধুগণ যদিও আমার রান্নার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রাখেন তবুও আমি তো দমে যাবার পাত্রী নই।


আমার সব চাইতে পছন্দের খাবারের তালিকায় একদম প্রথম দিকের একটি হচ্ছে কেক! আমি মন চাইলো কাঁটা চামচ দিয়ে একটা ডিম ঘুটে-টুটে এক খাবলা আটা , একটু চিনি দিয়ে চুলায় বসিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যে মজা করে কেক বানিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি। টং দোকান থেকে ব্রান্ড শপ যে কোন জায়গায় কেক দেখলেই আমার হৃদমাঝারে ভালবাসার সানাই বাজে! তো যাই হোক বাসায় আম্মা ডায়াবেটিস, ভাইয়া কেক তেমন পছন্দ করে না আবার নিজেরও ভাল লাগেনা বানাতে এসব মিলিয়ে অনেক দিন কেক বানানো হয় না। মাঝে একদিন কেকের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় প্রায় কিনতে গিয়েও কিনিনি, কারন তখন ঠান্ডা, সর্দিতে নাকে কোন প্রকার ঘ্রান পাচ্ছিলাম না, ঐসময়ে কেক খাওয়া আর চিনি খাওয়া সমান। গত কাল মেসেন্জ্ঞারে এক বান্ধবী তার নিজের বানানো কেকের ছবি দিলে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ইউটিউব ঘেটে-ঘুটে বের করলাম প্রথমে ক্রিম বানানোর রেসিপি। আগে কখনো বানাইনি "সুইস মেরিন্জ বাটার ক্রিম", ভাবলাম এটাই চেষ্টা করি। প্রথম স্টেপেই করে ফেললাম গড়বড়! ডিম চিনিতে কোন ভাবে পানি ঢুকে গেল! পানিতো ডিমে পড়ল না পড়ল আমার ইজ্জতের উপর! আমার মাথায় এল না যে এটা সাইডে রেখে দিই কেক বানানোর জন্যে, ক্রিমের জন্যে আবার নিই। এটা মাথায় এলে তো আর একটা দুর্ঘটনা ঘটত না, আর আপনারাও এই পোস্ট পেতেন না! সব-ই উপরওয়ালার ইচ্ছা, আমরা তো উছিলা মাত্র।

যাই হোক আমি চিন্তা করলাম বাটার দিয়ে যেহেতু বিট করবো পানিতে সমস্যা করবে না, পানি একসময় আলাদা হয়ে যাবে। এটা যে অন্য জিনিস, এবং একদম-ই নতুন আমার কাছে সেটা আমার মাথায় একবারের জন্যেও আসেনি! ১০০ গ্রাম বাটার শেষ করার পরে যখন বাটার আর ক্রিম হয় না তখন মাথায় হাত! দুর্ঘটনার ষোল কলা পূর্ণ করলাম নিজ হাতে!
পাঠক দূর্ঘটনা যা ঘটে গেছে তাতো গেছেই। এখন আমি যদি হাউ মাউ কাউ করে কান্নাকাটি করি তাহলে কি লাভ হবে? আমার তরল বাটার আবার আগের মত জমে আলাদা হয়ে যাবে অথবা পানিটা ডিম থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে যাবে? যাবে না। বরং এখন আমাকে ভাবতে হবে কী করে এই অবস্থা থেকে আমাকে উতরে যেতে হবে কেবল গেলেই হবে না মান-ইজ্জত সব আমার সাথে করে নিয়েই বের হতে হবে। কী করি আজ ভেবে না পাই...ভাবতে ভাবতে সেই মিশ্রনে কিছু আইসিং সুগার, এক কাপ আটা, এক চা চামচ বেকিং পাউডার আর কয়েক ফোঁটা লেমন ফ্লেভার দিয়ে ঘেটে ঘুটে এক মোল্ডে ঢেলে দিলাম ঢুকিয়ে ওভেনে। এবার হয়েছে আরেক জ্বালা। অনেক দিন ওভেন ব্যাবহার না করায় কোনটা বেকিং মোড আর কোনটা বয়েল আর কোনটা গ্রিল সেটা ভুলে গেছি ! ম্যানুয়াল টা খুজে পেলাম না! মডেল লিখে নেটে সার্চ দিয়েও পেলাম না। যাক, সব-ই কপাল। কথায় আছে না "কপালের নাম গোপাল, যেইখানেই যাও না কেন সঙ্গে যাবে কপাল" অথবা "যেথায় মন চায় হেথায় যাও, কপাল ছেড়ে কোথায় যাও!"
বানাতে চেয়েছিলাম 'সুইস মেরিন্জ বাটার ক্রিম' বানিয়ে ফেললাম 'বাটার কেক' ।
কেক দেখতে কোন প্রকার বদখত হয়নি, অনেকটাই পাউন্ড কেকের মত হয়েছে। স্বাদও মোটামুটি খারাপ হয়নি। সন্ধ্যায় সেই কেক খেয়ে রেখে দিলাম বাকিগুলো বাটিতে ঢেকে। সকালে পাউরুটি ভেজে সেই তাওয়ায় কেকের টুকরো গুলো অল্প আঁচে রেখে দিলাম। এবার হয়ে গেল ড্রাই কেক। খেতে দোকানেরটার থেকে কোন অংশে কম নয়।

আমার মিষ্টি সমালোচক বন্ধুগণ, আপনারাই বলুন একজন রন্ধন শিল্পী (হোক না সে আনাড়ী) না হলে কী তার পক্ষে সম্ভব দুর্ঘটনা কবলিত 'সুইস মেরিন্জ বাটার ক্রিম'কে অনলি 'বাটার কেক'-এ রুপান্তর করা, এবং সেটাকে আবার ড্রাই কেকে রুপ দেওয়া? বিচারের ভার আপনাদের তথা জাতির বিবেকের উপর ছেড়ে দিলাম।

তবে কথা হচ্ছে সব সময় যে ইজ্জতের সাথেই উতরে যেতে পারবেন সব দুর্ঘটনা থেকে এমনটি কিন্তু নয়। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমানের উপর নির্ভর করবে উতরে যাওয়াটা। এমনও দুর্ঘটনা আছে যা কেউ টের পাওয়ার আগেই সব ঠিক ঠাক করে ভাল মানুষটি সেজে বসে থাকতে হয়। সুতরাং আমি আপনাকে একটা রেসিপি দিলাম, এটাকে মডেল ধরে আরো অনেক অনেক ফিউশন আপনি নিজেই করতে পারবেন।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৫৩