মাতৃত্ব খুব সুন্দর একটা বিষয়। আমাদের সমাজে বলা হয় মাতৃত্ব ছাড়া একজন নারীর জীবন অসম্পূর্ন যদিও এই পথ অত্যন্ত কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই কঠিন পথের বড় একটি অংশ মা'কে একাই পাড়ি দিতে হয়। তারপরেও একজন নারী উন্মুখ হয়ে থাকেন এই স্বাদ পেতে। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এই পূর্ণতা অপূর্ণতার মাপকাঠিতে আমার ঘোর আপত্তি রয়েছে। জীবনের পূর্ণতা কেবল সন্তানেই হতে পারে না। বরং অনেক চাওয়ার মাঝে অন্যতম একটা চাওয়া সন্তান হতে পারে। যাহোক তর্ক বিতর্কে বসিনি।
সন্তান যখন একটু একটু করে বড় হয় মা'র ভেতরে তখনকার বিভিন্ন সময়ের অভিজ্ঞতা নাকি বিভিন্ন রকমের। আমি দু'বার সেই সময়ের মাঝ দিয়ে গেলেও উপভোগ করতে পারিনি প্রচন্ড রকম শারিরীক কষ্ট এবং মানসিক চাপের কারনে। বিছানায় শুনে একটা একটা করে দিনগুনেছি কবে এই সময় শেষ হবে। প্রতি সপ্তাহে মোবাইলের এপসে দেখেছি বাচ্চার ওজন কতটুক হতে পারে এই সময়ে, কতটা বড় হল, কীসের সমান হল। স্ট্রবেরির সমান থেকে মাফিনের সাইজ তারপর আপেলের সাইজ , সেখান থেকে খরগোশের সাইজ…খুব উত্তেজনা নিয়ে দেখতাম এবং পড়তাম বিভিন্ন আর্টিকেল। তবে এই উত্তেজনা এবং আনন্দ থাকতো অল্প সময়ের। ভয়, কষ্ট, শংকা এসব জুড়ে থাকতো অধিকাংশ সময়।
নাটক সিনেমায় দেখে এসেছি বাচ্চা হলেই সাথে সাথে মায়ের বুকে দেওয়া হয়, এর উপকারিতাও জেনেছি পরে কিন্তু নিজের জীবনে দেখলাম উল্টো! প্রথমবার সময়ের আগেই তারা দুনিয়াতে আসায় কান্না শুনতে পেলেও দেখতে পাইনি তাদের, আমাকে দেখাতে গেলে নাকি দেরি হবে তাই চাইনি আর দেখতে। একজন দেখা দিয়েছিল কফিনে চড়ে এসে আরেকজন কাঁচের ঘরে ভেন্টিলেশনে!
দ্বিতীয়বারের মাতৃত্বের পথটাও ছিল অত্যন্ত কষ্টের এবং আগের বারের চাইতে বেশি শংকার। তবে এবার অপারেশনের টেবিলে যাওয়ার সময় ভেবেই রেখেছিলাম প্রথম দেখাটা স্মরণীয় রাখবো। মাইনাস পাওয়ারের চশমা পরায় একহাত দূরের জিনিসও স্পষ্ট দেখি না তাই চোখে চশমা নিয়েই টেবিলে উঠেছিলাম। চশমা খুলতে চাইলে বাঁধা দিয়েছিলাম চশমা খুললে কিছু দেখবো না বলে। কিন্তু গোমরামুখো নার্স "আপনার দেখার কিছু নাই" বলে চশমা খুলে নিয়ে গেল। আমার যাদুধনদের দেখবো আমি চিতকার করে বলতে চেয়েও তর্ক করার ইচ্ছে হয়নি আর। তাইতো সার্জন যখন বললেন "এই দেখো তোমার মেয়ে হইছে" কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার বললেন "এটাও মেয়ে হইছে দেখো" কেবল তাকিয়ে ছিলাম, কিছু দেখতে পাইনি। দৃষ্টিশক্তির জন্যে মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে!!
জন্ম থেকে ২/৩ মাস বয়সী ছোট বাচ্চা দেখলে এত আদর লাগে! ছোট্ট একটা পোটলা মনে হয় যেন সারাক্ষণ কোলে রাখি। হসপিটালে গেলে এমন মা-বাচ্চা দেখলে স্থাণুত মত দাঁড়িয়ে যাই, চোখ সরাতে পারিনা ছোট ছোট নাক চোখ আংগুল থেকে। মনে হয় যেন মা'কে বলি আমাকে একটু ছুঁতে দাও, কোলে নিতে দাও। আমার এই সময়টা এত কষ্টের গেছে যে কেমন ছিল সেই সময়, কী করেছিলাম এরকম দুটো পোটলাকে নিয়ে তা ভুলে গেছি। মাঝে মাঝে পাগলের মত স্মৃতির ঝুলিতে হাতড়ে বেড়াই কিন্তু সুন্দর কোন স্মৃতি খুঁজে পাইনা। অদ্ভুত এক শূণ্যতা ঘিরে ধরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি এমন অদ্ভুত স্মৃতি শূণ্যতায় কি আর কেউ ভোগে? কাউকে যেন সুন্দর একটা স্মৃতির আশায় আমার মত হন্যে হতে না হয় এই কামনা করি।
দু'বোন যখন একসাথে হল
জুওয়াইরিয়া নূর (সাফা), জুনায়রা নূর (মারওয়া)