আমি রাগী ছোট বেলা থেকেই তবে জেদী ছিলাম না। রাগ বেশি থাকলেও মায়ের শাসন প্রচন্ড ভয় পেতাম। বিয়ের পর রাগের সাথে সাথে জেদও বেড়েছে, নতুন সংযোজন হয়েছে বিধ্বংসী আচরণ! কোন কিছু ভাংচুর করে ফেলি রাগের মাথায়। জাবেরের সাথে বিয়ের পর বিয়ের আগের জীবন যাপন, চাওয়া পাওয়া আর পরের জীবনের সাথে ফারাক হয়ে যায় অনেক। মানিয়ে নিতে নিতে বুঝতে পারি আমার চাইতে বেশি গুরুত্ব ওর ভাই -বোনের, ভাতিজা ভাতিজির। আমার মতে ও ব্যালেন্স করতে জানে না ফলে এক দিকে ঝুঁকে যায়। বিয়ের পরপর প্রেশার ছিল বাচ্চার। ঘর আলো করে একসাথে দুজন এলেও আমার জীবনটা থেকে আলো কমে যেতে থাকে। সারা রাত একটু পর পর উঠে বাচ্চাদের খাওয়ানো, দিনেও একই রুটিনের ফলে নিজের বলে কোন সময় থাকেনা। রিল্যাক্স জিনিসটা জীবন থেকে কমতে থাক আস্তে আস্তে। জাবেরের একটা কাজকে খুব কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করি আমি তা হল একটু বড় হলে বাচ্চাদের রাতের দুধ ও বানিয়ে খাওয়াতো, আমাকে জাগতে দিতো না।
আমি জানি ওর উপরেও অনেক ধকল যায়, সপ্তাহে ৫দিন ক্লাস বাকী দুই দিন মার্শাল আর্টের ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত থাকে ও। ছুটির সকালে যেখানে মানুষ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে সেখানে ও আলো ফোটার আগে বাসা থেকে বের হয় আর সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। তবে আমি বিরক্ত ওর ওপরে কারন এত ব্যস্ততার মাঝেও বন্ধুর সাথে রিল্যাক্সের সময় ঠিক বের করে ফেলে। যদিওবা মাসে দুইমাসে আমাকে নিয়ে বের হয় তখন ওর চেহারার দিকে তাকানো যায় না বিরক্তিতে, রাগে। রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে ওর ওপর!
বাসায় ফেরার পথেই পেস্ট্রি শপ পরে আমাকে একদিন ফোন করেও ত বলতে পারে চলে এসো আধাঘন্টা সময় কাটিয়ে যাই যেমনটা করতো বিয়ের পর পর! প্রতিটা শুক্র শনিবার অন্তত একদিন এত ব্যস্ততার মাঝেও সময় দিতো আমাকে। এত দ্রুতই শেষ হয়েগেল দিনগুলো।
সব কিছুর পেছনে কখনো কখনো বাচ্চাদের দায়ী মনে হয়। দুপুরগুলো খুব ক্লান্তিকর হয়। ওদের সব চাওয়া পূরণ করে যখন নিজে বিশ্রাম নিতে যাই তখনি ওদের ঘুম ভেংগে যায়। আমি মা, তবে বলতে দ্বিধা হচ্ছে না যে ওদের কান্না অনেক সময়ই বিরক্তিকর লাগে, মনে হয় পা ধরে তুলে আছাড় মারি, গলা টিপে মেরে ফেলতে পারতাম যদি……!! জীবনটা খুব একঘেয়ে, ছোট্ট কিন্তু বিরতিহীন এক ছকে আটকা পড়ে গেছে। মাসে একটা দিন একটু ভিন্নতা চাওয়া কি খুব অন্যায়? পাই না তা।
কষ্টগুলো জমতে জমতে আগ্নেয়গিরি হয়ে গেছে, যখন অগ্ন্যুতপাত ঘটে তখন নিজেকেই নিজের ভয় হয়। আত্যহত্যা আমার ধর্মে নিষেধ ফলে সেই চিন্তা করতে পারি না। জীবন থেকে কেবল পালিয়ে যেতে মন চায়। কোথায় গেলে একটু শান্তি পাবো, স্বস্তি পাবো…?
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন প্রখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে অনলাইনে একটা টেস্ট দিয়েছিলাম 'ডিপ্রেশন, এংজাইটি এবং স্ট্রেস'এর। প্রতিটির ফলাফল এসেছে 'সিভিয়ার' লেভেলের! কেন বলুনতো? পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের সময় তো পার হয়ে গেছে বাচ্চারা প্রায় দুই বছর হতে যাচ্ছে এখনো কেন তবে বাচ্চাদের অসহ্য লাগে, ওদের বাবাকে দায়ী মনে হয়। আমি বের হয়ে আসতে চাই এই অসুস্থ জীবন থেকে……।
কথাগুলো এক মনোবিদের সামনে বসে বলছিলো সুখী। অঝোর ধারায় বইছিলো চোখের পানি। সকল সমস্যায় ওর রাগ, জেদের দোষ দেয় সবাই; স্বামী, মা-বাবা সবাই। কিন্তু ওর মতে পারিপার্শ্বিক আরো অনেক কিছুই দায়ী তবে ওর নিজের দোষ যেটুকু তা শোধরাতে মনে হয়েছে একজন প্রফেশনালের সাহায্য দরকার তাই আজ এখানে।
**********
সমাজে কত শত সুখী আছে যাদের এইজায়গায় এমন কারো সামনে বসে কাঁদার সুযোগটুকুও নেই, ক'জনার খবর রাখতে পারি আমরা!
সুখীরা বাস্তবিকই সুখী হোক তা কি আমরা মন থেকেই চাই ? মনোবিদের কাছে গেছে বলে 'পাগল' ঠাওরে সুখীদের জীবন আরো অসুখে ভরিয়ে ফেলছি নাতো?
পেটে খাবার, গায়ে সাবান লোশনের মত মনেরও যে পরিচর্যার দরকার তা আমাদের সারা জীবনেও হয়ত একটি বারের জন্যেও মনে হয় না!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:০৪