আমাদের চারপাশে কতশত বিচিত্র ঘটনা ঘটে কয়টার খবরই রাখতে পারি আমরা! তবে দেখার মত করে দেখতে পারলে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ হয়, উপভোগ করা যায় অনেক। চাকুরি জীবনের প্রথম পোস্টিং ছিল বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী এক উপজেলায়। আমার ডিপার্টমেন্টের কাজ মূলত মহিলাদের নিয়ে, মহিলাদের জন্যে। অনেক গুলো দ্বায়িত্বের মাঝে অন্যতম একটি ছিল নারী নির্যাতন ও যৌতুকের কোন মামলা হলে আদালত থেকে আমাদের প্রতি নির্দেশনা আসে বাদীপক্ষের (এসকল মামলায় কনে পক্ষই থাকে বাদী পক্ষ) দাবি অনুযায়ী প্রদেয় যৌতুকের মালামাল বিবাদী পক্ষের বাড়ীতে আছে কিনা তা তদন্ত করে আদালতকে জানানো। এখানে পুলিশী সহায়তার দরকার হয় না, তবে বিবাদী পক্ষের স্বভাব প্রকৃতি বুঝে বাদীপক্ষ জানালে পুলিশী সহায়তার কথা উল্লেখ করা হয় এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহন করা হ্য়। তদন্ত রিপোর্টের পরে আরেকবার আদালতের নির্দেশ আসে বাদীপক্ষের সেই মালামাল বিবাদীপক্ষের হেফাজত থেকে উদ্ধার করে বাদীপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে। এসময় আবশ্যিকভাবে পুলিশী সহায়তার প্রয়োজন হয়।
মূল কথায় যাওয়ার পূর্বে এত ব্যাখ্যায় যেতে হল কারন আমি যেই স্মৃতিগুলো এখানে বলবো তার প্রতিটিই একই ধরনের মামলার।
যে হাহাকার এখনো কানে বাজে:
এই মামলার বাদিনীর বাবার বাড়ী থেকে প্রদেয় মালামাল উদ্ধার করতে বিবাদীর বাড়ীতে উপস্থিত হই পুলিশফোর্স নিয়ে। বিবাদী প্রবাসী তাই বিবাদীর ভাই কয়েকবার অফিসে যোগাযোগ করেছে আমরা মালামাল উদ্ধার করতে যাওয়ার আগে যাতে তাদের জানাই, তারা প্রস্তুত থাকবে। এটি আসলে ভুয়া কথা কেননা বিবাদীপক্ষ আগে থেকে জানলে বাড়ী তালা মেরে সরে যায় ফলে আদের হ্যরানীতে পড়তে হয়। সেকারনে আগে থেকে জানিয়ে যাওয়া হয় না। তবে যদি মনে হয় বিবাদীপক্ষ ঝামেলা করবে সেক্ষেত্রে আমরা খুবই অল্প সময়ের নোটিশে জনপ্রতিনিধিকে জানিয়ে রাখি যাতে ঝামেলা হলে তিনি উপস্থিত হন। যাক, স্মৃতিচারণ করটে গিয়ে অনেক বেশি বিস্তারিত বলছি মনে হয়।
যাহোক, বিবাদীর ভাই একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তুর তার চাতুরি এবং ছোটলোকী দেখে মনটা বিষিয়ে ছিল। জেহেজনামা ধরে মালামাল শনাক্ত একেএকে সব বের করলাম। এখানে প্রাথমিক তদন্তের সময় বিবাদীর ভাই একটি চাতুরী করেছিল যা অনেকেই করে। তিনি তখন বলেছেন আলমারীর চাবি নাই তবে আলমারীতে যা মালামাল আছে তা বাদীর এবং তা নেওয়ার সময় দিয়ে দিবেন। মালামাল নেওয়ার দিন দেখা গেল আলমারীতে বাদিনীর শাড়ী কাপড়, কিন্তু তদন্তের সময় তা লিপিবদ্ধ করা যায়নি বলে আমরা জোর করতে পারছি না। কাপড় ছাড়াও বাদিনীর ভাইয়ের বিদেশ থেকে দেওয়া একটি কম্বল ছিল যা জেহেজনামায় উল্লেখ ছিল না ফলে সেটিও নিতে দেন নি তিনি যদিও বিবাদীর বৃদ্ধ মা দিতে চেয়েছিলেন। ভদ্র মহিলার কথায় বোঝা গেছিল দোষ তার ছেলের এবং এখনো বউকে ভালোবাসেন। শাড়ী এবং কম্বল যখন রেখে আসতে হচ্ছিল তখন বাদিনী চোখের পানি ফেলে হাহাকার করে বলছিল "ম্যাডাম ইগুমাল আমার, ইগু আমার"। পেশাগত দ্বায়িত্বের কাছে, কাগজের নির্দেশের কাছে আমার হাত পা বাঁধা ছিল ফলে আমি দিতে পারিনি অসহায় গরীব মেয়েটির ন্যায্য পাওনা। ফেরার পথে মনটা অসম্ভব রকম খারাপ ছিল, চোখে ভেসে উঠছিল অসহায় মেয়েটির কান্না। এখনো মাঝে মাঝে কানে বাজে সেই হাহাকার "ম্যাডাম ইগু আমার..." ।
যে মামলা আমার বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়িয়েছে:
সাধারনত কোন মামলায় বাদী-বিবাদী থাকে স্বামী-স্ত্রী কিন্তু এই মামলায় ছিল ভিন্ন। এখানে স্বামী-স্ত্রী এক বিবাদী হল স্বামীর বাবা, বোন। রুনার (ছদ্মনাম) স্বামী প্রবাসী। বাবার বাড়ী বেড়াতে গেলে রুনার শ্বশুর ও ননদ মিলে পার্শ্ববর্তী উপজেলায় তাদের আত্নীয়র বাড়ীতে রুনার বাবার বাড়ী থেকে দেওয়া অনেক মালামাল পাঠিয়ে দেয়। তবে পরে বিচার শালিশ বসলে বলে এসব মালামাল নাকি ডাকাত এসে নিয়ে যায় (বাড়ীর ফার্নিচার ডাকাতি হয় আর আসেপাশের কেউ জানেনা এটি অবিশ্বাস্য কথা)। মিনা বেগম (ছদ্মনাম) এর বাড়ীতে মালামাল আছে বলে রুনা যে দাবী করে তার সত্যতা যাচাইয়ে মিনা বেগমের বাড়ীতে যাই। মিনা বেগমের বাড়ীতে রুনার বলে যে মালামাল তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে কাগজে সই দিয়ে মিনা বেগম নিজ বাড়ীতে রাখেন, সেখানে উল্লেখ থাকে চূড়ান্ত বিচারে যদি এই মালামাল রুনার বলে প্রমান হয় তবে মিনা বেগম তা ফেরত দিবেন। পুরো মামলাটি ছিল অনেক জটিল, আমি সংক্ষেপে এখানে তা উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি।
একবার তদন্ত রিপোর্ট পাঠালে আদালত থেকে আবার নির্দেশনা আসে আবারো তদন্ত করে আমার যথাযথ মতামত প্রদানের জন্যে।
এবার অন্যভাবে এগিয়েছিলাম। মিনা বেগম মালামালগুলো তার বলে দাবী করেন কিন্তু প্রথমবার সেগুলো কেনার রিসিট দেখাতে পারেন নি এবং বক্সখাটের চাবিও দেখাতে পারেন নি বরং বলেছেন এগুলো তার ছেলে বিদেশে নিয়ে গেছেন (অবিশ্বাস্য কথা)। পরেরবার তিনি সেই রিসিট জোগাড় করেছেন বলে আমার অফিসে এসে দিয়ে যান। আমি তার সত্যতা যাচাইয়ে আমার স্টাফ দিয়ে ফার্নিচারের দোকানে পাঠাই।
ফার্নিচারের দোকানের রিসিট বিষয়টি ছিল পুরো সাজানো কারন, আমার স্টাফ অফিসে এসে পৌছানোর পূর্বেই মিনা বেগমের কাছে খবর যায় যে আমার অফিস থেকে ফার্নিচারের ব্যাপারে কেউ খোঁজ নিতে গিয়েছিল! ক্রেতাকে ফোন দিয়ে বিক্রেতার এই বিষয় জানানোর মানে বোঝাই যাচ্ছে এখানে ঘাপলা আছে।
এই ঘটনার পরে একদিন ভোরবেলা দেখি মিনা বেগম আমার বাসায় হাজির হয়েছে আমাকে বুঝাতে যে মালামালগুলো তার ছেলের কেনা। আমি যাতে তার মত গরীব অসহায় মহিলার দিক বিবেচনা করি। প্রথমে উনাকে বাসায় ঢুকতে না দিয়ে অফিসে এসে কথা বলার জন্যে বলেছিলাম কিন্তু একপ্রকার জোর করেই বাসায় ঢুকে। কথা শেষের এক পর্যায়ে যখন উনি ব্যাগ থেকে নেসক্যাফের এক কৌটা কফি বের করেন তখন বুঝতে পারি কেন অফিসে না গিয়ে বাসায় এসেছেন! কঠিন গলায় কফি ব্যাগে ঢুকাতে বললে মিনাবেগম একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বলেন "আফনে আমরার কুটুমের লাখান, আমরা কুটুম বাড়ীত খালি আতো যাই না..."। মেজাজটা টাং করে গরম হয়ে যায় এবং আরো নিশ্চিত হলাম অপরাধী পক্ষ উনিই। তখন আরো কঠিন হয়ে কফি উনাকে ব্যাগ থেকে বের করতে না দিয়ে বাসা থেকে এক প্রকার জোর করে বের করলাম।
মনে মনে ঠিক করলাম এই মামলার চূড়ান্ত এবং সঠিক প্রতিবেদন দিতেই হবে। মালামাল যে রুনার এরপক্ষে আরো জোরালো প্রমান এর মাঝে আমার হাতে এলো কিন্তু জনপ্রতিনিধিকে ডাকলে তিনি সবার সামনে কোন কথা বলতে অস্বীকৃতি দেন এবং একা এসে আমার কাছে স্বীকার করেন যে এই মালামাল আসলেই রুনার।
সকল তথ্যপ্রমানের ভিত্তিতে পরে আমার সুষ্পষ্ট মতামত আদালতে জানিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিলাম।
এই মামলার কাজটি একজন নবীন অফিসার হিসেবে আমার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছিল যা আমার অনেক দিন মনে থাকবে।
যে কাজ করতে গিয়ে হুমকির মুখোমুখি হয়েছিলাম:
এই মামলের প্রাথমিক তদন্তের কাজ আমি জয়েন করার পূর্বে হয়েছিল যা করেছিল আমার অফিস স্টাফরা। ওরাই বলেছিল প্রতিপক্ষ খুব ঝামেলাবাজ এবং প্রভাবশালী তাই যাতে শক্ত পুলিশফোর্স নেই। ওসি সাহেবকে এটা জানিয়েছিলাম। সাধারনত আমাদের সাথে দুইজন নিয়ে যাই সেদিন ওসি সাহেব রাফ এন্ড টাফ টাইপ দুইজন সহ মোট ৫ জনের ফোর্স দিয়েছিলেন। এতবড় ফোর্স আমি আশা করিনি আর এটা দেখেই বিবাদী পক্ষের আঁতে লাগে। বিবাদী আমেরিকা প্রবাসী বড় পয়সাওয়ালা এবং এলাকার বেশ প্রভাবশালী। বাড়ীতে কেবল তার মা ছিল। পরে আত্নীয়রা আসে। প্রথমে এত পুলিশ দেখে তারা প্রতিবাদ করেন। আদালতের নির্দেশে এসেছি বললে তারা মেয়রের দোহাই দেন এবং বলেন মেয়র তাদের গার্জেন, তিনি আসলে যাতে কথা বলে তারপর মালামাল নেই। এরমাঝে মেয়র মহোদয় না আসলে তারাই আবার বলেন মালামাল নিয়ে যেতে এবং সহায়তা করেন। কাজ প্রায় শেষ দিকে, এর মাঝে আমেরিকা থেকে বিবাদী মেয়র মহোদয়ের সাথে কথা বলে আমাকে ফোন দেওয়ায় আমি যাতে পুলিশ নিয়ে ফিরে যাই, উনাদের সম্মানহানি হচ্ছে এতে। আমি মেয়র মহোদয়কে জানালাম আমার মালামাল সব নেওয়া শেষ। অত্যন্ত গরম হয়ে আমাকে বলেছিলেন, যার বাড়ী গিয়েছি তার সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে ধারনা নিয়ে যাইনি কেন। আমি অত্যন্ত নিরুপায় ভঙ্গীতে বলেছিলাম, আমি আদালতের নির্দেশ পালনের এসেছি মাত্র, আমার প্রতি করা আদেশনামায় কারো সামাজিক মর্যাদার কথা উল্লেখ ছিল না তাই সেটা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব না।
উনি আমাকে হুমকীর স্বরে বলেছিলেন ঝামেলায় পড়লে তখন পুলিশ প্রশাসন পাশে পাবেন না এবং আরো কিছু!
পুলিশ সদস্য সহ উপস্থিত সবাই হঠাৎ এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। বাদিপক্ষের মালামাল তাদের বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় করে অফিসে চলে আসি।
মনটা অত্যন্ত বিষিয়েছিল। ভাবলাম বিষয়টি ইউএনও স্যারকে জানিয়ে রাখা জরুরী। জানাতে গিয়ে শুনলাম আমি আর কী জানাবো তার আগেই মেয়র মহোদয় উনাকে জানিয়ে সরি বলেছেন। অফিসে সবার সামনে পাওয়ার দেখাতে গিয়ে নাকি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন। কথাটি শুনে হাসি পেয়েছিল রাগও লেগেছিল এই ভেবে যে দোষ করল কার কাছে আর সরি বলল কাকে!
এর বেশ কয়েক মাস করে অব্শ্য উনার অফিসের হলরুমে আমার বেশ বর একটি প্রোগ্রাম হয় এবং উনি আন্তরিকতার সাথেই তাতে সাহায্য করেছিলেন (তবে মন থেকে উনার সেই হুমকী ধামকি ভুলিনি)।
************************************
সিলেট এবং চট্টগ্রামে যৌতুকের এমন বাজে প্রথা যার ফলে এখানে মেয়ে জন্ম নেওয়া মানে মা-বাবার জন্যে অভিশাপ। মেয়ে বিয়ে দিলে এসব এলাকার মেয়ের বাবা-ভাই আরো বেশি চাপে থাকেন এবং যে চাপ সারাজীবনব্যপী চলতে থাকে! যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে এত এত সচেতনতা এত কঠোর আইন তারপরেও কেন কমছে না, আমরা আসলেই কি চাইনা এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১০:১৩