মেয়েটির জন্ম ছিল অনাকাঙ্খিত। অনাদর আর অবহেলায় বড় হতে হতে কিভাবে সময়ের সাথে ঠিক বুঝে নিয়েছিল পরিবারে নিজের অবস্থানটি। দিনমজুর বাবা যা আ্য় করে তা নেশা আর জুয়ার পেছেনেই শেষ করে । মায়ের আঁচল ধরে রোজ মিঞাঁ বাড়িতে যায় শিউলি। মা সেখানে গিন্নী মা'র কাজ করে আর ও দূর থেকে উঠোনে বসে মিঞাঁ সাহাবের পড়ানো দেখে। কোন কোনদিন সাহস সঞ্চয় করে একটু কাছে গিয়ে বসে এই আশায় যে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া শুনতে পারবে ভালো করে। সুর করে করে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া বা মিঞাঁ সাহেবের গল্প শুনতে ওর খুব ভালো লাগে। দিনের এই সময়টি ওর সবচাইতে ভালো লাগে। এভাবেই ওর পড়ার হাতে খড়ি। ঠিক হাতে খড়ি না বলে মুখে খড়িই বলা যায় এটাকে। ওর যা শেখা তা শুনে শুনেই। নিজ হাতে কখনো বই-খাতা ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি শিউলির।
একদিন শীতের সকালে মিঞাঁ সাহেব পড়ানো শেষে গল্পের মাঝে কে কে কী হতে চায় জিজ্ঞেস করলে কোন কিছু না বুঝেই শিউলি দূর থেকে হাত তুলে বলে সে উড়োজাহাজ চালাবে। ওর কথা শুনে সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। হাট থেকে একদিন মুড়ালি কিনে খেতে খেতে বাড়ী ফিরছিল। তৈয়্যব চাচা মুড়ালি দিয়েছিল যেই কাগজে মুড়ে সেটা ফেলতে গিয়ে দেখে সাদা শার্ট পরা এক মেয়ে একটা উড়োজাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর আবার একটা কালো চশমা। পড়তে না পারলেও ঠিকই বুঝতে পেরেছিল পেছনের উড়োজাহাজটি এই মেয়েটিই চালায়। সেদিন থেকেই ওর মনে হয়েছে যদি এরকম একটি উড়োজাহাজ চালাতে পারত তবে মা'কে নিয়ে অনেক দূরে চলে যেতো যেখানে সে আর মা থাকবে।
মিঞাঁ সাহেব শিউলিকে কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, "উড়োজাহাজ চালিয়ে কোথায় যাবি রে তুই? চটপট করে কোন জড়তা ছাড়াই ছোট্ট শিউলি উ্ত্তর দিয়েছিল, "অনেক দূরে, যেইহানে বাজান আমারে আর মা'রে খুঁইজা পাইবোনা, মারতেও পারবো না মায়রে" ।
মিয়া সাহেবের মনে পড়ল আব্বাসের কথা যে অনিয়মিত ভাবে দিন মজুরী করে আর নিয়মিত বাইরে নেশা করে, জুয়াখেলা আর বাড়ীতে বউ-মেয়েকে পেটায়। শিউলিকে কাছে ডেকে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন আমি চেষ্টা করব তোর ভাগ্য ফেরাতে বাকীটা উপরওয়ালার ইচ্ছা।
ছাত্র-ছাত্রীদের ছুটি দিয়ে ভাবতে থাকেন বিষয়টি নিয়ে।
গিন্নীর সাথে পরামর্শ করে শিউলিকে ভর্তি করিয়ে দেন গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে। পরের কয়েকটি বছর কেটে যায় শিউলির স্বপ্নের মত করে। অদম্য আগ্রহ এবং পরিশ্রমে প্রতি বছর ভালো ফলাফল করে একেকটি ক্লাস শেষ করে শিউলি। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি শিউলির সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথকে করে আরো গতিশীল। কিন্তু জীবন ত মসৃণ হয়না. কোন না কোন একটি পর্যায়ে গিয়ে তা বাঁক নেয়, এবড়োখেবড়ো পথে গিয়ে পরে। শিউলির ও সেরকম ই হয় মিঁঞা সাহেব এর মৃত্যুতে। অনেক দিন অসুস্থ ছিলেন তিনি। এর মাঝেই এইচএসসি পাশ করলে শিউলিকে ঢাকায় পাঠিয়ে ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি করানোর কথা চলছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে সব সব বদলে যায়। তাঁর ছেলে মেয়ের মাঝে ভাগ হয়ে যায় সম্পত্তি। কেউ শিউলির ফ্লাইং স্কুলে ভর্তির পক্ষে মত দেয় না। তবে শিউলি ততদিকে বুঝে গিয়েছে এযাবত সে যা পেয়েছে তা বেশিই পেয়েছে। তাই জেলা শহরেই অনার্সে ভর্তি হবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বলার সাহস বা দুঃসাহস কোনটিই সে দেখায় নি। মা রয়ে যায় গ্রামে গিন্নীমা'র দেখা শোনার জন্যে আর সে চলে যায় জেলা শহরে।
জীবনের বাস্তবতায় শিউলি কখনো ভাবেনা তার স্বপ্ন ভেংগে গেছে বরং স্বপ্ন যে বিভিন্ন রকম হতে পারে তা মিঁঞা সাহেব এর মৃত্যু তাকে শিখিয়েছে। সে কৃতজ্ঞ আপা এবং ভাইজান তথা মিঁঞা সাহেব এর দুই ছেলে-মেয়ের কাছে, তার পড়া বন্ধ না করে এই সুযোগ দেওয়ার জন্যে।
বিমান চালিয়ে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও ঠিকই উড়ে বেড়াত শিউলি। ওড়া তার বন্ধ হয়নি, উড়ে বেড়াতো স্বপ্নের জগতে; যে জগতকে বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু শিউলিদের বেশি স্বপ্ন দেখতে হয় না । সামনে যতই এগিয়ে যাক পিঁছুটান একটি থেকেই যায়, মিঁঞা বাড়ীতে বড় হলেও সে যে সেই বাড়ীর আশ্রিতা, সে যে মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা জুয়াড়ী আব্বাসের মেয়ে। তার তো এতদূর আসার ই কথা নয়!
শিউলি যখন বুঝতে পেরেছে বিমানে ওড়ার স্বপ্নের পর তার নিজের পাখায় ওড়ার স্বপ্নও স্বপ্নই থাকবে, সে তখন চেয়েছিল তার ডানা দুটোকে বাক্স বন্দী করতে নিজ হাতে। চেয়েছিল তার ডানা দুটো কেউ কেটে বা ভেংগে নেবে না বরং কাউকে সাথে নিয়ে নিজে তার ভালোবাসায় লালন করা ডানা দুটি যত্নে বাক্সবন্দী করতে। সেটাও হয়নি। দুমড়ে ভেংগে ফেলার মানুষের অভাব ছিল না।
নিজের স্বপ্নকে ছোট করতে করতে এটুকুই চেয়েছিল কেবল যে তার ডানা দু'টো বাক্সবন্দী করার সময় কেউ পাশে থাকবে, চোখের জলটুকু মাটিতে পড়ার আগে সে মুছে দেবে, আর কিছুই না।
শিউলিরা ঝড়ে যায় অল্প সময়েই, । শিউলিরা মলিন হয়ে যায় ভোরের আলো ফোটার পরেই। বড়জোর ভোরের আলো টুকু দেখার স্বপ্ন দেখতে পারে কিন্তু পুরো দিন আশা করতে পারে না। শিউলিরা হয় ক্ষণস্থায়ী! ক্ষণজন্মা!
*********************************
দশ বছর! এক দশক! ভাবতেই অবাক লাগে এতটা সময় ধরে আছি এই ব্লগে। কত মান অভিমান, পাওয়া না পাওয়া কত স্মৃতি জড়িত এই ব্লগে। আমি লিখতে পারি না তবুও একটা শখ ছিল লেখার যেই শখ পূরণের প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে সামহয়ার ইন ব্লগ। আমি কৃতজ্ঞ সামহয়ার ইন ব্লগের সকল কলাকুশলির নিকট এবং অবশ্যই অমার শুভাকাঙ্খীদের নিকট, যারা সব সময় আমাকে প্রেরণা দিয়েছে। তাদের উৎসাহ না পেলে হয়ত এতদূর আসা হতো না।