ছেলেটি অংকে ভাল। বলা যায় খুবই ভাল। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে দূর্বল হবার কারনে সে বরাবরই রেজাল্ট খারাপ করে। বিশ্লেষনধর্মী ও কিছুটা চিন্তাশীল হবার কারনে সবাই তাকে ব্যঙ্গ করে। এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু গণিত ও পদার্থবিদ্যা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে সুবিধা করতে না পারার কারনে সে চান্স পেলনা। শেষে গিয়ে একটি কলেজে অনার্সে ভর্তি হল সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা করার যেটুকু সুযোগ (সে খুবই অপ্রতুল এ দেশে), তা থেকে সে বঞ্চিত হল। পরবর্তীতে হয়ত দেশ তার কাছ থেকে অনেক কিছুই পেতে পারত, একজন ভাল গনিতবিদ হয়ে ওঠার যে আলো সবাই দেখতে পেয়েছিল, সে আলো অন্ধকারে পর্যবসিত হল একটি পরীক্ষায় অবতীর্ন হয়ে। সে পরীক্ষার নাম ভর্তি পরীক্ষা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের যে প্যাটার্ন এতদিন অনুসরন করা হয়েছে অথবা হচ্ছে, তাতে মেধাভিত্তিক প্রার্থী গ্রহনের পরিকল্পনাটাই মাঠে মারা পড়ে। একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দেখা যায় মুখস্তবিদ্যায় পারঙ্গম অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেল-এর মত সৃষ্টিশীল বিষয়গুলোতে চান্স পেয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রকৃত অনেক মেধাবী তরুন-তরুনী মুখস্ত উত্তর লিখতে পারদর্শী না হওয়ার কারনে এ সব নাম কা ওয়াস্ত ভর্তি পরীক্ষাতে ঝরে পড়ছে। ফলে মেধা যাচাই করে প্রকৃত শিক্ষার্থীকে তার উপযুক্ত জায়গায় স্থাপন করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক যে, সৃষ্টিশীল বিষয়গুলিতে যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী না পাওয়ার কারনে গবেষনায় আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে পড়ে যাচ্ছে। আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়ার অনেক আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা চান্স পাওয়ার আশায় কোচিং নামে যে একটা অমানবিক ও সৃষ্টিশীলতা ধ্বংসকারী পদ্ধতি অবলম্বন করে থেকে, তা একটি জাতির জন্য প্রকৃত মেধাশুন্য হবার পক্ষে বেশ সহায়ক। আর কোচিং সেন্টার বাণিজ্য এমনই একটা ফাঁদ পেতে রেখেছে যে, তাতে পা দেবার জন্য মুখিয়ে থাকে অভিভাবক, শিক্ষার্থী সহ অনেক শিক্ষক। বর্তমানে আমাদের দেশে এটা একটা অলিখিত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোচিং না করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চান্স পাওয়া যাবেনা।
এর সামনে পেছনে অবশ্য অনেক যুক্তিযুক্ত কারন রয়েছে। লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে কোচিং সেন্টারগুলো যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে, তা থেকে যেন আমাদের বাঁচার কোন উপায় নেই। আমরা সবাই সেই ফাঁদে পা দিতেই যেন বসে আছি। এর ফলে স্কুল-কলেজে সেই মানের পাঠদানও করা হয়না। ছাত্র-ছাত্রীরাও প্রকৃত অর্থে জানার জন্য পড়াশোনা করতে চায়না। কারন তারা ইতোমধ্যেই জেনে গেছে, মিছেমিছি পড়ে লাভ নেই। কারন পরীক্ষার আগে কোচিং করলেই পাশ করা যাবে। তার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শতকরা ১০০ ভাগ গ্যারান্টিযুক্ত কোচিং সেন্টারে কোচিং করলেই কেল্লা ফতে। এর ফলে মুখস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে দেয়। অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, একাউন্ট্যান্ট হতে না পারার মাধ্যমে দেশের প্রকৃত মেধার বিকাশ ব্যহত হয়। এ দেশে গবেষণা করার মত অমন মেধাবী মুখ দেখতে পাওয়া তাই ভার হয়।
আমাদের দেশে প্রকৃত অর্থেই ভাল কোন গবেষনাগার গড়ে ওঠেনি। কারন ভাল মানের একটি গবেষনাগার গড়ে ওঠার সাথে ভাল মানের মেধাবী ও বিশ্লেষনক্ষম শিক্ষানবীশের সম্পর্ক গভীর। একটি জাতি তার ভবিষ্যত বিজ্ঞানী, গবেষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দক্ষ জনবল তৈরীর মাধ্যমে সে জাতিকে চরম উৎকর্ষের দিকে ধাবিত করে, যেখানে ভাল মানের গবেষনাগারের অনেক বেশী প্রয়োজন। কিন্তু মেধার সঠিক বিকাশের যে নীতিমালা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন, সে দিকে সঠিক পদক্ষেপের উদাসীনতার কারনে এখানে সেই সম্ভাবনা এখনো গড়ে ওঠেনি। আমরা মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহ স্কুল-কলেজে ভর্তির জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে তা এখনই বন্ধ কারা উচিত। কারন, এতে মেধা তো যাচাই হয়ই না বরং, অনেক মেধাবী তার যায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়। বলা বাহুল্য এখানে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুখস্তবিদ্যাধারীদের অনুকূলে চলে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বর্তমানে প্রচলিত কিছু নিয়মের (নিয়ম না বলে অনিয়ম বলা সমীচীন) সাথে প্রত্যয়ী অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা পেরে উঠতে না পেরে ঝরে পড়ে। বর্তমানে প্রচলিত নিয়মের ধার ধারতে হলে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বাধ্য হয়ে জ্ঞান অর্জনের চিন্তা মাথা হতে আউট করে দিয়ে মুখস্তের পাল্লা ভারী করার যুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয়। আর দেশের বিশেষ করে মেট্রপলিটন সিটি এমনকি অন্যান্য অনেক শহরের অলিতে গলিতে “অমুক স্যার বিশ্বজয় করে এখন বাংলাদেশে”, “অমুক স্যারের কোচিং মানেই ১০০% চান্সের নিশ্চয়তা”, ইত্যাদী ধোঁকাবাজির ভ্রান্ত বুলি সম্বলিত ছেলেপুলের মাথাটা খাওয়া বিজ্ঞাপনের ফেরে পড়ে দেশের মেধা চর্চার বারটা বাজিয়ে ছাড়ছে কিছু অত্যন্ত ধূর্ত, নির্লজ্জ, তথাকথিত সুশিক্ষিত, কয়েক ডজন ডিগ্রীর তকমাযুক্ত লোভী কিছু মানুষ। এখনই ঝেঁটিয়ে এদের বিদায় না করলে দেশের টোটাল মেধার শুন্যতা প্রাপ্তি বিচিত্র নয়।
আমাদের ছেলেদের মেধার দুনিয়াজোড়া খ্যাতি আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাম জানা ও না জানা অনেক মেধাবী ব্যাক্তিত্ব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। কিন্তু সে সংখ্যা আশানুরূপ নয়। কিন্তু এটা শতকরা ১০০ ভাগ সত্য এবং দৃঢ় করে বলতে পারি, এ দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। শিক্ষা বিভাগের মত একটি পবিত্র সেক্টরে দূর্নীতির যে ভূত ঢুকে পড়েছে, তাকে শক্ত হাতে দমন করার কোন বিকল্প নেই। শিশুদের মেধা যাচাইয়ের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা না করা গেলে এবং মেধাশক্তি বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করা না গেলে এ দেশের যথাযথ উন্নয়ন কামনা করা হবে দুঃস্বপ্নের মত। শিক্ষিত জাতিই পারে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে। কিন্তু সেই শিক্ষা হওয়া চাই প্রকৃত শিক্ষা। সারা বিশ্বে ভারত ও চীন যেভাবে তাদের মেধাগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে, তাদের এক্কেবারে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের জনগণ হয়ে আমরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের পথ চলা দেখছি। আর গুটি কয়েক মেধাবী বাঙ্গালীর পরিচয় যদি প্রকাশিত হয়ে পড়ে তো তাকে নিয়ে নাচানাচি করেই সময় পার করে দিচ্ছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে বহির্বিশ্বে এ দেশের সোনার ছেলেরা যে ভাবে তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছে তাতে তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টা-ই মুখ্য। কিন্তু সারা দেশ থেকে প্রতিভা খুঁজে বের করতে হলে রাষ্ট্রকেই প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ন হতে হবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন না করে শুধু মুখে মুখে কামনা করলে কোন কাজই হবে না। কোচিং-এর মত একটি দুষ্টক্ষতকে অচিরেই তাই নির্মূল করা দরকার। স্কুল কলেজের লেখাপড়া ও শিক্ষা প্রদানের সিস্টেমে আধুনিকায়ন তথা বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যবস্থার প্রনয়ণ করা দরকার। সেক্ষেত্রে কোচিং-এর প্রয়োজনই পড়বে না।
মনে রাখতে হবে অংকের ছেলেকে অংকে, পদার্থবিদ্যার ছেলেকে পদার্থবিদ্যায়, সঙ্গীতের মেধাকে সঙ্গীতে; এমনি করে ছোটবেলা থেকেই প্রতিটি মেধাকে যাচাই বাছাই করে বড় করে তুলতে পারলেই দেশের মেধার প্রতি প্রকৃত বিচার করা হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আসল মেধা আসল যায়গায় পড়বে। গড়ে সব ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কোন যুক্তি আছে মনে মনে হয়না। এ ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছে, কিন্তু একটা আবেদনপত্র লিখতে পারছে না নির্ভূলভাবে। কারন এখানে শিক্ষা দেয়া হয়েছে গড়পড়তায়। ফলে কোনটাই ঠিক মত শেখা হয়ে ওঠেনি। গড়ে হাজার হাজার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য এত এত বিশ্ববিদ্যালয় যে কেন দরকার সেটাও বোঝা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়কে হয়ে ওঠা প্রয়োজন একটি আদর্শ গবেষণার স্থান। বাংলাদেশে তার সে রকম কোন চেহারা আছে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে? আছে কি কোন বিশ্বমানের গবেষণাগার? গরিব দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক বড় একটা অংশকে অবশ্যই কারিগরি পাঠদানে উৎসাহিত করা উচিৎ ছিল কি না, পশ্চিমা বিশ্বে ও দূর প্রাচ্যের দেশগুলোতে আসলে যেটা করা হয়ে থাকে।
আমরা সরকারের কাছে অবশ্যই এটা প্রত্যাশা করি যে, মেধাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার জন্য বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপদ্ধতি অবলম্বন করুন। দেখবেন এ দেশ শত শত বিজ্ঞানী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, বিচারক খুঁজে পাবে। গড় মেধার ফেরে পড়ে আমাদেরকে প্রকৃত মেধাকে তার সঠিক অবস্থানে আসীন করে দেশের উন্নতির জন্য এখনকার মত টানাটানির অবস্থা সেক্ষেত্রে অবশ্যই দূর হবে।