শৈশবের স্মৃতি নিয়ে লিখতে বসে অনেকবার থমকে গেছি, এত এত স্মৃতি হুড়মুড় করে চলে আসে সোনালী স্মৃতির পাতা থেকে কোনটা রেখে কোনটাকে জায়গা দেবো ভেবে হিমশিম খাচ্ছিলাম! আবার অনেক কিছু আগেও কিছু ব্লগে শেয়ার করেছিলাম সব মিলিয়ে কী করি আজ ভেবে না পাই, ঐদিকে কন্যাদের জন্যে সুযোগ নাই এসব করে করে দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে!
কিছুদিন আগে খবর পেলাম আমাদের এলাকার 'জমিলা' মারা গেছেন। এই জমিলা বুড়ির ছিল মাথায় সমস্যা, মানুষের বাথরুমের পেছনে, বাঁশ ঝাড়, জংগল ঝাড়ু দিতো সারাক্ষণ, পাতা, ছেঁড়া কাগজ, ময়লা কুড়াতো। যতদিন শক্তি ছিল এসব করতো। ওনার বাড়িটার প্রতি ছিল দূর্ণিবার আকর্ষণ। চারপাশে ঘন করে গাছ লাগানোয় আলাদা বেড়া ছিল না গাছের ঝোপ ই ছিল বাড়ীর বেড়া। ক্ষেতের ভেতর একলা একটা ঘর, সেখানে তার একলার বসবাস। স্বামী নাই, ছেলেরা শহরে থাকে। সমবয়সীদের নিয়ে পুকুরে গোসলে যাওয়ার আগে জমিলা বুড়ির বাড়ীতে কাপড় রেখে বাড়ীর সামনের মিষ্টিআলু ক্ষেতে ঘন্টাখানেক গুলুম খুঁজে খুঁজে খেয়ে গোসলে যেতাম। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আবার ঘন্টাখানেক আলু ক্ষেতে গুলুম খেয়ে বুড়ির বাড়ি এসে কাপড় বদলে তার বাড়ীর আনাচে কানাচে ঘুরঘুর করে তারপর বাড়ী ফিরতাম ঘরে ঢোকার সাহস হতো না কারন অন্ধকার, এলোমেলো ঘর ছিল। একবার মনে হয় তাও সংগী সাথীদের সাথে গেছিলাম। সেবার বুড়ির ভাতিজা কোরবানীর ঈদে উট কোরবানী দিয়ে গ্রামে বিলি করে। ঈদের পরে গিয়ে দেখি ঘরের এমাথা ওমাথায় দড়ি টানিয়ে উঠের কন্ঠনালী (কলিজার সাথে কচকচে যে হাড়ওয়ালা একটা অংশ থাকে পাইপের মত) গেঁথে ঝুলিয়ে রেখেছে শুকাতে! বুড়ি হাপুস হুপুস করে পান্তাভাত খাচ্ছিল কী দিয়ে যেন। বুড়ি মরে গেলেয়াও এই স্মৃতি তো সোনালী বাক্সেই জমা হয়ে আছে আর তো কখনো ফিরে আসবে না। আল্লাহ জান্নাত নসীব করুক উনাকে, দুনিয়ার সকল কষ্টের উর্ধ্বে চলে গেছে।
আমার সবচাইতে সোনালী দিন গ্রামের শীতকালকে ঘিরে। দুইধারে গম, পেঁয়াজ, খেসারী, সরিষা ক্ষেতের আইল দিয়ে কলসী হাতে কুয়াশার চাদরে ঢাকা ভোর বেলা যখন খেজুর রস আনতে দূরে যেতাম, সরিষা ফুলের সাথে খালি কলসী বাড়ি মেরে যেতে যেতে একসময় কলসীর পেটে হলুদ ফুলের পাঁপড়িতে ভরে যেতো। চষা ক্ষেয়ের ঝুরঝুরে মাটি শিশিরে ভিজে নরম হয়ে থাকায় স্যান্ডেলের নিচে জমে এমন ভারী হতো যে একেক স্যান্ডেল কয়েক মন ভারী লাগতো। এটাও তখন উপভোগ্য ছিল যে আরে হালকা স্যান্ডেলটা কেমন যাদুর বলে ভারী হয়ে গেল! যখন পা আর চলতই না তখন একটা পাটকাঠি বা গাছের ডাল খুঁজে বসে পড়তাম স্যান্ডেলের তলার মাটি খুঁচিতে তুলতে। তখনকার জন্যে খুব সাধারন দিন হলেও এখন এসবই জীবনের সেরা সুন্দর দিনগুলোর মাঝে অন্যতম হয়ে গেছে।
অনেক অনেক স্মৃতি থাকলেও ভাবছি বেশি লিখবোনা। শেষ করছি অন্যতম সুন্দর কিছু কথা মনে করে। তখনকার জন্যে এটা অন্যায় ছিল এখনো অন্যায় তবে কেউ নিশ্চই এই লেখা পড়ে এসব শিখবে না। ব্লগার নীল সাধু ভাইয়ার স্মৃতিচারণ পড়ে মনে পড়তো আমরা দুই তিন বান্ধবী মিলে দেখা দেখি বা জিজ্ঞেস করে লিখতাম। রোল কাছাকাছি থাকায় সিট পরতো আগে পেছনে। আমার পেছনে থাকতো বান্ধবী এনীর সিট। কোন কিছু দেখানোর প্রয়োজন পরলে দ্রুত মূল খাতা শেষ করে লুজ শিট নিয়ে লিখতাম এরপর যেটা থেকে দেখানোর প্রয়োজন লিখতে লিখতেই হাতের নিচ দিয়ে একটু ঝুলিয়ে দিতাম এনী দেখে লিখতো। আমার থেকে এভাবেই দেখতো। তবে আমি সামনে থাকায় ওর থেকে এই টেকনিক কাজে লাগতো না, তখন ও লিখে পাশে রেখে দিতো আমি পেছন ফিরে দেখে লিখতাম। সবসময় বুঝতাম কারো থেকে দেখে/শুনে লিখতে হলেও নিজে পড়ালেখা থাকা লাগে নয়তো কবি গুরুর জায়গায় "কবি গরু" হয়ে যেতে পারে! এত চমতকার ছিল দিনগুলো মাঝে মাঝে মনটা হাহাকার করে এই ভেবে যে, যেই দিন গেছে একেবারেই গেছে!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২৩ সকাল ১১:৩৬