somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আইন কি পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন রুখতে পারে?

১৩ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৮:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আইন কি পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন রুখতে পারে?


যদিও বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদ, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ধারা ৫, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) ধারা ৭ , নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৮৪ সহ দেশে প্রচলিত হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু সংক্রান্ত আইন ২০১৩ এ সব ধরনের নির্যাতনকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ও 'শাস্তিযোগ্য অপরাধ' হিসেবে গণ্য করেছে তারপরেও পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন আজ সমগ্র বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও সংক্রামক বাঁধির মত ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে নির্যাতনের মূল হাতিয়ারগুলো দেশের প্রচলিত আইনগুলোর মধ্যেই রয়েছে। বিশেষ করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪, ১৬১ ও ১৬৭নং ধারার অপব্যবহার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় নির্যাতন করে থাকে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ নাম্বার ধারায় কোনো অভিযোগের তদন্তকালে সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও তা লিপিবদ্ধকরণ সংক্রান্ত বিধানগুলো বর্ণিত হয়েছে।

ওই ধারা অনুযায়ী কোনো সাক্ষীকর্তৃক সাক্ষ্য প্রদানের পর তা লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সেই সাক্ষীর স্বাক্ষর প্রদানের প্রয়োজন পড়ে না। ফলে তদন্ত কর্মকর্তা ইচ্ছামতো সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করার সুযোগ পান এবং আইনে প্রদত্ত সুযোগের অপব্যবহার করেন। অনেক সময় সাক্ষীর কাছে উপস্থিত না হয়ে বা তাদের জবানবন্দি গ্রহণ না করেই তদন্ত কর্মকর্তা ইচ্ছামতো তথ্য লিপিবদ্ধ করে তদন্ত সম্পন্ন করে থাকেন।

আবার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকার কারণে অথবা অবৈধ অর্থ আদায়ের জন্য অথবা অবৈধ অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে প্রভাবিত হয়ে সাক্ষীর জবানবন্দিতে বিভিন্ন নিরপরাধ ব্যক্তির নাম অপরাধী হিসেবে বা অপরাধের সহযোগী হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন এবং পরবর্তীকালে সেই নিরপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, নির্যাতন করে, অবৈধ অর্থ আদায় করে।

যদি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারা সংশোধন করে সাক্ষ্য গ্রহণপূর্বক লিপিবদ্ধ করে তা সাক্ষীকে পড়ে শোনানোর পর নিজ হাতে স্বাক্ষর করার বিধান করা হতো, তাহলে এভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তিকে নির্যাতন করার পথ অনেকাংশে রুদ্ধ হতো।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে পুলিশ নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। ওই বিধি পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তারের ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেছে। এর বলে কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুলিশ যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। যদিও আইন অনুসারে সন্দেহকে হতে হবে যুক্তিসঙ্গত, দৃঢ় ভিত্তি থাকতে হবে এবং নয়টি সুস্পষ্ট শর্ত মেনে চলার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পুলিশ সেসব শর্তকে থোরাই কেয়ার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে নির্মম নির্যাতন করে চলেছে।

একইভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় অপব্যবহার করে পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এ ধারায় পুলিশকে তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষমতা প্রদান করেছে। বলা হয়েছে, কোনো আসামি গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি তদন্তকার্য সম্পন্ন করা না যায় এবং তার কাছে থেকে আরো তথ্য পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার নিকট যদি যুক্তিসঙ্গতভাবে মনে হয়, তবে তিনি বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি সাপেক্ষে রিমান্ডে নিতে পারবেন। তবে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করতে পারবেন না।

মেধাবী কলেজ-শিক্ষার্থী রুবেল হত্যা মামলাসংক্রান্ত বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (বস্নাস্ট) কর্তৃক দায়েরকৃত 'বস্নাস্ট মামলা'য় ২০০৩ সালে বিচারপতি মো. হামিদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তারসংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং পুলিশি রিমান্ডসংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা সংশোধন করার জন্য একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন।

আইন সংশোধন না করা পর্যন্ত এ দুটি ক্ষেত্রে সরকারকে কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা মেনে চলার জন্য হাইকোর্ট বিভাগ অভিমত দিয়েছেন। আদালতের দেয়া নির্দেশনায় দুটি সুপারিশ করা হয়েছে_ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় নতুন উপধারা (২) সংযোজন এবং একই কার্যবিধির ১৬৭ ধারার (৩), (৪) ও (৫) উপধারাগুলো সংশোধন করা। এরই সঙ্গে দ-বিধির ২২০ ও ৩৪৮ ধারা দুটি সংশোধন করে ধারা দুটির আওতায় প্রদত্ত শাস্তির পরিমাণ বাড়াতে বলা হয়েছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা সম্পর্কে নির্দেশনায় বলা হয়েছে_এ ধারায় কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে হলে তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে বিষয়টি তার নিকটাত্মীয়কে জানাতে হবে। আর রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করা হলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটাত্মীয়কে জানাতে হবে। উভয় ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে কী কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা তিন ঘণ্টার মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। বিশেষ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের পর পরই মেডিকেল চেকআপ করতে হবে। প্তারকৃতের গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করবেন এবং যথাযথ কোনো কারণ না থাকলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের পর আটকাদেশ দেয়া যাবে না।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় প্রদত্ত রিমান্ড সম্পর্কে আদালত বলেছেন, পুলিশের কাছে কোনো অভিযুক্তকেই রিমান্ড দেয়া যাবে না। তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে জেলখানার আলাদা কক্ষে শুধু তদন্তকারী কর্মকর্তা তা করতে পারবেন। আদালত তার অভিমতে আরো বলেছেন, রিমান্ড দিতে হলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে নিশ্চিত হতে হবে, এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটকে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ও তার আইনজীবীর বক্তব্য শুনতে হবে। সর্বোপরি রিমান্ডের আদেশ নিশ্চিত করবেন দায়রা জজ। সেখানেও গ্রেপ্তারকৃতের বিরোধিতা বা আপত্তি করার সুযোগ থাকবে।

এ ক্ষেত্রে রিমান্ড দিতে হলে সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল চেকআপ করতে হবে এবং রিমান্ড শেষে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি নির্যাতনের অভিযোগ করলে আবারো মেডিকেল চেকআপ করতে হবে। নির্যাতনের বিষয়ে চিকিৎসক নিশ্চিত হলে ম্যাজিস্ট্রেট কোনো নিয়মতান্ত্রিক আবেদন ছাড়াই সঙ্গে সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

আদালত আরো উল্লেখ করেন, কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে জেলখানায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে একটি কাচের ঘরে তার নিয়োজিত আইনজীবী বা আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতিতে তা করতে হবে। যাতে তদন্তের স্বার্থে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন বা আইনজীবী কোনো প্রশ্ন-উত্তর শুনতে পারবেন না তবে কোনো নির্যাতন করা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে পারবেন।

২০১৩ সালে প্রণীত জেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুযায়ী নির্যাতিত ব্যক্তির পক্ষে বর্তমানে ন্যায়বিচার পাওয়া অনেকাংশে সম্ভব। তবে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশে বিদ্যমান আইন সঅম্পর্কে সধারণ মানুষ ও আইনজীবীদের অসচেতনতা, দীর্ঘমেয়াদি বিচার প্রক্রিয়া, ভিক্টিম, আইনজীবী ও প্রতিবেশীদের অজ্ঞতা, দারিদ্র্য ও অসচেতনতা এবং নির্যাতনকারীদের প্রভাব ইত্যাদি কারণগুলোই মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।

ন্যায়বিচার প্রাপ্তির লক্ষ্যে অবশ্যই এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব আইন নির্যাতন করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলো সংশোধন করে নতুন আইন প্রণয়ন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন যেগুলোর মাধ্যমে নির্যাতনের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব সেগুলোসহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কনভেনশনের ১৪ ধারা অনুমোদন করতে হবে। পাশা পাশি ২০১৩ সালে প্রণীত জেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইনের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন রুখা সম্ভব।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×