মানুষের জীবন গতিশীল না বলে বরং সময় গতিশীল কথাটি বেশি যুক্তিযুক্ত। জীবন কখনো কখনো থমকে গেলেও সময় কখনো থমকে দাঁড়ায় না। গত একটি বছরে জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বলা যায় নতুন কয়েকটি অধ্যায়ে প্রবেশ করেছি প্রায় কাছাকাছি সময়ে। সামহোয়ার ইন ব্লগটা এক সময় খুব আপন ছিল, নানান ব্যস্ততায়, নানান কারনে ব্লগে আসা কমে গেলেও সেই আগের মতই আপন জায়গা আছে তাই অনেক মুহুর্ত শেয়ার করেছি এখানে। বরাবরের মতই আজও এসেছি সেই কারনে। ভয়, শংকা, আনন্দ, বিষাদ এবং শূণ্যতা নিয়ে কেটেছে একটি বছর। আজ গল্প বলবো সেই একটি বছরের।
নতুন একটি অধ্যায়ে প্রবেশ করেছিলাম সেটি আগের ব্লগেই বলেছিলাম। জীবনের প্রথম বাসা থেকে একা কোথাও যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম ভার্সিটি লাইফে ডিপার্টমেন্ট থেকে সবার সাথে সাগর এবং পাহাড় দেখতে যাওয়ার। কক্সবাজার-বান্দরবান ট্যুরটি ছিল জীবনের সেরা কিছু সময়ের অন্যতম। সাগর এবং পাহারের প্রেমে পড়ে গেছিলাম সেবার। গত বছর এই সময়ে বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়ী পর্যটন এলাকা কক্সবাজার জেলায়। সাগর এবং পাহাড় দুটোর মাঝে বাড়ী। হানিমুনও হয়েছিল সাগর এবং পাহাড়ে অর্থাৎ কক্সবাজার এবং সাজেকে।
যাইহোক অক্টোবরে কক্সবাজার-সাজেক ট্যুর বেশ সুন্দর মতই শেষ হল। এরপর ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ সৌদি আরবের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলাম। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত হ্য় যাওয়ার। সময় স্বল্পতার জন্যে মাত্র ১০দিনের ভিসা করি আমরা। এটা নিয়ে বেশ মনোক্ষুণ্ণ থাকে এবং এখনো আফসোস হয় আরেকটু বেশি সময় নিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। তার পরেও মক্কায় ভাসুর, বরের বন্ধু, মদিনায় বরের বন্ধু এবং জেদ্দায় খালা শ্বাশুড়ি এবং মামা শ্বশুর থাকায় ঘোরাঘুরি এবং সব কিছু বেশ সহজ এবং সুন্দর হয়। অল্প সময়ে অনেক বেশি উপভোগ করেছিলাম।
১। জেদ্দা বিমান বন্দর নেমে বাসের অপেক্ষায় ছায়া মানব আর ছায়া মানবী। ছায়ামানবীটি সিম সংক্রান্ত ভালই ধরা খেয়েছিল এখানে..
২। মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ মরুভূমি আর পাহাড়!
৩। মিনার তাবু, হজ্জের সময় যেগুলো হাজীদের পদচারনায় সমাগম থাকে সেগুলো এখন জনমানব শূণ্য।
৪। মুজদালিফা;
৫। মুজদালিফায় রাস্তার দুইপাশে এমন বড় বড় সবুজ গাছ দেখে মনেই হবে না মরুর দেশে এসেছি!
৬। আরাফার ময়দানে হযরত আদম (আ.) এবং হযরত হাওয়া (আ) এর দেখা যেখানে হয়েছিল সেখান থেকে নিচের এবং চারপাশের দৃশ্য
এখানে একটি স্তম্ভে ইংরেজি, উর্দূ এবং সম্ভবত বাংলায়ও ছিল, ৩/৪টি ভাষায় লেখা আছে এখানে সেজদাহ করা বা নামাজ পড়ায় কোন ফজিলত নেই। ফজিলতের আশায় এখানে নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তার পরেও দেখা যায় কিছু মানুষ নামাজ আদায় করছে এখানে।
যাহোক অনেক রোদ এবং গরম থাকায় দেখলাম এক মহিলা অজ্ঞান হয়ে পরেছেন। এখানে কেউ গেলে সাথে ছাতা এবং পানি নেওয়া আবশ্যক।
৭। মুজদালিফায় মসজিদ।
গাড়ীতে চলার পথে ছিলাম বিধায় সামনা সামনি ছবি তোলা যায়নি।
সৌদিতে একটি নিয়ম হল গাড়ীতে ড্রাইভারের পাশের সিট খালি রাখা যাবে না এটা ভাড়ার গাড়ী হোক কিংবা নিজস্ব। বরের বন্ধুদের গাড়ীতে চড়ার সময় ড্রাইভিং সিটে যখন যে বন্ধু নিয়ে যেতো সে থাকত এবং বর। প্রথম দিকে একটু কেমন কেমন লাগছিল। বরের বন্ধু একদিন জিজ্ঞেস করছে পেছনে একা বসতে খারাপ লাগছে কিনা। বললাম খারাপ লাগছে না বরং এটা ভাবতেই ভালো লাগছে যে ড্রাইভার এবং গার্ড নিয়ে আমি ঘুরতে বের হয়েছি।
অসম্ভব ভালো লেগেছে তায়েফের ভ্রমনটি, যদিও খুব আফসোস লেগেছে দিনের বেলা যাইনি বলে। আছরের পরে রওনা হয়ে তায়েফ পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমরা কেবল রাতের তায়েফ দেখেছি। কেউ গেলে এমন ভাবে যাবেন যাতে দিনের আলো থাকতে পৌছাতে পারেন এবং রাতের বেলা ফিরবেন।
৮। জিগজ্যাগ দেখা যাচ্ছে এটা পাহাড়ী রাস্তা
৯। মনোমুগ্ধকর বিভিন্ন রকমের লাইটিং রাস্তাজুড়ে
১০। মসজিদে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস; এখানে এশার নামাজ আদায় করে মক্কার উদ্দ্যেশ্যে রওনা হই।
১১। মদিনায় যাবার পথে; জনমানবহীন ধূ ধূ মরুভূমি আর পাথুরে পাহাড় চোখে পড়বে, মাঝে মাঝে ছোট ঝোপালো গাছ।
১২। মদিনায় জ্বীন পাহাড়ের এলাকা
সময় স্বল্পতায় এত বেশি দৌড়ের উপর থাকতে হয়েছে যে পরের দিকে খুব মেজাজ খারাপ হয়েছে কেন আরেকটু সময় নিয়ে আসিনি সেি জন্যে। মদিনায় কেবল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছি। জেদ্দায় খালা শ্বাশুড়ী নতুন বউ বরনের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন। সেখানে গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড! কল্পনার বাইরে ছিল সেখানকার আয়োজন। আমাদের জন্যে এশার থেকে অপেক্ষায় ছিলেন খালাম্মা আর আমরা সেখানে পৌছাই রাত প্রায় দুইটায়। বাড়ীর গেটে ঢুকতেই আতশবাজী জ্বালিয়ে হৈহৈ রবে সারপ্রাইজ!
১৩। ঘরে প্রবেশ করে দেখি একটি রুম আমাদের জন্যে সাজানো
খাবার খেতে বসে দেখি খাবারে চিটাগাং-কক্সবাজারের ঐতিহ্য পুরোপুরি চলে এসেছে হাজার হাজার মাইল পারি দিয়ে এই মরুভূমিতেও! বর-বউ দুজনের জন্যে দুটি আস্ত মুরগী ('দুরুস কুরা' বলে সম্ভবত কক্সবাজারের ভাষায়), চিংড়ি, গরুর নলা, গরুর মাংস, মাছ। খেতে বসে কান্নাকাটির জোগাড়! খাওয়া শেষ করে এলো বিভিন্ন রকম ফলে ভরা ডালা। ভেবেছিলাম এখানেই শেষ। কিন্তু দেখি তখনো বাকী রয়েছে! এবার এলো কেক কাটার পালা আর বউ-জামাই এর জন্যে গিফট। খালাম্মা এবং বাড়ির সবার আনন্দ দেখে মনেই হয়নি এদের সাথে প্রথম দেখা।
খুব আনন্দের সাথেই ১০টি দিন কেটে যায়। আনন্দ বা দুঃখ কোনটিই সাধারনত মানুষের জীবনে স্থায়ী হয় না। আগেই বলেছি জীবন তার নিজস্ব গতিতেই চলতে থাকে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে চাকরীতে জয়েন করে চলে যাই কর্মস্থলে। এপ্রিলে বুঝতে পারি আমি নতুন পরিচয় পাচ্ছি, নতুন এবং কাংখিত আরেক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। যখন জানতে পারলাম একই সাথে দুটি প্রাণ বেড়ে উঠছে আনন্দের সাথে ভয়-শংকা কাজ করছিল। নানান জটিলতার মাঝ দিয়ে অত্যন্ত কঠিন একটি জার্নি ছিল। ৯ মাসের জার্নিটি আমার ৬ মাসেই শেষ হয়ে যায়! ভাই-বোন দু'জন-ই NICU তে ছিল। ২৪ ঘন্টার আগেই মেয়েটি চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে আর ছেলেটি ৫ম দিন। জীবিত থাকতে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি আমার যাদুধনদের। প্রথম এবং শেষ গোসল দিয়ে নতুন কাপড়ে আতর সুরমা দিয়ে সাজিয়ে বিদায় জানাতে হয় তাদের। সুরমা দেবার সময় দু'জনের নিষ্প্রাণ চোখের মনি মনে ভেসে উঠলে মনে হয় দুনিয়ার সব অর্থহীন। দুনিয়ার কারো শান্ত্বনাই মনকে ঠান্ডা করতে পারে না। নিজের শান্ত্বনা নিজেই খুঁজি। কখনো বলি আল্লাহ বিবাহ বার্ষিকীর উপহার পাঠান আমাদের জন্যে জান্নাতের দুটো টিকেট! আমার কলিজার টুকরা দু'টো জান্নাতে খেলছে। অপেক্ষায় আছে আমাদের জন্যে। শেষ দিনে আমাদের না নিয়ে তারা জান্নাতে যাবে না। সেখানে দেখা পাবো। শূণ্য মাতৃত্ব নিয়ে আমি অপেক্ষায় আছি....।
(কারো কোন শান্ত্বনার আশায় নয়, বরং আনন্দের অভিজ্ঞতা যেমন শেয়ার করেছি এই ব্লগ পরিবারের সবার সাথে তেমনি কষ্টের অভিজ্ঞতাও করা যায় এই ভেবেই করা।)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:১৯