নোয়াখালী’র কথায় আসি। ২৫ মার্চ গভীর রাতে (অর্থাৎ ২৬ মার্চ) ঢাকা থেকে জেলা প্রশাসক জনাব মঞ্জুরুল করিম, বঙ্গবন্ধুর প্রথম সারির সহচর মরহুম আবদুল মালেক উকিল ও তখনকার দৈনিক পাকিস্তানের রিপোর্টার (বর্তমান জনকন্ঠের) জনাব কামাল উদ্দিন আহমেদের কাছে গোপন মেসেজ আসে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ঢাকায় জনতার সঙ্গে পাকহানাদারদের সম্মুখ যুদ্ধ চলছে। কার্য্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ সংযুক্ত। সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালী টাউন হল রূপ নিলো বৃহত্তর জেলার কন্ট্রোল রুমে। পি.টি.আই ভবনে অবস্থান নিলো মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। যেখানে ছিলো অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনী, অবসরপ্রাপ্ত ই.পি.আর, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ, ও আনসার। জিলা স্কুলে অবস্থান নিলো U.O.T.C ও J.C.C ট্রেনিং প্রাপ্ত কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররা। জিলা স্কুল ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলামম আমি নিজে। P.T.I দায়িত্বে ছিলেন অ্যাডভোকেট লুৎফুর রহমান ও নেভীর কমান্ডার রফিক। উভয় কেন্দ্রে অস্ত্র সরবরাহ করেন ৭১ এ অবস্থানরত নোয়াখালী’র D.C/S.P জেলা আনসার অ্যাডজুটেন্ট ও মহকুমা আনসার অ্যাড। টাউন হল কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বে ছিলেন মরহুম এম.এ. আজিজ। ১৯৭১ এর ১৫ মার্চ থেকে এক মাস নোয়াখালী শত্রুমুক্ত ছিলো। এর পর পাকবাহিনী আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নোয়াখালী তাদের দখলে নিয়ে যায়। আমরা সবাই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যাই। ট্রেনিং নিয়ে (এ জেলার ছেলেরা দেশের প্রত্যেকটি জেলার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে) সকল মুক্তিযোদ্ধা ক্রমে ক্রমে ভারত থেকে দেশে প্রবেশ করে। কয়েকটি যুদ্ধের কাহিনী:
রাজগঞ্জ যুদ্ধ:
পুরোনো কলেজের পরে রাজগঞ্জ। ৭১ সনের ২১ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের ৬ টি দল একত্রিত হয়ে পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য রাজগঞ্জ বাজারের চতুর্দিকে অবস্থান করে। রাজগঞ্জ বাজার থেকে মাইজদীতে অবস্থানরত পাকবাহিনী’র কন্ট্রোলরুমে বারবার টেলিফো করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং পাকবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য আহবান জানানো হয়।২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর ৫টি দলকে প্রত্যাহার করে অন্য জায়গায় অপারেশনে পাঠানো হয়। শুধু ১টি দল রাজগঞ্জে রইলো। পাকবাহিনী এই তথ্য গোয়েন্দা মাধ্যমে জেনে ঐদিন রাত ৩.৩০ মি: রাজগঞ্জ বাজারের ৫ দিক থেকে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের রাজগঞ্জে অবস্থানরত হাশেম কমান্ডারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষুদ্র দলটি মাইজদী বাজার থেকে ছয় আনি রাস্তা দিয়ে অভিযান পরিচালনা করে। পুরোনো নোয়াখালী কলেজের কাছ থেকে পাকবাহিনী ২ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে ফায়ার অব্যাহত রাখে।আর পাকবাহিনী ৪টি দল আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর উপর বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাশেম দৃঢ়তার সাথে পাকবাহিনীর মোকাবেলা করতে থাকে। ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৭.৩০ মি: পর্যন্ত যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনী প্রায় ২৩ জন পাকহানাদারকে হত্যা করে। ছয়আনি বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ১টি দল কমান্ডার হাশেমকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসার চেষ্টা করলেও সম্মুখ যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। কমান্ডার হাশেম নীরব হয়ে প্রায় ৩০ মি: নিজ অবস্থানে টিকে ছিলেন। শত্রুপক্ষ এ নীরবতার কারণ বুঝতে পেরে মুক্তিবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং কমান্ডার হাশেমকে গুলি করে হত্যা করে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা সবুজ ও রবি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তরুণ সবুজ (পিতা: মৃত সিদ্দিক উল্যা। থানা: মান্দারী, জেলা: নোয়াখালী)ও রবি (পিতা: হরিমোহন সাহা, গ্রাম: ভবানিগঞ্জ, জেলা: লক্ষীপুর) এই ছিলো দুইজনের ঠিকানা। অন্যদিকে পাকবাহিনীর যে দল রাজগঞ্জ আক্রমণ করেছিলো তাদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম হায়দার ও সফিক ধরা পড়ে। গোলাম হায়দারকে সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করে এবং সফিককে মাইজদী কোর্টে নিয়ে যায়। পাক বাহিনী ঐ এলাকা থেকে আরো ৬ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। পাক হানাদার সবুজ, রবি, মানিক ও ঐ ৬ জন লোককে মাইজদী জেনারেল হাসপাতালের পূর্ব উত্তর কোনের বিল্ডিং এর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে গণকবর দেয়।
(চলবে)
► লেখক: সাইফুল আলম জাহাঙ্গীর
সাবেক ইউনিট কমান্ডার, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নোয়াখালী।
► নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক স্বাধীনতা ২০০৩ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ মার্চ ২০০৩।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০০৮ রাত ৮:১৬